বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি দৃষ্টি দিন

মামুনুর রশিদ
Published : 26 May 2015, 11:44 AM
Updated : 26 May 2015, 11:44 AM

একটি দেশ বা জাতির উন্নতি বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ব্যতীত কোনো জাতি অগ্রসর হতে পারেনা। যে জাতি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যত উন্নত, সে জাতি ততটাই অগ্রসর। কোন একটি দেশের সার্বিক উন্নতি অনেকাংশে নির্ভর করে সেদেশের বিজ্ঞান শিক্ষার উপর। পৃথিবীর সবগুলো উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় তারা বিজ্ঞান শিক্ষায় অনেক বেশি উন্নত।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ, এদেশকে এগিয়ে নিতে হলে এ দেশের বিজ্ঞান শিক্ষায় অধিক পরিমান শিক্ষার্থীর অংশগ্রহন করা একান্ত জরুরি। কিন্তু শিক্ষাবিষয়ক তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশন ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকসের (ব্যানবেইস) পরিসংখ্যান দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। ১৯৯০ সালে মাধ্যমিকে মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থী ছিল ৪২ দশমিক ৮১ শতাংশ আর উচ্চমাধ্যমিকে ২৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এরপর ২০০২ সালে তা বেড়ে হয় ২৫ দশমিক ৮৪ শতাংশে। তারপর আবার পতনের শুরু এবং ২০১৩ সালে তা নেমে আসে শতকরা ১৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক সম্মান পর্যায়ে এই সংখ্যা আরও ভয়াবহ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষার্থী সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। কমিশনের ২০০৬ সালের হিসাবে অনুযায়ী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল ১৭ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে তা কমে হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশে! পরিসংখ্যান বলছে, বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিনদিন হতাশাজনকভাবে কমছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থী বাড়ছে ব্যবসায় শিক্ষায়। মাধ্যমিকে বাংলাদেশে ব্যবসায় শিক্ষা চালুর সময় ১৯৯৮ সালে পরীক্ষার্থী ছিল ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ দশমিক ৭৬ শতাংশে! অপরদিকে ১৯৯০ সালের উচ্চমাধ্যমিকে ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় মোট পরীক্ষার্থীর ছিল ১৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ দশমিক ১৯ শতাংশে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে মাধ্যমিকে ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় প্রায় পাঁচগুণ এবং উচ্চমাধ্যমিকে প্রায় দ্বিগুণ হারে শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গত কয়েকবছরের পরিসংখ্যানে এটা সুস্পষ্ট যে, মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভিড় করছে বিজ্ঞানের বদলে ব্যবসায় শিক্ষায়। যেখানে নব্বইয়ের দশকে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য, একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানভিত্তিক যুগে এসে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। চটকদার ডিগ্রি (বিবিএ/এমবিএ), করপোরেট জগতে মোহনীয় চাকরির প্রলোভন আর আইনি খোলা দরজা দিয়ে বেনোজলের মতো ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ঢুকছে সম্ভাব্য বিজ্ঞান শিক্ষার্থীরা। ব্যবসায় শিক্ষা অধ্যয়নও দরকারি কিন্তু মানবজীবনের জন্য বিজ্ঞানের অবদান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো দেশ বা জাতির উন্নতির মূল চাবিকাঠি হলো বিজ্ঞান শিক্ষা। বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হলেও আজ আমাদের দেশে কেন বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি ক্রমবর্ধমান অনীহা দেখা যাচ্ছে? কেন স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও বিজ্ঞান অধ্যয়নের পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছেনা? কী কী কারণে বিজ্ঞানে শিক্ষার্থী কমছে এবং ব্যবসায় শিক্ষায় তা বাড়ছে তা অনুসন্ধান করা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি এর সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অভিঘাত অনুসন্ধান করা।

