তারকাখ্যাতির এদিক-সেদিক: বিবাহবিচ্ছেদ ও আত্মহত্যা

মাইদুল মিঠুন
Published : 22 July 2017, 07:19 PM
Updated : 22 July 2017, 07:19 PM

ঘটনা একঃ
চেস্টার চার্লস বেনিংটন, আমেরিকান জনপ্রিয় মিউজিক ব্যান্ড 'লিংকিন পার্ক'  এর ভোকাল। কন্ঠের জাদুতে মাতিয়েছেন সারা পৃথিবীর অজস্র তরুনকে। চরম বিষন্ন মানুষদেরকে বিনোদিত করার মাধ্যমে যুগিয়েছেন অনুপ্রেরণা।
২০ জুলাই, ২০১৭-এ বেনিংটনকে তার পালোস ভার্ডেস এস্টেটসক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত তার বাড়িতে তাকে ঝুলন্ত ভাবে আত্নহত্যারত অবস্থায় মৃত পাওয়া যায়। (Wikipedia.com)

এ বছরের মে মাসে আত্মহত্যা করেছিলেন সাউন্ড গার্ডেন ব্যান্ডের ক্রিস কর্নেল। ভক্তরা সেই শোক ভুলতে না ভুলতেই আবারও আরেক তারকা বিদায় নিলেন। তিনিও ক্রিসের বন্ধু। ব্যক্তিগত ভাবে একজন অমায়িক, বিনয়ী ও হাস্যজ্বল একজন মানুষ ছিলেন তিনি। সারা পৃথিবীতে যার কোটি কোটি ভক্ত, ব্যাণ্ড প্রতিষ্ঠিত হবার পর 'আর্থিক অস্বচ্ছলতা' শব্দটিও শুনেছেন কিনা সন্দেহ রয়েছে ব্যাপক। এক কথায় ,কোন কিছুতেই যার কোন অভাব নেই।

সেই ব্যক্তি কেন স্বেচ্ছামরণের পথ বেঁচে নিলেন?

ঘটনা দুইঃ

তাহসান-মিথিলা, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যত তারকা জুটি আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত। সফল প্রেমিক জুটি বলতে যাদেরকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা হতো এমনকি সবচেয়ে সুখী হিসেবেও যাদের স্বীকৃতি ছিলো। সেই দম্পতি বৃহস্পতিবার দুপুরে যৌথভাবে এক ফেসবুক বার্তায় জানান, 'কয়েক মাস ধরে নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বা মতবিরোধ নিরসনের চেষ্টার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সামাজিক চাপে একটা সম্পর্ক ধরে রাখার চেয়ে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই মঙ্গলজনক।'

এরপর ওই দিন সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে মিথিলা জানান, তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে এ বছরের মে মাসে। এর মধ্য দিয়ে তাহসান-মিথিলার প্রায় ১১ বছরের সংসারের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়েছে। এদিকে সম্পর্কের অবনতির কারণে প্রায় দুই বছর ধরে নাকি তাঁরা আলাদা থেকেছেন।(প্রথম আলো)।

তারা হঠাৎ কেন বিবাহ বিচ্ছেদের মতো 'ন্যাক্কারজনক' একটি খবরের জন্ম দিলেন?

ঘটনা তিনঃ

জাতীয় দলের ক্রিকেটার শহীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন তাঁর স্ত্রী ফারজানা আকতার।  দুই বছর ধরে বিবাহ বহির্ভূত বিভিন্ন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন শিহীদ। যা নিয়ে কথা বললেই নানাভাবে ফারজানার উপর নির্যাতন চালান তিনি। এমনকি বর্তমানে তারা একসঙ্গে বসবাসও করছেন না। পরিবারও তাকে নানাভাবে অসহযোগিতা করছে বলেও অভিযোগ করেন ফারজানা।

কেন বিবাহিত স্ত্রী রেখে এমন আসক্তি?

ঘটনা চারঃ

কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার, হুট করে উধাও হয়ে গেলেন, প্রথমে গণমাধ্যম প্রচার করলো তিনি অপহৃত। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে বের হয়ে এলেন একজন অর্চনা । তারপর 'গুরুবাবা', 'অপহরণের নাটক', 'বিভিন্ন অংকের মুক্তিপণ', এবং সেই অর্চনা-কে আর্থিক সহায়তা। আসলে কাজের কাজ একটাও হইলো না মাঝখান থাইকা হুজুগে মাতাল আমরা সবাই, কেন এমন? সবার এই একই প্রশ্ন, কেন এমন ঘটছে? বাংলাদেশে বিভিন্ন মতবাদের সমর্থক এই প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙি থেকে লেখালেখির জন্য বিভিন্ন সময়ে আলোচিত ও সমালোচিত। এক কথায় একজন পাবলিক ফিগার। আর্থিক সহায়তা করবেন ভালো কথা, কিন্তু এরকম নাটক করলেন কেন?

