মিরসরাই ট্র্যাজেডি: এখনও ঝরে স্বজনের চোখের জল

মুহাম্মদ দিদারুল আলম
Published : 11 July 2016, 05:25 AM
Updated : 11 July 2016, 05:25 AM

ট্র্যাজেডি। যে শব্দটি শুনলে আঁতকে উঠে এই জনপদের মানুষসহ দেশও বিশ্ববাসী। শব্দটির সাথে যারা ওতোপোতভাবে জড়িত তারা শব্দটি শুনলে অবিরাম কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এই জনপদের বিভীষিকাময়, বিষাদময় একটি অধ্যায়ের নাম মিরসরাই ট্র্যাজেডি।

১১ জুলাই ২০১১ সাল। এ দিনটি মিরসরাইবাসীর কাছে ছিল অত্যান্ত বেদনাদায়ক। সারা জীবন এ দিনটিকে ভূলতে পারবেনা মিরসরাইবাসী। কারণ ১১ জুলাই ঘটে যায় বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা মিরসরাই ট্র্যাজেডি। শুধু মিরসরাইয়ের আলোচিত ঘটনা নয়, এটি দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বেরও একটি আলোচিত ঘটনায় পরিণত হয়। আলোচিত ঘটনা হবেইনা বা কেন? একসাথে অকালেই ঝরে যায় ৪৫টি তাজা গোলাপ। যারা এক সময় গন্ধ বিলাতো দেশ ছাড়িয়ে হয়তো বিশ্বেরও কোন প্রান্তে। কিন্তু গন্ধ বিলানোর আগেই না ফেরার দেশে চলে যায়। পিতার কাঁধে ছিল পুত্রের লাশ, যা একজন পিতার জন্য সবচেয়ে ভারী বস্তু। ছিল মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর গগণবিদারী আত্মনাদ। কেঁদেছে সবাই, কান্না ছাড়া থাকতে পারেনি কেউ। গ্রামের পর গ্রাম পরিণত হয়েছে কবরের নগরীতে। কেউ কাউকে সান্তনা দেয়ার লোকও ছিলনা সে সময়। একটা সময় স্বজনহারাদের সান্তনা দিতে ছুটে এসেছেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ দেশ বিদেশের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। ছুটে এসেছেন দেশের নামকরা সাংবাদিকরা। ঘটনার সংবাদ প্রচার হয়েছিল দেশের সব ধরনের গনমাধ্যমে। সংবাদ প্রকাশ করেছে বিশ্বের আলোচিত সংবাদ মাধ্যম বিবিসি, আল জাজিরা, রেডিও তেহরান, ভয়েস অব আমেরিকাসহ অসংখ্য সংবাদ মাধ্যম। স্বজনহারা পরিবারগুলোর সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিতে দলমত, জাতি-গৌত্র নির্বিশেষে ছুটে এসেছেন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।

সেদিন যা ঘটেছিল :
দুপুরে মিরসরাই সদরের ষ্টেডিয়াম থেকে বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্ণামেন্টের খেলা দেখে বাড়ী ফেরার পথে বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়কের পশ্চিম সৈদালী এলাকায় তেতুলতলা নামক স্থানে সড়কের পার্শ্বের ডোবায় শিক্ষার্থী বহনকারী মিনিট্রাক পড়ে শিক্ষার্থীসহ ৪৫ জন মারা যায়। মুহুর্তেই পুরো এলাকা নয়, পুরো মিরসরাই নয়, সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। ঘোষণা করা হয় তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক।

ট্র্যাজেডিতে নিহতরা :
১১ জুলাই ঘটনাস্থলে নিহতরা হলো তাকিউল্ল্যাহ মাহমুদ সাকিব, আনন্দ চন্দ্র দাশ, নুর মোহাম্মদ রাহাত, জাহেদুল ইসলাম, তোফাজ্জল ইসলাম, লিটন চন্দ্র দাশ, আরিফুল ইসলাম, উজ্জল চন্দ্র নাথ, তারেক হোসেন, মোঃ সামছুদ্দিন, মেজবাহ উদ্দিন, ইমরান হোসেন ইমন, কাজল চন্দ্র নাথ, সূর্য চন্দ্র নাথ, ধ্রুব নাথ, সাজু কুমার দাশ, আবু সুফিয়ান সুজন, রুপন চন্দ্র নাথ, সামছুদ্দিন, আল মোবারক জুয়েল, ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, আমিন শরীফ, শরীফ উদ্দিন, সাখাওয়াত হোসেন, রাকিবুল ইসলাম চৌধুরী, কামরুল ইসলাম, সাখাওয়াত হোসেন, তারেক হোসেন, নয়ন শীল, জুয়েল বড়ুয়া, রায়হান উদ্দিন, এস এম রিয়াজ উদ্দিন, টিটু দাশ, রাজিব হোসেন, আশরাফ উদ্দিন, জিল্লুর রহমান, জাহেদুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, সাইদুল ইসলাম, আশরাফ উদ্দিন পনির, রায়হান উদ্দিন শুভ, মোঞ্জুর মোর্শেদ, সাখাওয়াত হোসেন নয়ন, আনোয়ার হোসেন, হরনাথ দাশ।

