প্রশ্নপত্র ফাঁস কি আর বন্ধ হবে না?

মামুনুর রশিদ
Published : 17 March 2017, 07:21 PM
Updated : 17 March 2017, 07:21 PM
একটি দেশকে উন্নতির স্বর্ণ-শিখরে পৌঁছাতে হলে, সেই দেশের শিক্ষার দিকে প্রথমে তাকাতে হয়। সে দেশটির জনগোষ্ঠীকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হয়। কাগজে কলমে শুধু শিক্ষার হার বৃদ্ধিই করলেই দেশ এগিয়ে যায়না বরং সুশিক্ষা ও স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এ কথাগুলো আমাদের চেয়ে আপনি আরও বেশি ভালো বুঝেন। গত কয়েক বছর যাবৎ এদেশের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সারাদেশে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। দেশের বিশাল একটি শিক্ষিত জনগণ বলেছিলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, দ্রুত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। এর বিপরীতে আপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী উত্তর দিলেন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, হচ্ছেনা ! সারাদেশে যখন এ নিয়ে আলোড়ন চলছে তখন মাননীয় মন্ত্রীর এহেন বক্তব্য এ দেশের শিক্ষিত সমাজকে হতাশ করে তোলে, এ দেশের শিক্ষিত সমাজ বারবার বলেছে মাননীয় মন্ত্রী প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, আপনি সজাগ হোন, প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের গ্রেফতার করুন। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী একে নিছক সাজেশন হিসাবে অ্যাখ্যায়িত করেছেন যা প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের একপ্রকার বাহবা দেওয়ার সমতুল্য।
অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল থেকে শুরু করে অনেকেই এ নিয়ে বিভিন্ন লেখালেখিও করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, তারপরেও বিশেষ অজ্ঞাত কারনে থেমে থাকেনি প্রশ্নপত্র ফাঁস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল সেই প্রশ্ন, যার ফলে শিক্ষার্থীরা রাত জেগে অনলাইনে প্রশ্নপত্র সংগ্রহে ব্যস্ত ছিল। এমন অনেক শিক্ষার্থীকে দেখেছি যারা শুধু প্রশ্নপত্র পেয়ে তারপর পড়ার টেবিলে বসতে গিয়েছে। শিক্ষাবিদরা সেসময় ধারণা করেছিল এর ভয়াবহ পরিণাম হবে। বর্তমান সময়ে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন এখন সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে! দু-এক বছর আগেও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে খুব সহজেই পাওয়া যেত। ঠিক এ বছরও এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে বলে পত্র-পত্রিকায় সংবাদ আসছে। ছোটকাল থেকেই এখন শিক্ষার্থীরা বুঝতে শুরু করেছে পড়াশুনা না করেও বিকল্প পদ্ধতিতেও ভালো ফলাফল করা যায়। শুধু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী নয় এখন প্রায় সব পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে এমন কথা অহরহ শুনা যাচ্ছে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য এখন আর শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করতে চায়না, তারা ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে ভালো ফলাফল করতে চায়। কিছুদিন আগেও এক শিক্ষার্থীকে পড়াতে গিয়ে দেখেছি, সে কিভাবে ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র হাতে পাবে সে ফন্দি খুঁজছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কোন পদ্ধতি থাকলে শিক্ষার্থীরা সে পথে পা বাড়াবে, সেটা আমাদের দেশের পেক্ষাপটে অনেকটাই স্বাভাবিক। যেখানে প্রাইমারী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, সেদেশের শিক্ষা কতটুকু অগ্রসর হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়।আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিকায়ন, পরিবর্ধন, পরিমার্জনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে চালানো হচ্ছে পরীক্ষামূলক নির্যাতন। এদেশে শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে যতবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে ততবার শিক্ষা নিয়ে ভাবা হয়েছে কিনা তাতে সন্দেহ রয়েছে! বলা হয়ে থাকে প্রকৃতিই মানুষের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় দেখা যায় প্রকৃতির কাছে যাওয়ার সুযোগই পায় না ছোট ছোট শিশু-কিশোররা। পিইসি, জেএসসির মতো অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে শিশুরা তাদের শৈশব-কৈশোর হারিয়ে ফেলছে, নষ্ট করে ফেলছে তাদের সৃজনশীলতা। সারাক্ষণ চার দেয়ালে বন্দি থেকে মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ হচ্ছে আমাদের আগামী দিনের স্বপ্ন। শিশুদের ওপর থেকে যতটা সম্ভব লেখাপড়ার চাপ কমাতে হবে। এ জন্য সময়ের কথা বিবেচনায় রেখে তাদের পাঠ্যপুস্তক তৈরি করতে হবে। বিশ্বাস করা কঠিন হলেও সত্য যে, সিলেবাস প্রণেতারা তরুণ শিক্ষার্থীদের বয়স ও