জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষে দাঁড়ান

নাঈম বিশ্বাস
Published : 11 July 2017, 06:55 PM
Updated : 11 July 2017, 06:55 PM

মে মাসের সাতাশ তারিখ মাঝরাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেয়াল্লিশজন শিক্ষার্থীকে ভিসি'র বাসার প্রাঙ্গন থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। এই বেয়াল্লিশজনের মধ্যে বারোজন ছিলো নারী শিক্ষার্থী, উল্লেখ্য যে জাহাঙ্গীরনগরের ভিসি বাংলাদেশের প্রথম নারী ভিসি। যে অপরাধে তিনি এই শিক্ষার্থীদের মাঝরাতে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন সে অপরাধটি হলো এই ছাত্রছাত্রীরা তাকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলো পুলিশ কেন বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনার ভেতর ছাত্রদের উপর হামলা করলো, এই প্রশ্ন করাই তাদের অপরাধ।

দুজন শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাবার পর বিশ্ববিদ্যালয় তড়িঘড়ি করে তাদের লাশ বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে, ছাত্ররা তাদের বন্ধুর জানাজা পড়তে চেয়েছিলো, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাসের আঙ্গিনায় নিহত ছাত্রের জানাজার নামাজ পড়তে দেয়নি নিরাপত্তার অজুহাতে, ক্ষুব্ধ ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঢাকা আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে। এই অবরোধে তারা এই রাস্তায় পুলিশি টহল বসানো, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, গাড়ির গতিসীমা বেঁধে দেওয়া, স্পিড ব্রেকার স্থাপন এবং প্রান্তিক গেইটে ফুট ওভারব্রিজ নির্মানের দাবি জানায়। সেই সাথে নিহত দুই শিক্ষার্থীর পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ, তাদের পরিবারের কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া এবং ঘাতক বাসকে দ্রুততম সময়ে চিহ্নিত করার দাবিও অবরোধকারীদের দাবির অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

এই অহিংস ও শান্তিপূর্ণ অবরোধে পুলিশ হামলা করে, গুলি চালায় শিক্ষার্থীদের উপর, গুলি চালায় কর্মরত সাংবাদিকের উপর, টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট বৃষ্টির মতো এসে পড়তে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনার ভেতরে আশ্রয় নেওয়া শিক্ষার্থীদের উপর, মারাত্মকভাবে আহত হয় বেশ কজন শিক্ষার্থী। ভিসি রাস্তা ছেড়ে আসতে ছাত্রদের পনের মিনিট সময় দিয়েছিলেন, অথচ পুলিশগুলি চালায় ঠিক আড়াই মিনিটের মাথায়। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ভিসির বাসায় গিয়ে তার কাছে এই হামলার কারণ জানতে চায়, আসবো আসবো বলে ভিসি ছাত্রদের সাড়ে ছয় ঘন্টা বসিয়ে রাখেন, এবং অবশেষে আবারো পুলিশ এসে ঘিরে ধরে ছাত্রদের, ভিসির নির্দেশক্রমে ছাত্রদের মারতে মারতে কালো কাঁচে ঘেরা গাড়িতে তোলে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাদী হয়ে ছাত্রদের নামে ভাঙচুর ও হত্যাচেষ্টাসহ দশটি ধারায় মামলা দায়ের করে, আদালত পরদিন ছাত্রদের জামিন দেয়। কয়েকটি আলটিমেটাম দেবার পরেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নামে দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করেনি, উপরন্তু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পরিবারকে নানাবিধ পুলিশি ও সামাজিক হয়রানির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে, মামলার আসামীদের পরিবারের নিকট হতে ভয়ভীতি প্রদর্শনপূর্বক মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় স্থানীয় পুলিশ। এই ভোগান্তির মধ্যেই ঈদ পালন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসে মামলার আসামী শিক্ষার্থীরা, চার জুলাই আবার আদালতে গিয়ে হাজিরা দেয়। আদালত আগামী মাসের সাত তারিখে আবার তাদের হাজিরার সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা, গবেষণা ও ফাইনাল পরীক্ষা কিছুতেই মনোযোগী হতে পারছেন না এই মামলার ভোগান্তিতে, তাদের একাডেমিক জীবন ভীষণভাবে বিপর্যস্ত। মামলার সাথে আবার যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি নামক প্রহসন যেখানে যারা মামলা দায়ের করেছেন তারাই বিচারক সেজে বসে আছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় খুলবার পর ছাত্রদের পক্ষে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন স্থানে এই শিক্ষার্থীদের পক্ষে মানববন্ধন হয়েছে, বিশিষ্টজনেরা বিবৃতি দিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ এই ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। ইতিমধ্যে ফেসবুক ও টুইটারে '#মুক্তির_মিছিলে' বেশ আলোড়ন তুলেছে যা 'প্রতিবাদের নাম জাহাঙ্গীরনগর' ব্যানারে সংগঠিত হওয়া আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান জানাচ্ছে, প্রতিদিন নতুন নতুন লোক হ্যাশট্যাগটি ব্যবহার করছে। ছাত্রদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের দাবি ইতিমধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই করেছেন উচ্চকন্ঠে, নতুন নতুন মুখ প্রতিদিন বাড়ছে মিছিলে এই দাবিতে, অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যাদের বোধহীন দাস বলাই শ্রেয়, কানে তালা দিয়ে বসে আছেন, ছাত্রদের নব্য নব্য ভোগান্তিতে ফেলার ছক কষছেন। কিন্তু ছাত্ররা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে প্রশাসনের এই স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের বদৌলতে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অচলাবস্থা তৈরি হয় তবে সে দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে একসাথে এতগুলো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় মামলা দায়ের করেনি কখনো। বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে প্রশ্ন করতে শেখায় সেখানে জাহাঙ্গীরনগর প্রশ্নের জবাব হিসেবে হাতকড়া ব্যবহার করতে শুরু করেছে, ন্যায্য দাবির প্রতিদান হিসেবে শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেন মামলার ভোগান্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবস্থান গণতন্ত্রের মৌলিক সংজ্ঞাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, প্রশ্নবিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ত্বশাসনকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবস্থান আমাদের রক্তের দানে পাওয়া ছাত্র আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে কলঙ্কিত করে। ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের পক্ষে আপনার অবস্থান জানান দিতে ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়ান, যে যেখানে আছেন, চিৎকার করে বলুন প্রশ্ন করাতে কোন অপরাধ নেই, উত্তরের বদলে হাতকড়া পরিয়েছে যারা ছাত্রদের হাতে তাদের বিচার হতেই হবে। গণতন্ত্র যেখানে আক্রান্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেখানে আক্রান্ত, প্রশ্ন করার স্বাধীনতা যেখানে আক্রান্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাসন যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানে এই স্বাধীন দেশের একজন সচেতন মানুষ হিসেবে প্রতিবাদ করা আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।