চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক কি নতুন মাত্রায় পৌঁছুবে?

সাব্বির আহমেদ
Published : 7 Oct 2011, 07:32 AM
Updated : 13 Oct 2016, 01:24 PM

চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সফরে আসছেন। তাঁর এ সফর নিয়ে আলোচনা চলছে কূটনীতিক পাড়া থেকে শুরু করে সাধারণ জনপরিসরে; সংবাদমাধ্যমে তো বটেই। এর মধ্য দিয়ে দুদেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হবে– এমনটাই আশা করছেন সংশ্লিষ্ট সবাই।

ছয় বছরের মধ্যে এটা হবে শি জিনপিংয়ের দ্বিতীয় বাংলাদেশ সফর। এর আগে ২০১০ সালে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের মাত্র তিন মাসের মধ্যে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শি জিনপিংয়ের এ সফর হবে দ্বিতীয় কোনো চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর। এর আগে ১৯৮৬ সালে লি জিয়ানিয়ান প্রথম চীনা প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেন।

শি জিনপিংয়ের ২০১০ সালের সফরের তিন বছর পর চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেইয়াঙ বাংলাদেশ সফর করেন। ২০১৪ সালে তৃতীয় দফা সরকার গঠনের ছয় মাসের মধ্যে চীন সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার তিন মাসের মধ্যে তিনি প্রথম বিদেশ সফরে চীন গিয়েছিলেন এবং ২০০৯ সালে দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১০ সালের মার্চে চীন সফর করেন।

শেখ হাসিনার চীন সফরগুলো লক্ষ্য করলে চীনের প্রতি তাঁর আগ্রহের পরিমাণ বোঝা যায়। চীনা নেতাদের হাসিনার সরকারের সময়ের সফরগুলোর দিকে তাকালেও তাঁদের আগ্রহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

প্রাচীন 'দক্ষিণ সিল্ক রোড'এর মাধ্যমে চীন ও বাংলার মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো এ সম্পর্কের অনেক নিদর্শন বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। চীনের রাজকীয় দূত ঝাং কিয়ান, বৌদ্ধ পুরোহিত ফা জিয়ান এবং হু এন সাং বাংলা ভ্রমণ করেন পুরনো দক্ষিণ সিল্ক রোড ধরে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে শুরু করে খ্রিস্টাব্দ ২২১ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকা সিল্ক রোড চীনের ইউনান থেকে মিয়ানমার হয়ে চট্টগ্রামকে যুক্ত করেছিল। বাঙালি পুরোহিত অতীশ দীপঙ্কর চীনে যান ১০৩৪ সালে।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আরবদের মাধ্যমে পাওয়া জাহাজ প্রকৌশল, কম্পাস, সমুদ্র মানচিত্র চীনাদের আকৃষ্ট করে নিয়ে আসে বাংলায়। সোনারগাঁর সুলতান জিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৯০-১৪১২) মিং রাজা ঝু দির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। এ সময়ে দুই রাজ্যের মধ্যে শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ সম্পর্কের রেশ ধরে দুই পক্ষের মধ্যে অর্থনৈতিক লেনদেন চলে দীর্ঘকাল।

ব্রিটিশ আমলে চীনের সঙ্গে বাংলা তথা ভারতবর্ষের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এমনকি ব্রিটিশ ভারতত্যাগের পরও কিছুদিন পর্যন্ত চীনারা ভারত এবং পাকিস্তানকে ব্রিটিশদের 'হাতের পুতুল' হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক তৈরী হয় বাঙালিদের হাত ধরেই। এ সম্পর্কের গোঁড়ায় ছিলেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, মাওলানা ভাষানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আতাউর রহমান খান এবং প্রাদেশিক শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালে চীন সফর করেন। একই বছর চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই বাংলাদেশ সফর করেছেন। কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। শেখ মুজিব এর আগে ১৯৫২ সালেও চীন সফর করেছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্য স্থাপনের আকাঙ্ক্ষায় মধ্যপ্রাচ্যে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী নীতি কার্যকর করার চেষ্টা করে তখন সদ্য স্বাধীন ভারত ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবের কারণে ব্রিটেনের সহচর যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে ভারতীয় সমাজের সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণার অনুকূল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি আগ্রহী হয়ে তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত গড়ে। ভারতকে না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি মনোযোগী হয়। দীর্ঘকালীন আত্মনিমগ্ন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বৈরী মনোভাবাপন্ন চীন পাকিস্তানের হাত ধরেই একাত্তর সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। ইতিহাসে যা 'পিংপং ডিপ্লোম্যাসি' নামে পরিচিত।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন, বঙ্গবন্ধু হত্যার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়া এবং ভেটো দিয়ে জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ আটকে দেওয়ার কারণে চীনের সঙ্গে শেখ হাসিনার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শীতল সম্পর্ক প্রকাশ্যই ছিল। তবে এ কথাও স্মরণ করা দরকার যে চীন প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানের সামরিক আগ্রাসন পছন্দ করেনি। এপ্রিল মাসে আইয়ুব খানকে লেখা এক চিঠিতে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পরাপর্শ দিয়েছিলেন তৎকালীন চীনা প্রধান্মন্ত্রী চৌ এন লাই। পাকিস্তান সে পরামর্শ শোনেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে চীনের শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের সমর্থন থাকায় চীন আর অগ্রসর হয়নি।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু চেষ্টা করেন। প্রকাশ্য রাজনৈতিক আলোচনায় চীনের সমালোচনা না করা এর অন্যতম। চীনা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা কূটনীতিক কে এম কায়সারকে তিনি রেঙ্গুনে রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে সেখান থেকে তিনি চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তিনি চীনে বাণিজ্যিক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন এবং অনানুষ্ঠানিক পথে অর্থনৈতিক যোগাযোগ তৈরির চেষ্টা করেন। এসব প্রচেষ্টার প্রতিক্রিয়ায় চীন ধনাত্মক সাড়া দেয়; বাংলাদেশ নীতি তারা পরিবর্তন করে।

চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় চীন খাদ্য সাহায্য পাঠায়। ক্যান্টন বাণিজ্য মেলায় বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়। বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের সঙ্গে 'সিমলা চুক্তি' স্বাক্ষরিত হওয়ার পর চীন জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের বিরুদ্ধে দেওয়া ভেটো তুলে নিলে বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করে। এ ছাড়াও চীন তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যপদ অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে সাহায্য করে।

মাও সেতুংয়ের অনুসারী মাওলানা ভাসানী চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ভাসানী সমাজতান্ত্রিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করে আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে যান। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিগুলো ভাসানীর ছায়াতলে বাংলাদেশে রাজনীতি করার চেষ্টা করে।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়ে ভাসানীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং বাংলাদেশে দূতাবাস স্থাপন করে। স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের অবৈধ শাসনকালে চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। চীনের সঙ্গে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

পরবর্তী সময়ে এরশাদ এবং বেগম জিয়ার সরকার এই সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে; আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল থাকে। চীনের সঙ্গে একরকম বিশ্বাস ঘাতকতা করে বেগম জিয়ার বিএনপি-জামায়াত সরকার তাইওয়ানকে বাংলাদেশে কনস্যুলার সার্ভিসসহ একটা প্রতিনিধিত্বমূলক অফিস খোলার অনুমতি দেয়। এ ঘটনায় চীন বিএনপি-জামায়াতের চরিত্র অনুধাবন করতে সমর্থ হয়। বাংলাদেশ রাজনীতিতে তারা ধীরে ধীরে জামায়াত-বিএনপির প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করতে থাকে। যার প্রমাণ পাওয়া গেছে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের সময়।

১৯৯৩ সালে জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা চীন সফর করেন। এই সফরকে 'বরফগলা সফর' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার তিন মাসের মধ্যে প্রথম বিদেশ সফরে চীন গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এ দুই সফরের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সঙ্গে চীনা শাসক দল কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করে। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠনের সময় আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো অনেক বদলে গিয়েছে।

চীন আর আমেরিকার মধ্যকার সেই সুসম্পর্ক আর নেই। বরং তারা একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়েছে! সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে সেই নব্বই সালে; রাশিয়া এখন চীনের শত্রু নয়, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু। মনমোহন সিংয়ের প্রথম ভারত সরকার আমেরিকার সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা ইস্যুতে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করলেও তা ভালো ফল দেয়নি। তাঁর দ্বিতীয় সরকারের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক তিক্ততায় পর্যবসিত হয়; চীন আর ভারত 'ব্রিকস' গঠন করে অনেক কাছাকাছি চলে আসে।

চীন-ভারতের এই অবস্থান বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক হয়। শেখ হাসিনা এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে আমেরিকার বিরোধিতা নস্যাৎ করার কাজে পুরোপুরি লাগিয়েছেন। এ কাজে রাশিয়ার সমর্থন ছিল ষোলো আনা। শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে চীন বাংলাদেশে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে তার সমপরিমাণ আর কখনও করেনি।

১৯৭৫ সাল থেকে ২০০১ সালের মধ্যে, ২৬ বছরে বাংলাদেশে চীন বিনিয়োগ ছিল ৩০১ মিলিয়ন ডলার; ২০০২-০৯ সময়কালের ৭ বছরে ছিল ৩০৩ মিলিয়ন ডলার আর ২০১০-১৬ সময়ে অতীতের ধারাবাহিকতা ছাড়িয়ে তা দাঁড়ায় ৯১৬ মিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়ে চীনের অবস্থান মানবিক ছিল না। শেখ হাসিনা সরকার তা বিবেচনায় রেখেই চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে।

