বাংলাদেশে ইসলাম কোন পথে যাওয়া উচিৎ এবং কোন পথে যাচ্ছে

নাঈম বিশ্বাস
Published : 6 April 2017, 02:02 AM
Updated : 6 April 2017, 02:02 AM

ধর্ম নিয়ে এদেশে কথা বলাটা খানিকটা বিব্রতকর, কেননা মাথামোটা এক বইয়ের পাঠকেরা হুট করে উদয় হয়ে যুক্তিহীন আলোচনায় মেতে উঠবেন। কিন্তু গণতন্ত্রের সমীকরণে ধর্মের প্রভাব অস্বীকার করাটা বোকামি, এইটার ব্যবহার আফিমের মতো করলে এদেশে ক্ষমতায় যাওয়া সহজ, কেননা সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতেই সিংহাসনের চাবি। পাশের ভারতে বিজেপি আর পাকিস্তানে মুসলিম লীগের শাসন এ অঞ্চলে জাতিয়তাবাদের কাঠামো যে ধর্মভিত্তিক হয়ে উঠেছে সে ইঙ্গিত স্পষ্ট করে দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের উত্থানের ঢেউ যে আমেরিকা জার্মানি ফ্রান্সকে ভাসিয়ে বাঙাল মুলুকে আঘাত হানবে না এই আশা করাটা ঝড়ের মুখে চোখ বন্ধ করে শারদপ্রাত স্বপ্ন দেখার মতো।

আমি ধর্ম বা ধর্মের বিভিন্ন ভগ্নাংশের বিচার করি তার ব্যবহারকারীদের দিকে তাকিয়ে, কেননা তত্ত্বের তর্কে এই বিষয়ে সমাধানে পৌঁছানো কঠিন। এইযে ধরুন আপনারা যারা নিয়মিত খবরের পাঠক, মনে করার চেষ্টা করুন তো শেষ কবে কোন শিয়া আত্নঘাতী বোমা হামলার খবর পড়েছিলেন? আমি এমন একটা তথ্যও মনে করতে পারছি না। ইসলামিক ফিলোসফি অপরাপর ধর্মীয় ফিলোসফিগুলোর চেয়ে ধনী, আমার কাছে এমনটাই মনে হয়েছে খুচরো পড়াশোনার পর। বিষয়টা আলোর তত্ত্বগুলোর মতো, ইসলামকে এখনে কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাথে মেলানো যায়, আলোর সবগুলো ধর্ম ব্যাখ্যা করতে না পারলেও কোয়ান্টাম তত্ত্ব সবচে বেশি আচরণ ব্যাখ্যা করতে পারে আলোর। কিন্তু ইসলামিক ফিলোসফির যে অংশটা নিয়ে আমরা গর্ব করছি সে অংশটার জন্মভূমি পারস্য, আরব নয়।

আপনারা যারা কিংডম অব হ্যাভেন সিনেমাটা দেখেছেন তারা সম্ভবত সালাউদ্দিন আইউবির চরিত্রটা মনে রেখেছেন। ক্রুসেডের ইতিহাস নিয়ে যদি ঘাঁটেন তবে দেখবেন পুরো ইতিহাসে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠতম বীরদের মধ্যেও ইনি শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। এই ভদ্রলোক একজন কুর্দি। তারপর আসেন বিজ্ঞানে, আপনি যতজন মুসলিম বিজ্ঞানীর নাম জানেন সেই বিজ্ঞানীদের নাম গুগল করলে দেখবেন তাদের অধিকাংশ শিয়া, কিংবা সুন্নীবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ধারার। বর্তমান কালের বিজ্ঞানভিত্তিক যে কয়টা জনপ্রিয় বৈশ্বিক জার্নাল প্রকাশিত হয় সেখানে যে গুটিকয়েক মুসলিম বিজ্ঞানী নিয়মিত লেখেন তাদের দিকে তাকালে দেখবেন ইনারা প্রায় পুরোটাই ইরানের বাসিন্দা। সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই দখলটা আরো বেশি একপেশে, ফারসি ও উর্দু সাহিত্যে সুন্নী সাহিত্যিক আপনাকে হারিকেন দিয়ে খুঁজতে হবে, লিট্রেলি হারিকেন দিয়ে খুঁজতে হবে। শিয়াদের ধর্মমত যেখানে সুন্নীদের তুলনায় অনেক বেশি সহনশীল সেখানে পশ্চিমের সমর্থন কিন্তু সুন্নীদের দিকে, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে ইনার সন্ত্রাসবাদী ওয়াহাবী ইসলামের মূল পৃষ্ঠপোষক।