আমাদের মানবিকতা তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। অসহায় কাউকে সহযোগিতা করতে আমরা সবসময়ই সচেষ্ট থাকি। আর কেউ এ ধরনের সহযোগিতা করলে মানুষ মন থেকেই প্রশংসা করে। সেখানে এরকম নাটক করার অর্থ কি অন্তরালের কোন ঘটনাকে নির্দেশ করে না? কি সেই কারণ? কোন অপরাধ নয় তো? "তদন্ত চলছে, হাওয়া বাতাস সব আলাদা হয়ে গেলে তারপর তদন্ত রিপোর্ট পেশ করা হবে"। প্রত্যেকটা কেসে আমরা এমনটাই দেখে বা শুনে থাকি।

ক্রিকেটার শহীদ, নিজের বিয়ে করা বউ কে নির্যাতন করেন, কারণ হলো তার তারকা খ্যাতি আছে। সেই খ্যাতিকে পুঁজি করে চাইলেই যেকোন মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারেন। একজনের সাথে সংসার করতে আর কত ভাল লাগে?

এর আগে ক্রিকেটার রুবেল ও আরাফাত সানির বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ ওঠে। সে ঘটনা চাপাও পড়ে যায়। এ ঘটনাও চাপা পড়ার পথে…। কারণ হিসেবে কি তাহলে এখানে তারকা খ্যাতি কেই দায়ী করবেন আপনি (?)। তাহলে কি দরকার বাবা এই তারকাখ্যাতির যা সমাজে ভাঙ্গনের সৃষ্টি করে!

তাহসান-মিথিলা দম্পতি। নিজেরা অন্তরালের খবর  বলবেন না সেটই স্বাভাবিক । তারপরও মিডিয়ার সামনে বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরেই মণোমালিন্য চলছে। বোঝাপড়া হচ্ছে না, দুজনেই চেষ্টা করেছেন সামলে নিয়ে ইতিবাচক সমাধান করতে। শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠেনি। ঘটনা নেতিবাচক।

এক অনলাইন নিউজ পোর্টাল এর দাবি, তাহসান মিথিলার কোন এক ঘনিষ্ট আত্মীয় বলছেন, 'তাহসান বাংলাদেশি মেয়েদের একটি সিংহ ভাগের অন্যতম 'ক্রাস'। প্রচুর মেয়ে ভক্ত রয়েছে তার। আর তাহসান প্রায়ই সেই মেয়েভক্তদের ডাকে সাড়া দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান। কখনো কখনো 'কো-আর্টিস্ট দেফ সাথে লং ড্রাইভে বেড়িয়ে পড়েন"। স্ত্রী হিসেবে সেসব মেনে নিতে পারেন নি মিথিলা। তাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বাধ্য হয়ে দুজন আলাদা হয়ে থাকতে শুরু করলেন । শেষ পরিণতি এই বিচ্ছেদ। এখানেও কি 'তারকা খ্যাতিকেই দায় দেবেন আপনি?

১৯৭৬ সালের ২০ মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনায় জন্ম নেওয়া চেস্টারের শৈশবটা খুব একটা সুখের ছিল না। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে সাত বছর বয়স থেকে। অল্প বয়সে দেখেছেন মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ। এসব তাঁকে মানসিকভাবে বেশ আঘাত করে। ফলে ১১ বছর থেকে নেশা শুরু করেন। আত্মহত্যা করার আগে তিনি দারুণভাবে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। (কালের কন্ঠ)।

তাহলে হতাশাই আত্মহত্যার কারন। কিন্তু কেন এই হতাশা?

বেনিংটনের স্ত্রী ট্যাণ্ডিলা টুইটারে স্বীকার করেছেন, তারই প্ররোচনায় আত্মহত্যা করেছে চেস্টার। কারন, চেস্টার ট্যান্ডিলা কে ভালোবাসলেও ট্যাণ্ডিলা ভালোবাসতো লিংকিন পার্ক ব্যাণ্ডেরই আরেক সদস্য  মাইক শিনডো কে । মাইক ও ট্যান্ডিলা কে ভালবাসতো কিনা কে জানে?

