মানুষ মানুষের জন্য কথাটা এক জীবনে হাজারবার শুনেছি।দেখেছিও। আমাদের চারপাশে। যারা নিজের ভালমন্দ হিসেব-নিকেশ ছাড়াই – ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্য মানুষের বিপদ-বিপত্তিতে।স্যালুট ঐ মানুষগুলোকে যারা এই চলমান স্বার্থপর পৃথিবীতে আজো অন্যের ভালমন্দে বাড়িয়ে দেয় সহযোগিতার হাত।এবং বলতেই হয় মানবতা এখনো যেন টিকে আছে এই মানুষদের হাত ধরেই।
এই ' ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো' মানুষগুলো এখনো না থাকলে আমাদের সমাজ থেকে ' সামাজিক' শব্দটাই উঠে যেতো। সমাজ মানেইতো আশপাশ, পাড়া-প্রতিবেশী । একে অন্যের আপদে বিপদে এগিয়ে আসা।আদিমকালে প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে নিরন্তর লড়াই করে ঠিকে থাকতে হতো মানুষকে।একা একা সেই যুদ্ধ সহজ ছিলনা বলেই মানুষ আস্তে আস্তে গড়ে তুলে সমাজ, যাতে একে অন্যকে সাহায্য করতে পারে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে ঠিকে থাকার যুদ্ধে।সেই আদিমযুগের মানুষ—যারা ছিল তথাকথিত সভ্যতার আলোহীন বায়ুহীন মানুষ ,তারাও বুঝেছিল সমাজ এবং সামাজিকতার উপযোগিতা। আর আজ আমরা সভ্যতার ,প্রযুক্তির চূড়ান্ত উন্নয়ন বাঁ উৎকর্ষ সাধনের পরে ধীরে ধীরে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছি সামাজিকতার আবহ থেকে।আমার পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে আমি হয়ত জানিনা কয়েকবৎসরের একত্র বসবাসের পরেও। তাদের বিপদ- আপদ- সমস্যাতো আরো পরের ব্যাপার।এবং মানুষের স্বাভাবিক আচরণগত যে শব্দ 'মানবিকতা ' তাকেও প্রত্যাখ্যান করে ফেলছি ব্যক্তিগত জীবনাচার থেকে।
এই যে আমরা লেখালেখি করি। আড্ডা দেই। একে অন্যের সাথে ভাবের আদানপ্রাদান করি।এভাবেই একে অন্যের খুব পরিচিত এবং আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠি।কিন্তু আমাদের মাঝখান থেকে হুট করে যদি কেউ হারিয়ে যায়, তখন কি হয়? প্রথম প্রথম হয়তো একটু মন খারাপ লাগে। কিন্তু ভুলতেও সময় লাগেনা।তার খোঁজখবরের জন্য একটু বাড়তি সময় বের করাটাও যেন আমাদের কাছে মহাঝামেলার কাজ বলেই মনে হয়।আর যদি আচমকা কখনো সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটি আবার ফিরে আসে ,তার দিকে মনোযোগ দেবার সময় অথবা মন কি আদৌ আমাদের থাকে? থাকলেও কতটুকু? সেই পুরানো প্রাণের টান কি আবার ফিরে আসে? খুব সম্প্রতি এমনি এক প্রশ্ন অনবরত কুরে কুরে খাচ্ছে।
প্রশ্নটা উঠছে এজন্য যে প্রায় দুই যুগ আগে হারিয়ে যাওয়া এক সতীর্থের হ্যাঁ সতীর্থ বলা যায় কারণ আমরা একই কাব্যজগতের চর্চা করি। প্রায় একই সময়ের মানুষ। হ্যাঁ প্রায় দুই যুগ আগে হারিয়ে যাওয়া আমাদের কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের কথাই বলছি।আশির দশকের কবি।জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঝিনাইদহের বিষয়খালিতে ১৯৬২ সালের ২৯ মে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে অনার্স পাশ করে চলে আসেন ঢাকায় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।