শব্দবৈচিত্র: গো মানেই গোরু নয়

তাহের আলমাহদী
Published : 25 Oct 2016, 04:51 AM
Updated : 25 Oct 2016, 04:51 AM

লাফালাফি আর ফালাফালি কিন্তু একই জিনিস৷ এভাবে শব্দ গঠিত হওয়াটাও ব্যাকরণের নিয়মানুবর্তী, যেমন: আজই হয়েছে আইজ৷

বাংলাদেশের অন্যতম দীর্ঘ একটি নদীর নাম গোমতী৷ কেউ কেউ লিখে থাকে ঘুমতী বা ঘোমতী৷ একই নামে ভারতেও একটি নদী রয়েছে৷ গোমতী শব্দের বুৎপত্তি হচ্ছে সংস্কৃত গো (জল)+ মৎ+ স্ত্রীবাচক ঈ৷ আমরা জানি গো শব্দের অর্থ গোরু, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষে গো শব্দের ৩২টি অর্থ লিখেছেন, এর একটি হলো জল৷ জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাশও তাঁর বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে তাই লিখেছেন৷

কথা হচ্ছে, গোমতী নাম কেন হলো? সকল নদীই জল দেয়, কিন্তু গোমতী নদীর জল খরস্রোতা, প্রাচীনকালে, একালেও মাঝে মাঝে গোমতীর জল পুরো কুমিল্লা জেলাকে প্লাবিত করে যায়৷ এই নদীটির সর্পিল গমন কুমিল্লা জেলার বিশাল অংশকে বেষ্টন করে রয়েছে৷

দক্ষিণ ভারতের একটি নদীর নাম গোদাবরী৷ এটি পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক নদী৷ গোদাবরী নামটিও গো বা জলের কারণেই হয়েছে৷ গোদাবরীর বুৎপত্তি দেখলে বিষয়টি সহজে বুঝা যাবে, সংস্কৃত গো (জল) + দা (দান করে) = গোদা (নদী)+ বর (শ্রেষ্ঠ) + ঈ (স্ত্রীবাচক)।

গোবর বলতে আমরা গোরুর বিষ্টাকেই বুঝি, কিন্তু গো শব্দের অর্থ যখন আকাশ, স্বর্গ, পৃথিবী মাটি হয় তখন গোবর কী কী অর্থ প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে একবার ভেবেছেন কী?

গো (জল) + বর (শ্রেষ্ঠ) = গোবর;
গো (আকাশ) + বর (শ্রেষ্ঠ) গোবর;
এই দুই গোরবকে আমরা বৃষ্টি বলতে পারি৷

গো (পৃথিবী)+ বর = গোবর, এই পৃথিবী প্রদত্ত শ্রেষ্ঠগুলোর তালিকা করে কি শেষ করা সম্ভব? মানুষ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী বলে মানুষকেও কি গোবর বলা যাবে? বাংলা ভাষার প্রতিটি শব্দের বানান নির্ভুল হওয়া গুরুত্বপূর্ণ৷ জ-কে য লিখলে উচ্চারণ হয়তো হয়ে যাবে, কিন্তু অর্থের বড় ধরনের তারতম্য এসে যাবে৷ গোমতীকে কখনো ঘুমতি লেখার সুযোগ নেই৷

বাংলা প্রতিটি বর্ণ অর্থ ধারণ করে, প্রতিটি শব্দ একটি কর্ম ধারণ করে৷ গোমতী বা গোদাবরী তাদের জলদান কর্মের কারণেই উপযুক্ত নাম পেয়েছে৷ বাংলা ভাষা এই বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে, অথবা বাংলা তার এই বৈশিষ্ট্য সংস্কৃত ভাষাকে দান করেছে, এই বিতর্ক করার চেয়ে জেনে রাখা ভালো প্রতিটি প্রাচীন ভাষা ক্রিয়া-ভিত্তিক, বৈজ্ঞানিক৷ একালে কোন বস্তুর বৈজ্ঞানিক নাম রাখতে গিয়ে আমরা যেমন বস্তুর ক্রিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি, তেমনি আমাদের মহান পূর্বপুরুষেরাও প্রতিটি বর্ণ, প্রতিটি শব্দ সৃষ্টি করেছেন ক্রিয়াকে ভিত্তি করেই৷ আরবী ভাষাও একই বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট, বর্ণের হেরফের হলেই অর্থের হেরফের হয়ে যাবে৷ আরবী কালব (قلب) অর্থ হৃদয়, অন্তর; আবার কালব (كلب) অর্থ কুকুর৷

সবশেষে গোরুর বিষ্টা গোবরের জন্মকথা বলি৷ সংস্কৃত গোবিট্ শব্দ থেকে বাংলা গোবর (গোবিষ্টা) শব্দের উৎপত্তি৷ আমরা কারো কারো মাথায় মগজ খুঁজে না পেলে বলি তার মাথায় গোবর ভর্তি৷ মগজ না থাকলে (মূলত মগজ আছে, কিন্তু ওটা নিজের মতো ক্রিয়া না করে গোবরের মতো কাজ করে বলেই) আমরা গোবর আছে অনুমান করি৷ মাথায় গোবরওয়ালা লোকদেরকে ইংরেজিতে বলে গোবেট৷ এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, সংস্কৃত গোবিট্, ইংরেজি গোবেট আর বাংলা গোবিষ্টা একই জিনিস, শুধু দেশান্তরে গিয়ে সামান্য রূপান্তর লাভ করেছে৷

সাড়া পেলে এই বিষয়ে আরও আলোচনা করা ইচ্ছা রাখলাম৷