বিজ্ঞান পঠন-পাঠন অপেক্ষাকৃত কঠিন। সাধারণত বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় ছাত্রছাত্রীরা শ্রেণীকক্ষে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করতে পারে না। ফলে স্কুলের বাইরেও তাদের আলাদাভাবে সেই বিষয়ে প্রাইভেট টিউটর রাখা কিংবা কোচিংয়ে পড়তে হয়। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের একজন বিজ্ঞানের ছাত্রের পেছনে শিক্ষা বাবদ বেশি ব্যয় করতে হয়। অন্যদিকে অনেক পিতামাতা ভেবে থাকেন অযথাই বিজ্ঞান পড়ে এত কষ্ট করার চেয়ে অন্যান্য শাখায় খুব সহজেই এ প্লাস পাওয়া যেতে পারে। তাই তাদের আর্থিক সক্ষমতা কিংবা সন্তানের পরিশ্রম করার মনমানসিকতার ওপর নির্ভর করে বিজ্ঞানে কমে যাচ্ছে শিক্ষার্থী। সিলেবাস এক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা। বিশ্বাস করা কঠিন হলেও সত্য যে ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ের তুলনায় বিজ্ঞান বিষয়গুলোর সিলেবাস প্রায় তিন গুণ বড়! সিলেবাসপ্রণেতারা আমাদের মতো তরুণ বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের বয়স ও সামর্থ্যের সঙ্গে সংঙ্গতিপূর্ণ সিলেবাস প্রণয়ন করেননি। বর্তমান সিলেবাস দেখলে মনে হচ্ছে, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েই একেকজন বিজ্ঞান শিক্ষার্থীকে তাঁরা আইনস্টাইন বানাতে চান। একজন তরুণ শিক্ষার্থী যখন কোন একটি বিষয় ঠিক মত বুঝতে পারেনা, পড়ার মাঝে যখন সে আনন্দের পরির্বতনে বিশাল বোঝা খুঁজে পায় তখন সে আস্তে আস্তে ঐ বিষয় থেকে দূরে সরে যেতে চায়। এমন অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে খুঁজে গেছে যারা কিনা মাধ্যমিকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল কিন্তু পরবর্তীতে সে বিজ্ঞানের বিভাগের কাঠিন্যে উচ্চমাধ্যমিকে আর বিজ্ঞানের দিকে ধাবিত হচ্ছেনা, তার ধারনা বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশুনা করা অনেক বেশি কষ্টের, অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা যখন তার অর্ধেক সময় পড়াশুনা করে ভালো ফলাফল করছে অথচ সে তাদের চেয়ে মেধাবী (জেএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট) এবং বেশি পড়াশুনা করেও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাচ্ছেনা। বর্তমানে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে ইহা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য কিন্তু প্রতিটি পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসের দিকে তাকালে দেখা যায় সেখানে সুকৌশলে পৃষ্ঠা সংখ্যা কমিয়ে আনলেও প্রতিটি অধ্যায়ে অনুশীলনীমূলক কাজ দিয়ে সিলেবাসকে আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে! অনেকক্ষেত্রে প্রশ্ন পদ্ধতিতেও আনা হচ্ছে জটিলতা। এমন অনেক বিষয় সেখানে অন্তর্ভুক্ত, যা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্য হওয়া সমীচীন। বইগুলো আদৌ সুখপাঠ্য নয়, পড়ানোর মতো উপযুক্ত শিক্ষক খুবই স্বল্পসংখ্যক। ফলে মননশীল যেকোন তরুণকে তা আকর্ষণ করে না। যার ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীটি আর বিজ্ঞানমুখী হচ্ছেনা। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষা-নীতিতে বলা হয়েছে, 'বিজ্ঞানশিক্ষাই একটি জাতিকে দ্রুত তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে।' শিক্ষা-নীতিতে বিজ্ঞানশিক্ষার অগ্রগতির জন্য প্রাথমিকে চারটি, মাধ্যমিকে চারটি, উচ্চশিক্ষায় ছয়টি কৌশল নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু গত প্রায় তিন বছরে এসব কৌশলের কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি।

বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি যদি মনোযোগ দেওয়া না হয়, তাহলে অচিরেই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যত রকম প্রচেষ্টাই নেয়া হোক না কেন, বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দিলে তা কখনই সম্ভব হবে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে হলে বিজ্ঞান বিষয়কে আরও আকর্ষনীয় করতে হবে এবং বিজ্ঞানে চাকরির সুযোগ বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থী ও তরুণদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করতে চাইলে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে। তাদের স্বপ্ন দেখাতে হবে, উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তবে পরিসংখ্যান বলছে এই ক্রমাবনতির হার এখন আশংকাজনক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যা, একটি জাতির পঙ্গুত্বের পূর্বাভাষ। এই দুষ্টচক্র থেকে এখনই উত্তরণ না ঘটলে জাতির কপালে ঘোর অমানিশার অন্ধকার অবধারিত। তাই একজন বিজ্ঞান শিক্ষার্থী হিসাবে বিজ্ঞান শিক্ষার এ বেহাল দশার দ্রুত উন্নতি চাই।

মামুনুর রশিদ, বিজ্ঞান শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
mamunurrashidmiajee@gmail.com