মধ্যপ্রাচ্যের এই সঙ্কটকালে কোন দেশটি সবচে বেশি অভিবাসী গ্রহণ করেছে জানেন? আরব বিশ্বের সবচে গরীব দেশ ইয়েমেন, সোমালিয় ও সিরিয় মিলিয়ে এই সংখ্যাটা প্রায় দুই লাখের বেশি, আর এই দেশটাতেই শিয়া-সুন্নী কনফ্লিক্টে সৌদি-মার্কিন বাহিনী নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করছে শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে, যে অঞ্চলগুলোতে অভিবাসীর সংখ্যাও সবচে বেশি, অথচ বিশ্বমিডিয়া পুরোপুরি চোখ সরিয়ে নিয়েছে এখান থেকে। আইএসের তুলনায় কয়েকশোগুণ বেশি মানুষ হত্যা করে বোকো হারাম, এই জঙ্গীগোষ্ঠী আফ্রিকা বেইজড ও তাদের টার্গেট কালো মানুষ হওয়াতে বোকো হারাম নিয়েও সম্ভবত মিডিয়া বা শান্তি ও গণতন্ত্রের বিক্রেতাদের কোন মাথাব্যথা নেই।

উপমহাদেশে ইসলামের আগমন মূলত সূফী-সাধকদের হাত ধরে। এই যে মুঘলেরা যে এত শতাব্দী শাসন করলো, ইনারা কিন্তু শিয়া সুন্নীর ঘোলাটে এক মিশ্রণ, আকবর তো নিজেই এক ধর্ম দিয়ে বসেছিলেন। বিগত দুই শতাব্দীকালে এই অঞ্চলে সুন্নীবাদের বিস্তার হয়েছে। কিন্তু এই সুন্নীবাদে সন্ত্রাসের কলঙ্ক লেপে দেওয়াটা কঠিন, সাতটি প্রধান তরিকার অনুসারীরা প্রায় কেউই সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত নন এবং এই তরিকাগুলো সন্ত্রাসবাদ উস্কে দেয় না কিছুতেই। আমি চিশতিয়া-ছাবেরিয়া তরিকার সাথে বিশেষভাবে পরিচিত, এইটা খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর তরিকার আরেকটু উন্নততর ভার্সন, চিশতীর অন্যতম প্রিয় শিষ্য ছাবেরিয়া সাহেবের গড়া। এই তরিকা আমাদের অঞ্চলে বিস্তার করেছেন যিনি, আমার বাবার পীর সাহেব মানিকগঞ্জের মরহুম অধ্যাপক ড.আজহারুল ইসলাম সিদ্দীকি সাহেব (ইউটিউবে সার্চ করলে বেশ কিছু ডকুমেন্ট পাবেন ইনার), এই ভদ্রলোক মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিজের জীবন বাজি রেখে অত্র অঞ্চলের হিন্দুদের নিরাপত্তা বিধান করেছেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন। ইনার লেখা প্রায় সমস্ত বই আমি পড়েছি, মারেফাতের ভেদতত্ত্ব নামের বইটা আমাকে সবচে আকৃষ্ট করেছে, অসম্ভব জ্ঞানী একজন মানুষ ছিলেন ইনি। অবশ্য বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ইসলামকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে 'মহাভাবনা' নামের একটা বই লিখেছেন ইনি, এইটাতে প্রচুর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যের বিকৃত উপস্থাপনা আছে, এবং এটাকে একটা ব্যর্থ বই মনে হয়েছে আমার, যদিও উনার লেখাগুলোর মধ্যে এটাই সবচে জনপ্রিয়। সে যাই হোক, ইনি বা এই ঘারানার লোকেরা যে ইসলামের চর্চা করেন সেটাকে আমি গান্ধীবাদী ইসলাম বলি, খানিকটা বৌদ্ধিক ইসলামও বলা যায়, ইনাদের হাত থেকে মানুষ তো দূরের কথা প্রাণীজগতের কারো সামান্যতম ক্ষতি হতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। এইযে গাউস পীর কুতুব আউলিয়াদের প্রচারিত যে ইসলাম প্রায় হাজার বছর ধরে এই ভূখন্ডে রাজত্ব করছে এবং অধিকাংশ সময় মানবতার জয়গান গেয়েছে সেটাকে হুমকিতে ফেলেছে সালাফি-ওয়াহাবী মতাদর্শের সৌদি থেকে আমদানিকৃত উগ্র সুন্নী মতাদর্শ। আর জামাতি মওদূদীবাদ তো একই মায়ের অন্য সন্তান, দূর্যোধনের আরেক ভাই দুঃশাসন।

