রন্ধন-ক্রন্দন-পোড়ন-পোড়ামন-আবাসন এসব নিয়ে প্রবাস জীবন

রেজাউল হক নাঈম
Published : 7 May 2017, 07:59 PM
Updated : 7 May 2017, 07:59 PM

আমার মা বলেন যারা বিদেশে থাকে, তাদের কলিজাটা নানা প্রতিকূলতার কারণে সমুদ্র পাড়ের মানুষের মতো অনেক পাষাণ হয়, কঠোর হয়। তাঁর অনেক যুক্তি আছে। সব যুক্তির পিছনেও অনেক যুক্তি আছে। বাঙালি পুরুষেরা দেশে থাকলে জীবনেও মনে হয় রান্না ঘরে একবারও যায় না। অ্যামেরিকানদের দেখলে মনে হয় আমাদের দেশের সব পুরুষেরা বুঝি অদৃশ্যভাবে খোঁড়া বা মাজুর। একদিন এক বেলা ভাত তরকারি রান্না তো দূরে থাক নিত্য নৈমিত্তিক এক কাপ চায়ের জন্যও মা-বোনের উপর নির্ভর করে ৯৯ ভাগ পুরুষ। আমার মা আমাকে প্রায়ই দেশে থাকতে বলতেন তোর হাতে এক কাচ চা বানিয়ে খাওয়া -অনেক আগের কথা। এই ফাঁকে অনেককে চা বানিয়ে খাইয়েছি, মাকে এখনো খাওয়ানো হয়নি।

বেশ কিছু দিন আগে কে জানি একজন আমায় বলেছে, বাঙালি ছেলেরা বিদেশে পড়াশোনা করতে গেলে তীরের মতো সোজা হয়ে যায়। বললাম কেন? এই দেশের কত সুযোগ-আরামে আয়েশে, তারপরও তরকারিতে নুন একটু বেশি হলে মা-বোনের উপর কী রাগ! লাউ-চিংড়িতে এতো ঝাল দিলে কেনো- এই বলে বড় ভাবিকে কি না চোখ লাল-অমানুষের মতো। পুরুষদের রান্নায় বারণ। সবই সমাজের সৃষ্টি। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী হয়ে দুয়েক জীবনে রান্না করতে হয়।

আমেরিকায় রহমত ভাই, রহিম-রহিমা আপা-খালারা কেউ নাই। এদেশের প্রেসিডেন্ট ও জীবনে অসংখ্যবার রান্নাবান্না করেন। এমপি-মন্ত্রীরা ও রান্না করে খান। বাসার ময়লা কাজের মেয়ে গিয়ে নিচে ফেলে আসেনা। সকালে কাজে যাবার সময় হাতে করে ময়লা ফেলতে হয়। কতো কষ্ট করে রান্না শিখতে হয় আমাদের বিদেশ এসে। নুন কম হলে- হলুদ বেশি, হলুদ ঠিক হলে আবার ঝাল বেশি, মাঝে মাঝে তো নুনের জায়গায় চিনিও চলে যায়। তারপরও দিব্যি মজা করে খাই-নিজের রান্না বলে কথা। দোষ দেবার মতো পাশে যে কেউ নাই।
যেদিন ল্যাবে রিয়েকশন কাজ করে, সেদিন রান্নাটাও ভালো হয়। কিন্তু আর বাকী সময় খাবারে অরুচি লেগেই থাকে। তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকি কেউ যদি এক বেলা দাওয়াত দিয়ে একটু খাওয়ায়। দাওয়াত দেয় ঠিকই অনেক দীর্ঘ বিরতিতে-ততোদিনে দেখা দেয় নতুন রোগ-ক্ষুধা-মন্দা।

আবার মাঝে মাঝে কষ্ট লাগে যখন দেখি আশে পাশের বাঙালি বাসায় বিবাহিতদের জমপেশ পার্টি হচ্ছে-ব্যাচেলর হওয়ায় আমি বা আমরা নেই। চটাং চটাং খাবারের সাথে সেলফি ফেসবুকের ফিডে চলে আসছে। তখন প্রচন্ড রাগ হয়-মন চায় সর্প হয়ে এপাড়ার সব বিবাহিতদের দংশন করি।

কদিন আগের কথা, শখ করে শিকাগো থেকে এনেছি কচি খাসির রানের মাংস। ল্যাব থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে মাংস চুলোয় দিয়ে জানালা দিয়ে গাছে কাঠবিড়ালির খেলা দেখতে দেখতে কখন যে ঘুম চলে এসে-স্বপ্নে ভেসে বেড়াচ্ছি-বুঝিইনি। স্বপ্নে দেখছি-কার বাসায় ডিনারের দাওয়াত দিয়েছে- সব মাংশ পুড়ে ফেলেছে-পোড়া মাংশের গন্ধে অতিথিরা সব ফিরে যাচ্ছে-আর আমি নাক চেপে ধরে আছি-হঠাৎ ফায়ার এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে দেখি-ধোয়াশাচ্ছন্ন ঘরে খাসি পোড়া গন্ধ আমার ঘরেই।

অত:পর ডিম-ভাজি দিয়ে খেতে খেতে ভাবছি –আজ ডিম দিয়েই না হয় খেলাম-খাসি আরেকদিন খাবো।