সামর্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সিলেবাস প্রণয়ন করেননি। বর্তমান সিলেবাসে এসএসসির পদার্থ, রসায়ন, উচ্চতর গণিত এবং এইচএসসির পদার্থ, রসায়ন, জীব, উচ্চতর গণিত বিষয়ের সিলেবাসগুলো দেখলে মনে হচ্ছে, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েই একেকজন শিক্ষার্থীকে তাঁরা আইনস্টাইন, নিউটন বানাতে চান। এখনকার প্রতিটি পাঠ্যবইয়ের সিলেবাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে সুকৌশলে পৃষ্ঠা সংখ্যা কমিয়ে আনলেও প্রতিটি অধ্যায়ে অনুশীলনীমূলক কাজ দিয়ে সিলেবাসকে আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে! অনেকক্ষেত্রে প্রশ্ন পদ্ধতিতেও আনা হচ্ছে জটিলতা। এমন অনেক বিষয় সেখানে অন্তর্ভুক্ত, যা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্য হওয়া সমীচীন। একজন তরুণ শিক্ষার্থী যখন কোন একটি বিষয় সঠিকভাবে বুঝতে পারে না, পড়াশুনার মাঝে যখন সে আনন্দের পরিবর্তে বিশাল বোঝা খুঁজে পায় তখন সে আস্তে আস্তে ঐ বিষয় থেকে দূরে সরে যেতে চায়। বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দের পরিবর্তে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আনন্দহীন শিক্ষাব্যবস্থা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা যতদিন বন্ধ না হবে, ততদিন নেপালের রাজধানী নেপচুন হবে, পিথাগোরাস উপন্যাস লিখবেন, ২৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস হবে, নিউটন আপেল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবেন, অপারেশনের সময় লাইট জ্বালানোকে 'অপারেশন সার্চ লাইট' বলা হবে এবং 'আমি এ প্লাস পেয়েছি'র ইংরেজি 'আই অ্যাম এ প্লাস' হবে। বর্তমান সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে উঠেছে জিপিএ ফাইভমুখী। বাগাড়ম্বর আর ঢাক-ঢোলের বাদনে চাপা পড়েছে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং আকাঙ্ক্ষা। শিক্ষার হার বেড়েছে, বাড়ছে ডিগ্রিধারীর সংখ্যা। বেড়েছে অনেক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও। কিন্তু শিক্ষার এত বিস্তৃতির পরও পুরো সমাজ অমানবিক হয়ে উঠছে কেন? স্বার্থপরতা, সামপ্রদায়িক সহিংসতা, ধর্মান্ধতা, জঙ্গি কর্মকান্ডের মতো ভয়ঙ্কর অমানবিক অপরাধ কর্মকা- ক্রমশ বাড়ছে কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে সমাজ, রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থার রোগ নির্ণয় জরুরি।
একটি অসুস্থ ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় ভর করে পুরো জাতি আগামীতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে বিষয়ে এখনই পরিকল্পনা নির্দিষ্ট করা দরকার। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আসলেই ঢেলে সাজানো দরকার কিনা সে বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলার অধিকার আমরা কেউই রাখি না, যদি না সরকার সে কথা স্বীকার না করেন। কেননা প্রতিষ্ঠিত সরকারি পলিসির বিরুদ্ধে কথা বলা এক অর্থে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। কিন্তু কথা হলো সমাজে যেহেতু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও শুভঙ্করের ফাঁকি ধরা পড়েছে সেই বিষয়ে অবশ্যই সরকার প্রধান হিসাবে আপনার বিশেষ দৃষ্টি দেয়া দরকার। যদি জনগণের পর্যবেক্ষণই ঠিক হয় তাহলে সরকারের উচিত জনপ্রত্যাশা ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলিত সমস্যা সমাধান করা। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে পাঁচ বছরেই একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সম্ভব। এই জন্য লাগবে জনগণের যৌক্তিক পরামর্শ শোনার উদারতা আর সেই অনুযায়ী কাজ করার মানসিকতা। বর্তমানে যেভাবে শিক্ষাব্যবস্থা চলছে এই শিক্ষাব্যবস্থায় দেশের একজন মানুষও খুশি কিনা তাতে সন্দেহ রয়েছে। তবু আমাদের শিক্ষা চলছে এবং ভালো করেই চলছে। এই চলাকে বিজ্ঞাপনের জোরে চলা বলাই ভালো। বাজারে নতুন পণ্য এলে বিজ্ঞাপনের জোরে কিছু দিন তা চলে- তারপর ভালো না হলে আমজনতা সেই পণ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকেও মানুষ এখন মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে।
তাই এখনই যদি শিক্ষার প্রতি নজর দেয়া না হয়, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা না হয় তাহলে অচিরেই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যত রকম প্রচেষ্টাই নেয়া হোক না কেন, শিক্ষাক্ষেত্রে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দিলে তা কখনই সম্ভব হবে না। শিক্ষার মানের ক্রমাবনতির হার এখন এমনি আশঙ্কাজনক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, যা একটি জাতির পঙ্গুত্বের পূর্বাভাস। এ থেকে এখনই উত্তরণ না ঘটলে জাতির কপালে ঘোর অমানিশার অন্ধকার অবধারিত।

 

মামুনুর রশিদ
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
mamunurrashidmiajee@gmail.com