উপন্যাস-নীল মলাটের গল্প (২০১৬) / লেখক- লুৎফর হাসান/ প্রকাশক-দেশ পাবলিকেশন্স/ প্রচ্ছদ-ধ্রুব এষ
দ্বিতীয় দিনও একই অবস্থা। টেম্পোর ভেতর আবারও নতুন তিন আড্ডাবাজকে দেখা গেল। এবারের আড্ডার বিষয়বস্তু বাজেট। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ চলল না। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল, একটা বাইক অল্প গতিতে টেম্পোর পেছন পেছন আসছে। আর, তার কড়া আলো গাড়ির ভেতর ঢুকে পরায় আড্ডাকে থেমে যেতে হয়। এছাড়া উপায় কী! মুখের ওপর প্রচুর আলো পড়লে অনেকে কথা বলতে পারে না। অবশ্য তুর্যের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম। সে ওই অবস্থায় বলল, 'সামনে আমার জন্মদিন। নীল মলাটের গল্প উপন্যাসটা আমাকে গিফট করিস। আগে জন্মদিনে বইপত্র গিফট পেতাম। এখন মনে হয় এর প্রচলন কমে গেছে। সবাই রেস্টুরেন্টে খেতে চায়।' আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
'নীল মলাটের গল্প' উপন্যাসের একটা অংশে রেস্টুরেন্ট নিয়ে কিছু আলাপচারিতা আছে। সেখানে পরাগ সাহেবকে সোমার সঙ্গে খুনসুটি করতে দেখা যায়। গল্প-উপন্যাসে প্রেমিক প্রেমিকার আলাপ পড়তে এমনিতেই ভাল লাগে। আমারও লেগেছে। তুর্য পড়লে তারও ভাল লাগবে। কিছু নস্টালজিয়াও জেগে ওঠবে। তাই এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলি, 'ওই উপন্যাসটা টানা লেখা। চ্যাপ্টার করা নেই। ফ্ল্যাশব্যাক থাকার কারণে পড়ার সময় আলাদা মনোযোগ লাগে। আর, ওখানে সুনেত্রা, শ্যামা, সোমা, তরু, পদ্ম নামের বেশ কিছু নারী চরিত্র আছে। এদের অনেকে সমসাময়িক। যাইহোক, তোর হয়ে আমি দ্বিতীয়বার পড়ে নেব। চিন্তার কিছু নেই।' সেদিনের মত যাত্রা শেষ হয়।
তৃতীয় দিনও অন্যদিনের মতই সন্ধ্যাবেলা চকবাজার ফিরছি। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই যাত্রায় কোনও আড্ডাবাজ ছিল না। সবাই চুপ। গাড়ির ভেতর শীতল আবহাওয়া। এক যাত্রী কড়া পারফিউম দিয়েছেন। ফুলের গন্ধ নাকে আসছে। টেম্পো যখন বারকোড (Barcode) রেস্টুরেন্ট পার করছে, তখন তুর্য বলল, 'ওই দেখ, Barcode এর B ওঠে গেছে।'
আমি না দেখার ভান করলাম। সাইনবোর্ড-ব্যানারে এরকম অক্ষর উঠে যাওয়ার ঘটনা আমাদের ঐতিহ্য হয়ে গেছে। আর, প্রতিটি বুদ্ধিমান মানুষ জানে, ঐতিহ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে নেই। তুর্যের কথায় গুরুত্ব দিচ্ছি না দেখে সে বলল, 'আচ্ছা, যার নাম পরাগ, তার তো কবি হওয়ার কথা ছিল।' আমি চুপ করে পরাগ সাহেব কোন ব্র্যান্ডের পারফিউম ব্যবহার করেন, তা ভাবতে লাগলাম। কিছুক্ষণ আগে সেভেন ডে'স রেস্টুরেন্টে চিকেন চপ খেয়েছি। ওটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া লুৎফর হাসান গল্প-উপন্যাস লিখলেও কবিতার সঙ্গে তার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এ কারণে নীল মলাটের গল্পের ভেতর কিছু কবিতাও আছে।
পরদিন সামান্য বৃষ্টি হচ্ছিল। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের সামনে গাড়ির একটা সিট খালি হল। তখন এক ভদ্রমহিলা হুট করে এসে সেখানে বসলেন। সমস্যা হল, গাড়িতে সিট আছে একটা, আর তারা মানুষ তিনজন। তিনি বসার আগে ব্যাপারটা খেয়াল করেন নি। এক পর্যায়ে অন্য-দুজন তাকে হাসিমুখে টা টা করলেন (একজনের হাসি চমৎকার ছিল)। বললেন, হ্যাভ এ সেভ জার্নি। এ ঘটনায় ভদ্রমহিলা হঠাৎ করে একা হয়ে পরলেন। নীল মলাটের গল্পে দুপুর নামে একটা চরিত্র আছে। সেও এইভাবে একা হয়ে পরে।
আমি তুর্যকে বললাম, 'তুই তো আজ রাতে চলে যাবি। তোকে উপন্যাসের কাহিনীটা বলে দিই?' তুর্য গম্ভীর কণ্ঠে বলল, 'নো স্পয়লার প্লিজ। আমি নিজেই জেনে নেব।' ওর কথা শুনে আমি খুশী হলাম। এটা সত্যি যে, আরেকজনকে বই গিফট করার চর্চা কমে গেলেও, উপস্থাপক হানিফ সংকেত বই দেয়ার চর্চাটা ধরে রেখেছেন। ইত্যাদিতে বিজয়ী দর্শকদের প্রায় বই গিফট করা হয়। কিন্তু কী বই দেয়া হয়, তা দেখার কোনও সুযোগ নেই। এই ব্যাপারে আমার আগ্রহের কারণ, হানিফ সংকেত নিজেও বইপত্র লিখেন। সেগুলো উপহার দেন না তো?
