রেজা ফেরদৌস সোহান
Published : 11 Oct 2016, 07:40 AM
Updated : 11 Oct 2016, 07:40 AM

বাঘের পা ভাংলেও শিকার ভুলেনা। শিকারে তার পেশার চেয়ে নেশার দাবি বেশী থাকে। ভাঙ্গা পায়ে শিকার চলে অনবরত। এতক্ষনে হয়ত বুঝে গেছেন আমি কি বলতে চাচ্ছি। হ্যা ম্যস এর কথাই বলছিলাম। ৫ অক্টোবর ১৯৮৩ সালে নড়াইল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন মাশরাফি বিন মূর্তজা। কৌশিক নামেই তিনি এলাকায় সবার পরিচিত।

বাংলাদেশের অনূর্ধ-১৯ দলে খেলার সময় আক্রমণাত্নক এবং গতিময় বোলিং নজর কারে তৎকালীন অস্থায়ী বোলিং কোচ সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাস্ট বোলার অ্যান্ডি রবার্টসের। তাঁর পরামর্শে মাশরাফিকে বাংলাদেশ-এ দলে নেওয়া হয়। এবং বাংলাদেশ-এ দলের হয়ে মাত্র একটি ম্যাচ খেলেই জাত চিনিয়ে দেন তিনি। মাশরাফি জাতীয় দলে খেলার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান। ২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় মাশরাফির। একবার এক ইন্টারভিউতে মাসরাফি তুলে ধরেছিলেন তার অভিষেক অনুভুতির কথা। তিনি বলেছিলেন, "আমি জাতীয় দলে প্রথম সুযোগ পাই ২০০১ সালে। কিন্তু বাংলাদেশ কী, বাংলাদেশের হয়ে খেলাটা কী, সেসব বুঝি আরও পরে। ২০০৩ বিশ্বকাপে যখন আমি বলটা প্রথম ধরি, বল করতে পারছিলাম না। কাঁদছিলাম। সেই অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। বিশ্বকাপ হচ্ছে। বিশ্বকাপে আমি দেশের হয়ে বল করছি। অবিশ্বাস্য লাগছিল নিজের কাছেই। অথচ তার আগে দুই বছর জাতীয় দলে খেলেছি। আমি কিসের ভেতর আছি, সেই অনুভূতি এল দুই বছর পর! দক্ষিণ আফ্রিকায় দাঁড়িয়েও বুঝতে পারছিলাম বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষ টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে। সেই রোমাঞ্চ ভোলার নয়। উত্তেজনায় প্রথম বলটা ওয়াইডই করে বসেছিলাম বোধ হয়।" তার এই অনুভুতিই তাকে এতদুর টেনে এনেছে। একজন দেশ প্রেমিক যেখানেই থাকুক, যেভাবেই থাকুক ভিতরে দেশের মায়া হাতরায় তাকে সর্বক্ষন। তার মত অধিনায়ক আর কজন আছে এই পৃথিবিতে? ভালবাসা ছিল বলেই এতশত অর্জন আজ তার ঝুলিতে। এখন একটু জেনে নেই কজন অধিনায়ক আছে তার মত এই পৃথিবিতে। জেনে নেই কিছু অর্জন তার?

এক দিনের আন্তর্জাতিক(ওডিআই) খেলায় তিনি মোট ৩১ টি ম্যাচের অধিনায়কত্ব করে ২২ টি ম্যাচই জিতিয়েছেন আর পরাজয় হয়েছে মাত্র ৯ টি ম্যাচে। এর মাধ্যমে তিনি পৌছে গেছেন সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের তালিকার লিষ্টে চতুর্থ নম্বরে। ১৬৫ ম্যাচ খেলে উইকেট নিয়েছেন ২১৪ টি, রান করেছেন ১৪৯৫ টি। দলকে এনে দিয়েছেন চ্যাম্পিয়ান ট্রফি খেলার সুযোগ এবং বাছাই পর্ব না খেলেই সরাসরি বিশ্বকাপে অংশগ্রহনের সুযোগ।
এ নেতার অর্জন বর্ননায় সমাপ্তি হওয়ার নয়। তাই আর কোন অর্জনের বর্ননা নয়, এবার তার সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই।

১১ বার ইন্জুরিতে পরেও দলে ফিরে বাঘের মত খেলে যাওয়ার শক্তিটা কোথায় জানেন? প্রথম আলোর একটা ইন্টারভিউতে তিনি বলেছিলেন, "
টেলিভিশনে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস বা একুশে ফেব্রুয়ারির যেসব অনুষ্ঠান দেখায়, আমি সব দেখি। এগুলো তো অনেক পরে তৈরি করা জিনিস, তার পরও ওই সময়ের কথা মনে হলে আমার খারাপ লাগে। তাঁরা দেশের জন্য কী করে গেছেন আর আমরা কী করছি? তাঁদের জন্যই তো আমরা আজ অন্যের জুতা পরিষ্কার করছি না। ম্যাচ জিতলে সবাই বলে আমরা নাকি বীর। আসল বীর তো তাঁরা!
বারবার ইনজুরি থেকে ফিরে আসার প্রেরণাও পাই সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকেই। এমনও ম্যাচ গেছে আমি হয়তো চোটের কারণে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। দুই-তিনটা বল করেই বুঝতে পারছিলাম সমস্যা হচ্ছে। তখন তাঁদের স্মরণ করেছি। নিজেকে বলেছি, 'হাত-পায়ে গুলি লাগার পরও তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন কীভাবে? তোর তো একটা মাত্র লিগামেন্ট নেই! দৌড়া…।' দেশের পতাকা হাতে দেশের জন্য দৌড়ানোর গর্ব আর কিছুতেই নেই। পায়ে আরও হাজারটা অস্ত্রোপচার হোক, এই দৌড় থামাতে চাই না আমি।"

এই মানুষটার মধ্যে দেশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মত এক শক্তিশালি ক্ষমতা আছে। এই মানুষটাকে ঠেকাবে এমন শক্তি পৃথিবিতে নেই। মাশরাফি যখন হোচট খেয়ে পরে তখন বুকের মধ্যে মোচর দিয়ে ওঠে, কপালে ভাজ পরে। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রার্থনা করে তার জন্য। এইযে তার হোচট খাওয়াতে বুকের মধ্যে যে মোচর দিয়ে উঠেনা? এটা তারই অর্জন। তার এই অর্জনটার কারনেই তিনি এতবার ইন্জুরিতে পরেও সুস্থ ও সফল ভাবে শিকার করে চলেছেন। যে মানুষটার অসুস্থতায় লক্ষ কটি মানুষ প্রার্থনা করে তাকে ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা এই পৃথিবির কারো নাই। ইংল্যান্ডের ম্যচগুলোতেও বার বার হোচট খেয়ে পরছিল আমরা যারা বাইরে খেলা দেখছিলাম তাদের ভেতর হাহাকার শুরু হয়ে গেছিল। চিন্তা হচ্ছিল খুব। এই মানুষটারে ভালবাসি খুব। আর এই ভালবাসা পাওয়ার অর্জনটা তারই। তার সকল অর্জনের স্রেষ্ঠ অর্জন এটাই। এ অর্জন পৃথিবির কতজনেরইবা আছে? এ মানুষটার জন্য দোয়া রইলো। সৃষ্টিকর্তা তার সুস্থতা দান করুন।