১৯৯৩ সালে হঠাৎকরে উধাও হয়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এখানেই ছিলেন ।এরপর আর কেউ তাঁর কোন খবর পায়নি।২০১০ সালে তাঁর খবর পাওয়া যায় তিনি আছেন পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁয়ের কাছাকাছি কোন এক জায়গায়। অসুস্থ। কথাবার্তাও প্রায় বলেনইনা। তখন ঢাকার তাঁর কয়েকজন বন্ধু এবং কলকাতার কয়েকজন মিলে একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁকে ফিরিয়ে আনার এবং সুচিকিৎসার ব্যাবস্থা করার।গিয়েছিলেনও কবির সাথে দেখা করতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কেন তাঁদের সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো সেটা অন্য প্রসংগ।
আমার লেখালেখি মূলতঃ মফস্বলে। সিলেটে।মাঝে মাঝে ঢাকায়,জাতীয় দৈনিকে এবং কিছু কিছু ম্যাগাজিনে। বিষ্ণুর সাথে কোন যোগাযোগ অথবা দেখা কখনো হয়নি। এমনকি /ওর কোন লেখা আমি পড়েছি কিনা তাও মনে নেই এখন আর।যে সময়ের কথা বলছি তখন ইন্টারনেটের যুগ ছিলনা। অন্তত বাংলাদেশের মতো দেশেতো নয়ই।কাজেই ঢাকা আর মফস্বলের সাহিত্যকর্মীদের মাঝে যোগাযোগের সুযোগ ছিল কম।
এজন্যই কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের হারিয়ে যাওয়া অথবা আঠারো বৎসর পরে আবার তাকে খুঁজে পাওয়ার কিছুই জানতামনা অথবা কারো মুখেই শুনিনি।কিন্তু হঠাৎ করেই ৩০ মে বিষ্ণুর জন্মদিন উপলক্ষে কিছু কিছু জায়গায় তাঁর নামের উল্লেখ দেখলাম।আর এরপরই পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ থেকে প্রকাশিত ওয়েব ম্যাগাজিন " অচেনা যাত্রী" র সম্পাদক অমিত কুমার বিশ্বাসের কাছ থেকে জানলাম কবি বিষ্ণু বিশ্বাসকে নিয়ে অনেক কথা।
আর সব থেকে বেশি চমকে গেলাম অমিতের পরিকল্পনার কথা শুনে। অমিত জানালেন, " অচেনা যাত্রীর '" আগামী সংখ্যাটাই করতে চান বিষ্ণু বিশ্বাসকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা।অথচ নিজেও তেমন কিছুই জানেননা বিষ্ণুর লেখা অথবা বিষ্ণু সম্পর্কে।শুধুমাত্র বিষ্ণুর কয়েকটা কবিতা পড়েছেন কোথাও এবং বিষ্ণুর কোন আত্মীয়ের কাছ থেকে কিছু কিছু জেনেছেন।
অমিত আমার বিশেষ স্নেহভাজন। আর সব থেকে ভাল লাগে সাহিত্যের প্রতি, সাহিত্যিকদের প্রতি, তাঁর প্রচন্ড আন্তরিকতা, ডেডিকেশন। মানুষের প্রতি , মানবতার প্রতি তাঁর এই সমবেদনা এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। আর অমিতের , শুধু অমিতেরই বা কেন "অচেনা যাত্রীর" পুরো টীমের– এই উদ্যম-উদ্যোগ হারিয়ে যাওয়া এক কবিকে আবার নবজন্ম দেবার , আবার জনসমক্ষে নিয়ে আসার ; আমার মতো অলস-উদ্যমহীন মানুষকেও আগ্রহী করে তুললো–বিষ্ণুর প্রতি।তাঁকে জানার–তাঁর মঙ্গল প্রার্থণার। আবার পূর্বজীবনে ফিরিয়ে আনার আগ্রহে।
২রা জুলাই প্রকাশিত হয়েছে কবি বিষ্ণু বিশ্বাসকে নিয়ে 'অচেনা যাত্রী'র বিশেষ সংখ্যা।