"আর স্বাভাবিক ভাবেই, আপনার ভালোবাসার মানুষ টা অন্য কাউকে ভালোবাসবে এবং সে আপনার সাথেই থেকে প্রতিনিয়ত আপনাকে মানসিক ভাবে অত্যাচার করেই যাবে। নীরবে বা সরবে সহ্য করতে করতে একটা সময় সহ্যের বাধ ভেঙ্গে যাবে কিংবা আপনি বুঝে ফেলবেন আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিণী চাইছে , আপনি তার পথ থেকে সরে যান। কিন্তু, সরাসরি বলার সাহস পাচ্ছে না কারণ সামাজিকতা বলে একটা কথা আছে তো ,তার উপর পৃথিবীজোড়া সবাই ততদিনে জেনে গেছে আপনার সাথে আপনার পার্টনারের সম্পর্ক । এমন অবস্থায় আপনি ধীরে ধীরে ড্রাগ আসক্ত হয়ে পড়লেন। বাড়তে থাকল ডিপ্রেশন। তখন দীর্ঘদিনের মানসিক অশান্তি চেপে রেখে আপনার পার্টনার কে মুক্তি দিতে বেঁচে নিলেন স্বেচ্ছামরণের পথ"।

গল্পটা এমন হলে কি আপনি অবাক হবেন? যদি অবাক না হন তাহলে দোষ কাকে দেবেন আপনি?

'উচ্চাভিলাষ', 'সম্মতিহীন একটি সম্পর্কে অনিচ্ছা সত্ত্বেও জড়িয়ে পড়া এবং সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও আঁকড়ে পড়ে থাকার মানসিকতা'; নাকি 'সমাজব্যাবস্থা' কে? এই প্রশ্নের সমাধান আদৌ সম্ভব কিনা জানি না। কিন্তু, ব্যাপার গুলোকে যদি একটু অন্যভাবে চিন্তা করি তাহলে কেমন হয়?

তারা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত, সবাই কোন না কোন ভাবে সমাজে ব্যাপকভাবে পরিচিত। সবারই তারকাখ্যাতি আছে। আর্থিক সচ্ছলতাও বলার অপেক্ষা রাখে না, মোটকথা , কোন ক্ষেত্রেই তেমন একটা সমস্যা আমরা সাধারণ মানুষজনের দৃষ্টিগোচর হয় না। আমরা তাদেরকে দেখে অনুপ্রাণিত হই। তাদের কে রোল মডেল ভেবে তাদের মতো জীবন যাপনের প্রত্যাশা করি। এমনকি ঘুমের মধ্যে স্বপ্নও দেখি তাদের মতো হয়ে গেছি। আমাদের দৃষ্টিতে সেই সব মডেলেরই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে আমাদের কী হবে? ভেবে দেখেছেন কি? না ভাবলে ভাবুন…।

ওনারা বাইরের কোন গ্রহ থেকে আসা এলিয়েন নয়। বা অন্য অলৌকিক ক্ষমতা প্রাপ্ত কেউও নয়। রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। আবেগ অনুভূতি ভালোবাসা আপনার-আমার মতো তাদেরও আছে। তাদের যা দেখে আপনি তাদের মতো হবার ইচ্ছা পোষন করছেন, সেগুলো মানুষকে সুখি করতে পারে না। কখনো পারেনি। যে সুখটা আপনি আপনার চামড়ার চোখে দেখছেন সেটি নিছক একটা মোহ ছাড়া কিছুই নয়।

এই মোহের পিছনে দৌড়ানো বন্ধ করা উচিত এখনি। আপনার যা আছে তাই নিয়ে সুখী থাকুন। অর্থ মানুষকে কখনোই সুখী করতে পারেনি, পারছেনা, পারবেও না। যশ-খ্যাতি নিয়ে সুখে থেকেছেন এমন দৃষ্টান্তও বিরল। তাই যশ- খ্যাতির পেছনে ছোটাও এক বড় বোকামি। নিজের কাজ করুন। আপনার কাজ সঠিক হলে খ্যাতি আপনার পেছনে ছুটবে। আপনাকে খ্যাতির পিছনে ছুটতে হবে না।

মনে হয় সাইকোলজির দিকে চলে গেছি। ফিরে আসি শাকিব-অপুর ঘটনায়। সবকিছু লুকিয়ে থাকলো অনেকদিন , হুট করে সব বেড়িয়ে এলো। মিডিয়া নাড়াচাড়া করলো ২-১ দিন। মূহুর্তের মধ্যে সব রঙ বদলে গেলো। এখন শাকিব-অপু প্রসঙ্গ ভুলতে বসেছে মানুষ। এরকমই হয়, এরকমই হবে। ঘটনা জন্ম নেবে ।গণমাধ্যম সেটাকে বড় করবে, ছোট করবে। তারপর টুপ করে প্রসঙ্গ উধাও হয়ে যাবে। ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটবে। আসলে কেউ কারও জায়গায় সুখী নয়।

নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে। – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.