বাবার হাতে নির্মাণ হল স্মৃতি স্মারক 'আবেগ'!
ট্র্যাজেডিতে নিহত পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র আশরাফ উদ্দিন। বাবার থেকে চুরি করে খেলা দেখতে গিয়ে আর ঘরে ফেরেনি। প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে বাবা নিজাম উদ্দিন পাগল প্রায়। ছেলের স্মৃতিরক্ষার্থে আবুতোরাব বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মিত হবে স্মৃতি স্মারক 'আবেগ'। এখবর শুনে দৌড়ে গিয়েছিলেন স্কুল প্রধান শিক্ষক জাফর সাদেকের কা। দাবি 'ছেলে এবং ছেলের সহপাঠীদের জন্য তৈরি স্মৃতি স্মারক নির্মাণের কাজ তিনি নিজ হাতে করবেন'। অসহায় বাবার আকুতি মেনে নিয়ে তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হল নির্মাণের। স্মৃতি স্মারকের ডিজাইনার অধ্যাপক সাইফুল কবিরের তত্বাবধানে নিজাম উদ্দিন নিজে সন্তানের জন্য নিজ হাতে নির্মাণ করলেন স্মৃতি স্মারক 'আবেগ'।

আশরাফের বাবার তিন ছেলের মধ্যে আশরাফ ছিল সবার ছোট। আমার থেকে চুরি করে মিরসরাই স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাবে। ট্রাকে ছড়তেই বাবার চোখে চোখ পড়তেই মুছকি হেসে….। এ ছিল বাবার সাথে প্রিয় সন্তানের শেষ দেখা। খেলা দেখে বাড়ি ফিরেছিল নিথর একটি লাশ। প্রিয় সন্তানকে আর আদর দিতে পারেনি বাবা।

আশরাফ উদ্দিন পড়তো আবুতোরাব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। উপজেলার ১১ নম্বর মঘাদিয়া ইউনিয়নের মাষ্টার পাড়ার নিজাম মিস্ত্রি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করে সে। বাবা নিজাম উদ্দিন। মা রেহানা আক্তার। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে ছিল তৃতীয়।

স্মৃতিরক্ষার্থে দুর্ঘটনাস্থলে নির্মিত হয় 'অন্তিম' :
বৃত্তাকার বেদির ওপর স্থাপিত মূল স্তম্ভটির (অষ্টভুজ) উচ্চতা ২০ ফুট, তার চূড়ায় শিখা দুই দশমিক পাঁচ ফুট, তিন ধাপ বেদি দুই দশমিক পাঁচ ফুট এবং ভূমি থেকে সর্বমোট উচ্চতা ২৫ ফুট। মূল স্তম্ভকে ঘিরে এক থেকে পর্যায়ক্রমে সাত ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট সাতটি আয়তাকার পিলার সামনে থেকে একপাশ দিয়ে চলে গেছে। সপ্তম পিলারের ওপর থেকে উপ-বৃত্তাকার উড়াল পথে ছয় ধাপের একটি সিঁড়ি মূল স্তম্ভের মাঝামাঝি গিয়ে লেগেছে। ৫ নম্বর পিলারের ওপর থেকে একটি ভাঙা স্লেট মূল স্তম্ভের গায়ে হেলে আছে। মূল স্তম্ভের পাশে একটি আয়তাকার পিলার আছে যেটিতে নিহতদের তালিকা। এর উচ্চতা পাঁচ ফুট। বৃত্তাকার মূল বেদির তিনটি ধাপ। এগুলোর উচ্চতা যথাক্রমে ১১ দশমিক পাঁচ ফুট, ১৪ ফুট ও ২০ ফুট। তৃতীয় ধাপটির মাঝে বৃত্তাকার জলাধার। তৃতীয় বৃত্তাকার ধাপ থেকে তিন ধাপের সিঁড়ি নেমে আসে সংযোগ সড়কে।

দুর্ঘটনাটি যেহেতু অপরিসর একটি জলাশয়ে সংঘটিত হয়েছে, আর পানিতে কিছু নিক্ষিপ্ত হলে বৃত্তাকার ঢেউয়ে স্পন্দিত হয়, এ কারণে স্থাপনা কাঠামোটির নান্দনিক বিচারে বৃত্তাকার আবহ তৈরি করার কথা জানিয়েছেন শিল্পী সাইফুল কবীর।
তিনি বলেন, বৃত্তাকার বেদির মাঝখানে স্থাপিত মূল স্তম্ভটিকে শিক্ষা স্তম্ভ ও শিখাটিকে শিক্ষার আলো নির্দেশ করবে। তবে শিখাটি জ্বলবে না, কালো রাখা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, এখানে স্লেটটাকে শিক্ষার অন্যতম বাহন হিসেবে প্রতীকী ব্যবহার করা হয়েছে।'