পাকিস্তানে জঙ্গীবাদের বিস্তারের ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখবেন বিস্তারটা মূলত ঘটেছে জেনারেল জিয়াউল হকের আমলে, যে আমলে পাকিস্তানজুড়ে আরব অর্থায়নে মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো। এই মাদ্রাসাগুলো ক্রমেই জঙ্গীবাদের প্রচার প্রসার ও প্রশিক্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আমাদের এদেশে আশঙ্কার যে জায়গাটা সেটা হচ্ছে নব্বই থেকে দুহাজার ছয় পর্যন্ত সারাদেশে যে পরিমাণ মাদ্রাসা স্থাপন হয়েছে, তা একই সময়ে স্থাপিত হাইস্কুলের সংখ্যার প্রায় চৌদ্দগুণ। এবং দুটো প্রধান রাজনৈতিক দলই এই সময়ে ক্ষমতায় ছিলো, এই প্রক্রিয়াটার বিরোধিতা কেউ করেনি। এখন যারা হেফাজতের সমাবেশে এত এত লোক দেখে আশ্চর্য হচ্ছেন, এই ছেলেপেলেগুলো যে আকাশ থেকে নাজিল হচ্ছেনা সেটা একটু মাদ্রাসার বিস্তারের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। আর যেসব লোকজন ইসলামকে সন্ত্রাসের ধর্ম বলে প্রচার করছেন তারা সম্ভবত ওয়াহাবি-সালাফি-মওদুদীবাদী ইসলামের বাইরে অন্য ঘরানার ইসলামের সাথে পরিচিত নন, কিংবা ইসলামের সাথে জঙ্গীবাদকে মিশিয়ে একটা বিশেষ ব্লকের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের ধান্দায় আছেন।

একটু লক্ষ্য করে দেখবেন যে এই সালাফি-ওয়াহাবিদের মূল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু কারা। এদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু এই দেশের তরিকাপন্থী লোকজন, বিভিন্ন মাজার, বাউল সম্প্রদায় ও লেখক-শিল্পীগোষ্ঠী। নিজেদের উদ্ভাবিত বিশেষ আইনের বলে ওয়াহাবি মতাদর্শের আলেমগণ যে কাউকে কাফের মুনাফিক ফতোয়া দিয়ে বসেন। কিছুদিন আগে লালনের ভক্তদের উপর যে ক্রমাগত হামলা করলো হেফাজত, এইযে কদিন আগে দিনাজপুরের একজন পীরকে খুন করা হলো, হামলা করা হলো ভোলার হাক্কানি মিশনে, গুঁড়িয়ে দেওয়া হলে কয়েকটা সূফীখানকা, এগুলো এখন বাড়বে, কেননা এই লোকগুলোই এই ভূখন্ডে জঙ্গীবাদ বিস্তারের মূল অন্তরায়।

ধরুন যে সত্তরের দশকের শেষাংশে জামাতি ভাবধারার মোল্লারা কাকে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে মুনাফিক ও কাফের আখ্যা দিলেন? ভাসানী সাহেবকে, শেখ মুজিব ইনাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও আদর্শিক লড়াইয়ে ইনাদের মূল অন্তরায় ছিলেন ওই লাল মাওলানা। ইনারা কিছুতেই নিজস্ব (ইনাদের নিজস্ব নয়, সৌদি আরব থেকে রপ্তানিকৃত) ব্যাখ্যার বাইরে ধর্মের যে ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে সেটা মানবেন না, কেউ বাইরে গেলেই মুরতাদ ঘোষিত হবে।

