ছোট বেলায় ভাই-বোনসহ আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে খুব ছক্কা খেলতাম। খেলায় পরাজিত হওয়ার জোর পূর্বাভাস পাওয়া মাত্রই ছুতো খুঁজতাম খেলা বানচালের। একটু সুযোগ পেলেই সব ডিসমিস। উল্টে দিতাম পুরো বোর্ড। খেলাও শেষ, আমিও হারলাম না। ক্যারামের সময়ও একই অবস্থা ছিলো। দুই দাগ ধরে মারেনি অভিযোগ তুলে সবগুলো কুটির উল্টে-পাল্টে দিতাম। খেলা শেষ।
বর্তমানে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার কথা মাথায় আসলেই আমার এই দুটো গল্প মনে পড়ে যায়। কি মিল, সাদৃশ্য! আইনের ৫৭ ধারাটিও মনে হয় ছুতো খুঁজে খেলা নষ্ট করে দেওয়ার মতই ব্যবহৃত হচ্ছে। যখন পরাজয় নিশ্চিত, তখন খেলা নষ্ট করতাম আমি। আর সবকিছু প্রমাণিত হওয়ার পর আর কোন পথ না পেয়ে হয়রানির উদ্দেশ্যে ৫৭ ধারায় মামলা করছেন বিশিষ্টজনরা।
গতকাল মঙ্গলবার মানিকগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বাদি হয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিজস্ব প্রতিবেদক গোলাম মুজতবা ধ্রুবর বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারায় মামলা করেছেন। ওই বিচারকের অভিযোগ, তাকে মোবাইল ফোনে হুমকি দেওয়ার অভিযোগও করেছেন। গত ১১ জুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে 'একটি অসুস্থ শিশু, বিচারকের ট্রাক ও একটি মামলা ….' শিরোনামে সংবাদটি প্রকাশিত হয়, যাতে বিচারক মাহবুবুর রহমানের বাড়ি বদলের ট্রাকের কারণে একটি অসুস্থ শিশুকে হাসপাতালে নেওয়ার পথ আটকে যাওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার এই মামলা দায়ের করা হয়।
(ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম)
প্রথমে প্রকাশিত সংবাদটি একটু বিশ্লেষণ করি। 'মানিকগঞ্জের এক জ্যেষ্ঠ সহকারী জজের বাড়ি বদলের জন্য রাখা ট্রাকে এক শিশুর হাসপাতালে যাওয়ার পথ আটকানোর প্রতিবাদ করায় শিশুটির মামাসহ দুজনের বিরুদ্ধে ওই বিচারক মামলা করিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।' এই সংবাদটিতে প্রতিবেদক নিজের কোন মতামত ব্যক্ত করেন নি।
ভুক্তভোগীদের কোড করেই পুরো প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে মামলার আসামিদের বরাত দিয়ে বলা হয়, বাসা বদলের সময় রাস্তা আটকে রাখায় শিশুটিকে হাসপাতালে নিতে ট্রাক সরাতে বললে উল্টো তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়।
বাসা বদলের সময় বিচারকের মালামাল বহনের জন্য রাখা ট্রাকটি সরাতে বলে হলে জানানো হয়, যতক্ষণ কাজ শেষ না হবে ততক্ষণ ট্রাক সরানো যাবে না। শিশুটিকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা বললেও বিচারক মাহবুবুর রহমান কোনো ব্যবস্থা নেননি বলে অভিযোগ করেন শিশুটির বাবা রেজাউল।
পুরো সংবাদে ভুক্তভোগী শিশুটির বাবা-মা, বিচারকের করা ওই মামলার আসামিদের এবং আইন মন্ত্রণালয়ের একজন সচিবের বক্তব্য নেওয়া হয়। বিচারকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে না পেলেও তার আগের বক্তব্য ছাপানো হয়েছিল।
এতে যদি কোন ভুল বা মিথ্যে তথ্য প্রচার করা হয় তবে এর দায়ভার বক্তব্যদাতাদের। আর এখানে বক্তব্য অবিকৃতভাবেই তুলে ধরা হয়ে বলেও প্রতিবেদক জানিয়েছেন। যদি এতে কোন মিথ্যে তথ্য দেওয়া হয় তবে এরর দায়ভার বক্তব্যদাতাদের। প্রতিবেদকের কোন দায়তো এখানে নেই। বিচারক চাইলে অন্যান্যদের বিরুদ্ধে আবারও আইনি ব্যবস্থা নিতে পারতেন। তিনি প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিলেন! হয়রানির উদ্দেশ্যে! ব্যক্তিগত ক্ষোভ মেঠানোর জন্য! হ্যা; ওই যে বললাম, ছুতো! সবকিছু ঠিক আছে কিন্তু খেলা নষ্ট করতে হবে। মহামান্য বিচারক আমার মতই যেন ৫৭ ধারায় খেলেছেন।
তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাটি নিয়ে দীর্ঘদিন বিতর্ক চলছে। এর আগেও একটি সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদক ইলেক্ট্রনিক পণ্যের বাজারজাতকরণ একটি প্রতিষ্ঠানের করা মামলায় এই ধারার স্বীকার হয়েছিলেন মাসখানেক আগে। এরপরও আইনের এই ধারাটি বাতিলের ব্যাপারে জোর দাবি ওঠে। আইনমন্ত্রীও এই ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছিলেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতায় আইনের এই ধারাটি বর্তমানে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করছেন সচেতন সমাজ। এটি জামিন অযোগ্য বলে আরও সমালোচিত হয়ে। এই ধারার মাধ্যমে কারো প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ মিঠিয়ে নেওয়া যাবে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।
বাতিল করা হোক ৫৭ ধারা। মুক্তি পাক গণমাধ্যম! দ্বার খুলুক মত প্রকাশের স্বাধীনতার।