চলমান পরিবহন ধর্মঘট কতটা যৌক্তিক?

নারায়ন সরকার
Published : 1 March 2017, 02:29 AM
Updated : 1 March 2017, 02:29 AM

দেশের কোটি কোটি মানুষকে চরম দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে পরিবহন ধর্মঘট চলছে। আসলেই কি এই আন্দোলনের কোন যৌক্তিকতা আছে? আমি মনে করি নেই। এই আন্দোলন শুধুমাত্র ক্ষমতার দাপট দেখানো একটি অত্যন্ত অন্যায় আন্দোলন। পরিবহন খাত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি অতি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, এটি বন্ধ থাকলে মানুষের তথা দেশের অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যায়। তাই মানুষের জীবনের বর্তমান এই স্পর্শকাতর বিষয়টিকে পুঁজি করে দেশের পরিবহন খাত বরাবরই তাদের অযৌক্তিক দাবী আদায় করে নিয়েছে। এই আন্দোলনকে অযৌক্তিক বলছি এই কারণে যে, এই আন্দোলন দেশের বিচার ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে করা হচ্ছে। এই আন্দোলন করা হচ্ছে, দুর্ঘটনার নামে অবাধে মানুষ খুন করার সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য। এই আন্দোলন করা হচ্ছে পরিবহন মালিক শ্রমিকদের বেপরোয়া আচরণকে অনুমোদন দেয়ার জন্য।

দেশে প্রতিদিন গড়ে ১০১৫ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। "গত ১৫ দিনে নিহত ১৫৩" সূত্র প্রথম আলো, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সংখ্যা। এক ঈদ মৌসুমেই সারা দেশে পাঁচসাতশ লোকের প্রাণহানি ঘটে শুধু সড়ক দুর্ঘটনায়। এত সব দুর্ঘটনার মুল কারণ শুধুমাত্র চালকদের বেপরোয়া আচরণ।

আমার পূর্বের একটি লেখার সূত্র ধরে বলছি, সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হলো বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো বা চালকের বেপরোয়া মনোভাব, মাত্রাতিরিক্ত গতি, মাত্রাতিরিক্ত ভার বহন, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, অদক্ষ চালক কর্তৃক যানবাহন চালনা বা প্রশিক্ষণ বিহীন চালক কর্তৃক গাড়ী চালনা, যানবাহন ঠিকঠাক ভাবে মেরামত না করা, ট্রাফিক আইনের প্রতি অবজ্ঞা, মাদক সেবন করে গাড়ী চালনা, উল্টো পথে গাড়ী চালানো, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, বিপদজনক ভাবে ওভারটেকিং ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং সেখানে আরো দেখেছি মারাত্মক দুর্ঘটনা গুলোর জন্য মূলতঃ দায়ী ভারি যানবাহন,  যেমন বাস ও ট্রাক।

চালকেরা ইচ্ছাকৃত নিয়ম ভঙ্গ করে বেপরোয়া ভাবে গাড়ী চালিয়ে ঠান্ডা মাথায় মানুষ খুন করবে আর দুর্ঘটনার নামে তার কোন বিচার হবে না? সেটা হতে পারে না। মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে রাস্তায় আসে, লাশ হয়ে ঘরে ফেরার জন্যে নয়। কাজেই রাস্তাকে অবশ্যই মানুষের জন্য নিরাপদ করতে হবে। আগেই বলেছি পরিবহণ খাত দেশের অর্থনীতির জন্য স্পর্শকাতর খাত তাই দেশের সরকারও বরাবর তাদের দাবির কাছে নত করেছে বলে কোন দুর্ঘটনার কোন দিন বিচার হয়নি। সম্প্রতি আদালত যে রায়টি দিয়েছে সে বিচারও হতো না যদি সেখানে দেশের গুণী চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর মারা না যেতেন। এ দুর্ঘটনাও অন্য হাজার হাজার দুর্ঘটনার মতো দুর্ঘটনাই হয়ে থাকত।

