দুইশ বছরের পুরোনো রোহিঙ্গা সংকট এবং একজন ‘পিতৃভক্ত’ সু চি!

মোরশেদ তালুকদার
Published : 6 Sept 2017, 07:25 PM
Updated : 6 Sept 2017, 07:25 PM

সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হওয়ার পর থেকে সবাই মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির সমালোচনা করছেন। দাবি ওঠে তার নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার। সমালোচনা থাকলেও সু চি কিন্তু সঠিক জায়গায় আছেন! তা কিভাবে? বলছি। তার আগে এ যাবত রোহিঙ্গাদের ওপর যত হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে মিয়ানমার সরকার তা জানতে হবে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহারণ ছিল আরাকান (বর্তমান মিয়ানমারের রাখাইন স্টেট) । পঞ্চম শতাব্দীতে এখানে হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্য ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল দেখার মত। আরাকানে ইসলাম আসে সপ্তম শতাব্দীতে। তখনো অটুট ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। অশান্তি শুরু হয় আরো বহু পরে। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বর্মীরা আরাকান দখলের পর থেকেই। সেই থেকে আজ পর্যন্ত সেখানকার মুসলিমগোষ্ঠী নির্যাাতিত হয়ে আসছে।

১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দ। আরাকান (বর্তমান রাখাইন স্টেট) শাসক ছিলেন 'থামাডা'। ওই বছরের শেষের দিকে আরাকানে আক্রমণ করেন বার্মার আলংপায়া বংশের সাম্রাজ্যবাদী শাসক "বোধপায়া"। এই বোধপায়া যখন আরাকান আক্রমণ করেন তখন আরাকানিরা ছিল দেশদ্রোহীর ভূমিকায়। তারা বাদ্য বাজিয়ে নৃত্যের মাধ্যমে নিজেদের শত্রু বর্মীদের বরণ করে নেন। অত:পর যুদ্ধে পরাজিত হন আরাকান শাসক থামাডা। সেই থেকে আরাকান যুক্ত হয় বার্মার সাথে। অর্থাৎ আজকের 'রাখাইন স্টেট' বার্মার অংশ হয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় আসল খেলা। আরাকান জয়ের মাত্র একমাসের মধ্যেই বর্মীরা আরাকানিদের উপর নির্যাতন শুরু করে। চরম নির্যাতনের পর আগুনে পুড়িয়ে হত্যাও সেই সময় থেকে শুরু। নিজ শাসকের বিরুদ্ধে যাওয়ার মজা এবার টের পায় আরাকনিরা।

১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে বর্মিরা আরাকান আক্রমণ করেন। তবে পুরো আরকান দখল করতে চলে আসে ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ। এরিমধ্য বর্মিরা আরাকানিদের ওপর নির্যাতন শুরু করে দেয় । ক্ষমতা দখলের সময় ২০ হাজার আরাকানিকে হত্যা করা হয়েছিল।

১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে নির্যাতিত আরাকানিরা বর্মিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। যদিওএই বিদ্রোহ দমনে সক্ষম হন বর্মিরা। সাথে বাড়িয়ে দেন নির্যাতনের মাত্রা। ওই সময় দুই লাখ আরাকানিকে হত্যা করা হয়েছে বলে ইতিহাস রচয়িতাদের দাবি।

১৮১১ খ্রিস্টাব্দে সিন পিয়ান নামে একজন আরাকানির নেতৃত্বে বর্মিদের অত্যাচারের প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল। তিনি আরাকানের রাজধানী "ম্রোহং" ছাড়া বাকি অঞ্চল দখল করে নেন। বৃটিশদের অপকূটনীতির কারণে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে বর্মিদের সঙ্গে এক যুদ্ধে পরাজিত হন। সিন পিয়ান পালাতে সক্ষম হলেও তার অধিকাংশ সৈন্যকে হত্যা করে বর্মিরা। তিনি মারা যান ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে। এরপর বর্মিদের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয় ব্রিটিশদের। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় ইঙ্গ-বর্মি যুদ্ধে পরাজিত হয় বর্মিরা। বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হয় বার্মা। ভাগ্য কিছুটা সহায় হয় উদ্বাস্তু আরাকানিদের।

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয় Thakin Party। রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সমন্বয়ে সংগঠনটি গঠিত হয়েছিল। ওই সংগঠনের নেতারাই আরাকানে নতুন করে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে। মগ ও মুসলিমদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে।

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ-ভারত থেকে আলাদা হয় ব্রিটিশ -বার্মা। এতে ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় থাকিন পার্টির। এবার আরো জোরালো করে সাম্প্রদায়িক উস্কানি। এরফলে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে হত্যা করা হয় ৩০ হাজার মুসলমানকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে থাকিন পার্টির নেতারা অবস্থান নেয় জাপানের পক্ষে। ওই সময় Aung Sun এর নেতৃত্বে ৩০ সদস্যের একটি দল জাপানে যায় গোপনে। সেখানে জাপান সরকারের সহায়তায় তারা সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। জাপানের সহায়তায় এরা গঠন করে Burma Independent Army (BIA)। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে জাপানি বাহিনির সঙ্গে বার্মায় প্রবেশ করে BIA। জাপানিদের তীব্র আক্রমণে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ থেকে বার্মা ছেড়ে পালাতে থাকে ব্রিটিশরা। এতে আরো শক্তিশালী হয় BIA।

আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর বর্বর হামলাটি এবার চালায় BIA। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে। যা "৪২ মাস্যাকার" নামেই খ্যাত। সেই হামলায় এক লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা এবং পাঁচ লাখ মুসলিমকে ঘরছাড়া করে BIA। সেই সময় 'মৃত রোহিঙ্গার মস্তক নিয়ে তারা উল্লাস করেছিল'।

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের আকিয়াব অঞ্চলের ডেপুটি কমিশনার Kyawu এর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল Burma Territoral Force (BTF)। এই সংগঠন গঠনের উদ্দেশ্য ছিল আরাকান থেকে মুসলমানদের তাড়ানো। এর অংশ হিসেবে BTF " উত্তর আরাকানের বুদ্ধিজীবী, গ্রাম্য প্রধান, ওলামা এবং কয়েক হাজার সাধারণ মানুষকে হত্যা করে এবং মুসলিম অধ্যুষিত বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়"।

১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে বার্মা সেনা প্রধান 'জেনারেল নে উইন' ক্ষমতা দখল করে। এবার তিনি আরকানি মগদের উস্কানি দেন মুসলিম নির্মূলে। তিনি নিষিদ্ধ করেন রোহিঙ্গাদের সামাজিক সংগঠন। ওই সময় চাকরিরত মুসলমানদের চাকরি রক্ষায় "স্বধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণে চাপ দেয়া হত"।

জেনারেল নে উইন ছিলেন কৌশলী। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে বার্মার রাজধানী রেংগুনে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। এই ঘটতি মেটাতে তার চোখ পড়ে আরাকানি মুসলমানদের দিকে। জোর করে মুসলমানদের মজুদকৃত খাদ্যশস্য লুটে নেয় জেনারেল নে ইউনের সৈন্যরা। আরো নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরির মাধ্যমে নির্যাতন করে মুসলিমদের।

১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে সামরিক শাসকরা দুটি অপারেশন চালায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে। "শিউ কাই" ও "কাই গান" নামে এই অপারেশন চলাকালে মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করা ছিল প্রধান কাজ।

১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নতুন করে নির্যাতন শুরু করে বার্মা সরকার। National Registration Card তল্লাশীর নামে সেবার পরিচালিত অপারেশনের নাম ছিল King Dragon বা Naga Min। এ অপারেশনে ১০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল।

১৯৭৯ ও ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দেও কয়েকটি অপারেশন চালায় মায়ানমার সরকার। এতেও হাজার হাজার নিরীহ মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল। ইতিহাস বলছে, সরকারি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৪৮ থেকে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে মুসলিম হত্যায় ১৪ টি বড় ধরনের অপারেশন চালায় মায়ানমার সরকার। এসব অপারেশনে লক্ষাধিক মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল।
অপারেশনগুলো হচ্ছে- Burma Territoria Force Operation, Combined Immigration & Army, Union Military Police Operation, Captain Htin Kyaw Operation, শিউ কাই অপারেশন, কাই গান অপারেশন, নাগাজিন কা অপারেশন, মাইয়াট মন অপারেশন, মেজর অং থান অপারেশন, সেব অপারেশন এবং নাগামিন অপারেশন।

২০১২ খ্রিস্টাব্দে ২০০ রোহিঙ্গা হত্যার কথা বলা হয় মায়ানমারের রাষ্ট্রীয় রিপোর্টে। বাস্তবে তা হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দেও রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হয় এবং চলতি বছরে গত কয়েকদিন আগে থেকে শুরু হয়েছে।

অতীতের বিভিন্ন হামলায়, বার্মার সেনাবাহিনি আরাকানের মসজিদসহ মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা করে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ধ্বংস করা হয় "কাইউক পাইউ" শহরের মাদ্রাসা। "অনেক কবরস্থানকে শুকরের চারণভূমি বানানো হয়। ১৯৬২ থেকে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোন মুসলিমকে হজে যাওয়ারও অনুমতি দেয়নি বার্মা সরকার।

এবার আসা যাক অং সান সুচি প্রসঙ্গে। আবারো বলছি,   সমালোচনা থাকলেও সুচি কিন্তু সঠিক জায়গায় আছেন!  আমি বলি, সমালোচনা করা বোকামি। কারণ, সুচির দেহ-মনে আছে রক্তের নেশা। রোহিঙ্গা মুসলিমদের রক্তের নেশা। জন্মসূত্রে সে তা পেয়েছে। কারণ তার পিতাও ছিল রোহিঙ্গা মুসলিমের রক্তের নেশায় কাতর।

আগেই বলছিলাম, থাকিন পার্টির কথা। এই থাকিন পার্টির সদস্য ছিলেন আজকের মিয়ানমার নেত্রী সুচির বাবা অং সান। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা হত্যায় জড়িত ছিল 'থাকিন পার্টি'। সেই পার্টির সদস্য সুচির পিতা 'অং সান' মুসলিমদের রক্তে হাত লাল করেছিল। এখন পিতার দেখানো পথেই হাঁটছেন সু চি। সু চির এ পিতৃভক্তিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

লেখক- মোরশেদ তালুকদার
স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী (স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদ পত্র)