কূটনীতিতে 'চিরশত্রু' বা 'চিরবন্ধু' বলে কিছু নেই। শত্রুকে বন্ধুতে পরিণত করার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত কূটনৈতিক সার্থকতা। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তি বৃদ্ধি পায়। একই সার্থকতা তিনি অর্জন করেছেন সৌদি আরবের ক্ষেত্রেও।

উগ্র জাতীয়তাবাদী নরেন্দ্র মোদী ভারতের সরকার গঠনের পর চীন-ভারত সম্পর্ক আবার খানিকটা শিথিল হয়ে পড়ে; নাজুক অবস্থায় পড়ে বাংলাদেশ। ২০১০ সালের সফরের সময় শি জিনপিং প্রস্তাবিত সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর দুই বৃহৎ শক্তির ভূ-রাজনৈতিক খেলায় বাস্তবের আলো দেখতে পায় না। সোনাদিয়া বন্দর ছাড়া অন্য কোনো অবকাঠামো প্রকল্পে চীনের সহযোগিতা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারতের আপত্তি পরিলক্ষিত হয় না। চীন পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের দিকে বেশি ঝুঁকলে ভারতের অসুবিধা থাকার কারণ নেই।

বাংলাদেশকে শুধু সাবধান থাকতে হবে নিরাপত্তা সহযোগিতার ক্ষেত্রে। ভারতকে ঝুঁকিতে ফেলে চীনের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধির কোনো প্রয়োজনও নেই বাংলাদেশের। এ দিক থেকেও বাংলাদেশ রয়েছে সুবিধাজনক অবস্থানে।

২০১৫ সালে পাকিস্তান সফরের সময় রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং ৪৬ বিলয়ন ডলারের প্যাকেজ বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়ে এসেছেন। যার বেশির ভাগ ব্যয় হবে সুপারহাইওয়ে তৈরি করে চীনের 'ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড' প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য। আর্থ-সামাজিক এবং জঙ্গি পরিস্থিতির কারণে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কাজে লাগিয়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সামর্থ কমেছে পাকিস্তানের।

ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং চীনের সঙ্গে সড়ক পথে সংযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মধ্যমণি। ভারতের পূর্ব অংশ, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার এবং চীনের বেশ কিছু অংশের পণ্য পরিবহণের জন্য চট্টগ্রাম এবং পায়রাবন্দর বেশ উপযোগী।

অন্যদিকে টানা তিন দশক ধরে উচ্চহারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে চীনের শ্রমবাজার ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। কম মূল্যের শ্রমবাজারে তাদের শ্রমঘন কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন। পর্যাপ্ত দক্ষ, আধা-দক্ষ এবং অদক্ষ জনশক্তি সম্পন্ন বাংলাদেশ এই কারখানাগুলো স্থানান্তরের জন্য উপযুক্ত। এখানে রয়েছে উচ্চহারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান পণ্য চাহিদা, ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে ওঠা অবকাঠামো, স্থিতিশীল রাজনীতি। এসব কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নে চীন অধিক আগ্রহী।

তিন দশক ধরে জমা চীনের কয়েক ট্রিলয়ন ডলারের বেশির ভাগ অর্থ জমা রয়েছে আমেরিকা আর ইউরোপের রাষ্ট্রীয় বন্ডে, যা থেকে চীনের আয় হয় খুবই সামান্য; শূন্য শতাংশের কাছাকাছি। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ অধিক লাভজনক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। চীনের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনায় রেখে চীনা প্রেসিডেন্টের সফরের আগেই বাংলাদেশ কারখানা স্থানান্তরের জন্য এবং চীনা ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত করা শুরু করেছে 'বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল'।

চীনা রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য অবকাঠামো নির্মান প্রকল্পের বিরাট তালিকা প্রস্তুত রেখেছে বাংলাদেশ। যার অর্থমূল্য ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছে গণমাধ্যমগুলো। চীন সেসব প্রকল্পেই বিনিয়োগ করবে যা বাস্তবায়ণ করার সামর্থ রাখে বাংলাদেশ।

কত বড় অংকের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেল তা বড় কথা নয়। কত বেশি এবং কত দ্রুত তা কাজে লাগানো যাবে তার উপরেই নির্ভর করবে বাংলাদেশের এগিয়ে চলা। আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক যে অবস্থা বাংলাদেশে বিরাজ করছে তাকে এগিয়ে নিয়ে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য অবকাঠামোতে এবং শিল্পে বিনিয়োগ দরকার। এই দরকারি বিনিয়োগ করতেই আসছে চীন। চীনই হচ্ছে একমাত্র দেশ যার প্রয়োজন এবং সামর্থের সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যায় বাংলাদেশের প্রয়োজন।