শ্রমিকের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রতি আমার আজন্ম লালিত দুর্বলতা আছে। তারপরও এই আন্দোলনের সাথে একাত্ম হতে পারছি না এই কারণে যে, এটা শ্রমিকদের কোন ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন নয়। কারণ সড়ক দুর্ঘটনা যে চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে ঘটে আমি নিজেই সেটার ভুক্তভোগী। ২০০৮ কি ২০০৯ সালের ঘটনা। আমি সেদিন নাইট কোচে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জে যাচ্ছিলাম। আশুগঞ্জের উজানভাটি হোটেল থেকে যাত্রা বিরতির পরে গাড়ী রওয়ানা দেয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই চালকের গাড়ী চালানো তেমন সুবিধাজনক লাগছিল না। আমরা যাত্রীরা বারবার তাকে ভালভাবে চালানোর অনুরোধ করছিলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা, কয়েকবার অন্য গাড়ীর সাথে মুখোমুখি ধাক্কা লাগতে লাগতে বেচে গেল। তারপরও চালকের কোন হুঁশ হচ্ছিল না। ভোরের দিকে সিলেট সুনামগঞ্জ সড়কের লামাকাজী ব্রীজের টোলে গাড়ী থামলে আমি নিজেই ড্রাইভারকে অনুরোধ করে বললাম, "ভাই একটু হাটাহাটি করে নেন" কিন্তু তিনি আমার কথায় কান না দিয়েই আবার গাড়ী চালাতে শুরু করলেন। এর ঠিক আধা ঘন্টাও পার হয়নি, জাউয়া বাজারের কিছুদুর আগে পুরো বাস উল্টে রাস্তার পাশে সটান গভীর খালে পড়ে গেল! ভাগ্যিস খালে পানি কম ছিল বলে পুরো বাসটি ডুবে যায় নি তাই আমরা কিছুটা আহত হয়ে বেচে গেছি। কিন্তু সেটা যদি কোন গাছের বা অন্য গাড়ীর সাথে ধাক্কা খেত বা খাল যদি গভীর হতো তাহলে? আমরা পঁচিশ ত্রিশ জন মানুষ সোজা যমালয়ে চলে যেতাম!

গত ২৩ তারিখ রাতে একটি বাসে খুলনায় গেছিলাম, সেখানেও ড্রাইভারদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে দুর্ঘটনায় পড়তে পড়তে বেচে গেছি। অথচ যাত্রীরা যখনই কিছু বলতে গেছে ড্রাইভার উল্টো যাত্রীদের উপর চড়াও হয়েছে।

গাড়ী চালনা একটা পেশা এবং সেটার সাথে মানুষের জানমালের প্রশ্ন জড়িত। কাজেই যারা এ পেশায় আসবেন তাদের অবশ্যই এই পেশার উপর পূর্ণ জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে আসতে হবে। তাদের অবশ্যই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে, মানুষের জানমালের প্রতি দরদ থাকতে হবে, জবাবদিহিতা থাকতে হবে কাজের প্রতি এবং পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে গাড়ী চালাতে হবে। যদি কেউ পেশাদারিত্ব নিতে ব্যর্থ হয় অবশ্যই তাকে এ কাজে নিয়োগ করা যাবে না। এজন্য অবশ্যই সংশ্লিষ্ট মালিকপক্ষ ও আইন প্রণয়নকারী সংস্থার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

দুর্ঘটনা অবশ্যই দুর্ঘটনা। কিন্তু পেশাদারিত্বের অভাবের কারণে, অসুস্থ মানসিকতার কারণে, দায়িত্বহীনতার কারণে, বা আইনের প্রতি অশ্রদ্ধার কারণে যে দুর্ঘটনা ঘটবে তাকে দুর্ঘটনা বলা যায় না। এ কারণে যদি প্রাণহানি ঘটে তা অবশ্যই খুন এবং সেটার খুনের মামলা হিসাবেই বিচার হওয়া উচিত।

যোগাযোগঃ ফেসবুক – Narayan Chakkra (http://facebook.com/narayan8747)