রাতে তুর্যকে ঢাকার বাসে তুলে দিই। সে এখন উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ঢাকায় থাকে। বর্তমানে চীনের চেয়েও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় খরচ বেশি। তুর্যের খরচ চট্টগ্রাম থেকে যোগাড় হয়। গত চারদিনের মধ্যে তা যোগাড় করা হয়েছে। একটু পর গাড়ি স্টার্ট হতেই সে জানায়, 'তোর বুকসেলফ থেকে নীল মলাটের গল্প বইটা নিয়েছি। ফেরত পাওয়ার আশা করার দরকার নেই।'
আমি সিগারেট ধরাই। শেষের দিকে নীল মলাটের গল্পের মোড় ঘুরে যাওয়া নিয়ে ভাবি। এক ফাঁকে পরিচালক মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর কথা মনে পড়ে। শোনা যায়, একসময় তার প্রেমিক জীবন উথালপাতাল ছিল। লুৎফর হাসান উপন্যাসটা তাকে উৎসর্গ করেছেন।
অতিরিক্ত/ বুক রিভিউ লেখার কিছু নিয়ম আছে। সেই নিয়মের মধ্যে কিছু আলোচনা, আর কিছু সমালোচনা থাকে। বাংলাদেশে এই নিয়মগুলো কঠিনভাবে মানা হয়। আমি প্রায় চেষ্টা করি, নিয়মগুলোর বাইরে গিয়ে খানিকটা ফাজলামি ঢুকিয়ে দিতে। পারি কি-না জানি না।
এই লেখাটা লেখার কারণ, অনেকদিন বুক-রিভিউ লেখা হয় না। লিখতে ইচ্ছে করল। মনে আছে রাত দুটোর দিকে লিখতে বসেছি। কীভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। এমন সময় এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলল, 'আমি চট্টগ্রাম আসছি। এখন কুমিল্লা।' আমি বললাম, ঠিক আছে, আয়। আমি লিখতে বসছি। ঘণ্টা তিনেক পর সে এলো। ঘরে ঢুকতেই তাকে লেখাটা দিলাম। সে পড়ে বলল, আমি আসতে না আসতেই আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলি? আমি কোনও উত্তর দিলাম না। সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল। ঘরে ঢোকার আগে তাকে বলেছিলাম, স্টেশন থেকে দুটো গোল্ডলিফ সুইচ আনতে। সে গোল্ডলিফ লাইট নিয়ে এসেছে। বাধ্য হয়ে সেই সিগারেট ধরালাম। দুটো টান দেওয়ার পর গোল্ডলাইফ লাইটকে আমার লবণ ছাড়া তরকারী মনে হল।
আর একটা কথা। দৈনিক আজাদির সাপ্তাহিক 'খোলা হাওয়া'তে প্রকাশিত হওয়ার সময়, এই লেখার নাম ছিল 'খতিয়ান'। এখনও তাই আছে, তবে একটু লম্বা হয়েছে। এছাড়া কিছু জায়গায় পুনঃলিখিত হয়েছে। ঐ সময় হঠাৎ করে কিবোর্ডের আকার বদলে যাওয়ায়, লেখার গতি কমে গিয়েছিল। যার কারণে কিছু অংশ পুরোপুরি লেখা হয়নি। এ জন্য দ্বিতীয় বসায় লেখাটিকে পরিপূর্ণতা দেয়ার চেষ্টা করতে হল। সবাইকে শুভেচ্ছা।