দেখুন, এই রাষ্ট্রে ধর্ম একটা ভয়ানক সেনসিটিভ ইস্যু, এটাকে ঠিকভাবে ডিল করতে না পারলে ফসল জঙ্গীবাদের উঠোনেই যাবে। তাই আমাদের সবচে সেরা যে মূলধনটা আছে রাজনৈতিক ও সন্ত্রাসবাদী ইসলামের বিপক্ষে, সেই সুফি ঘরনার ইসলামের প্রচার প্রসার ও নিরাপত্তা বিধানের এখনই সময়।

এখন আমরা যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলছি, আমাদের এইসব গাউস পীর আউলিয়া বাউলদের পক্ষে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। এইসব পীর ও বাউলরা যদি আমাদের সাহায্য না পায় তবে পরবর্তীতে আমরাও কারো সাহায্য পাবো না, কেননা হেফাজতি মতাদর্শের আরব রপ্তানিকৃত ইসলামের তথাকথিত শুদ্ধরূপ শেষমেশ আমাদের সকলের গলা টিপে ধরবে, কোর্টের সামনে থেকে মূর্তি অপসারণ বা বিচারপতিদের তালিকা থেকে নারী অপসারণ ইত্যাদি দাবী কিংবা লালন ফকিরের ভক্তদের আক্রমণ কেবল শুরুমাত্র।

পাকিস্তানের শেহওয়ান নগরের লাল শাহবাজ কালান্দার দরগাহে গত ষোলো ফেব্রুয়ারি আইএস আত্নঘাতী হামলা চালিয়ে আটাশিজন ভক্তবৃন্দকে খুন করে, ইনাদের অপরাধ ইনারা নারী-পুরুষ একত্রে দরগাহে নাচেন, ঈশ্বরের স্থানে মানবকে বসিয়ে শিরক করেন এবং ধর্মের নামে হত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ধর্মের ভিত্তিতে মানবতা ও শান্তির জয়গান গান। টিভিতে ধ্বংসস্তূপ ও মৃতদেহ দেখার পর থেকে আমি যতবার দামাদাম মাস্ত কালান্দার গানটা শুনেছি ততবার আমার কান্না পেয়েছে। আমির খসরুর লেখা মূল গানটা সংস্কার করেই বর্তমান রুপটা গাওয়া হয় এই গানের, সাম্প্রতিক অতীতের ভার্সনগুলোতে আলী দ্যা পেয়লা নাম্বার লাইনটা পাওয়া যায় না, শুনেছি লাইনটা নিষিদ্ধ করে নাকি ফতোয়া দেওয়া হয়েছে, আমার অবশ্য রুনা লায়লার ভার্সনটা ভাল লাগে সবচে বেশি, সেখানে আলীকে প্রথম বানানো রাজনৈতিক স্টেটমেন্টটাও আছে।

আমির খসরুর মতো কত হাজারো শ্রোতা যে কতবার নিজেকে এই দরগাহে সর্বদা জ্বলন্ত চারটে মশালের পর পঞ্চম মশাল হিসেবে জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছি, কতবার আলী আলী বলে চিৎকার করতে চেয়েছে এই গানটা শোনার পর সে হিসেবটা আমরা জানি না, তবে সংখ্যাটা বেশ বড় বলেই অনুমান করা যায়। অথচ কি বিভৎস উপায়ে এই মানুষগুলোকে হত্যা করা হলো! কত সহস্র উপায়ে চেষ্টা চলছে এই মানুষগুলোকে থামিয়ে দেবার! অবশ্য শাহবাজ কালান্দারের ভক্তরাও উচিত জবাব দিয়েছে আইএসের বিকৃতমস্তিষ্কের যোদ্ধা ও তাদের মদদদাতাদের, হত্যাকান্ডের পরেও বন্ধ হয়নি সূফিসঙ্গীতের সাথে সান্ধ্য বাউলনাচের রেওয়াজ। এই নাচ চলবে, এই নাচ ঠেকাবে ঘৃণা ও হত্যার মিছিল, সেই জালালুদ্দীন রুমি থেকে আমাদের আঞ্চলিক বাউল রশীদ সরকারের দেহে এই নাচের তাল অঙ্কিত আছে, এই নাচ চলবেই….