এ কার দেশ?

নাজনীন খলিল
Published : 8 Nov 2016, 12:29 PM
Updated : 8 Nov 2016, 12:29 PM

দেশটাকে এখন ভীষন অপরিচিত মনে হয়। মনে হয় চিরপরিচিত সেই দেশ নয়- যেন ভুল করে আচমকা অন্য এক দেশে এসে পড়েছি, যার চারদিকে বর্বরতা আর নৃশংসতার অতল অন্ধকার। সুস্থ পরিবেশ যেন সুদূর পরাহত স্বপ্ন। স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ নিষ্টুরতা আর নির্মমতায় ছেয়ে গেছে সমস্ত দেশ। মানুষের বিবেক-বুদ্ধি, মূল্যবোধ, নৈতিকতা সব যেন হারিয়ে গেছে  বিবেকহীনতা আর পৈশাচিকতার অতল অন্ধকারে। দেশ যেভাবে অন্যায়, অত্যাচার, অনাচারে ভরে গেছে  মনে হয় দেশের জলবায়ুও যেন বিষাক্ত হয়ে গেছে, সুস্থভাবে নিঃশ্বাস নেবার উপায় নেই।

আমাদের আশেপাশে যখন কোন অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে তখন তা মানুষের মনে রেখাপাত  করে নেতিবাচকভাবে। সেই প্রভাবে মানুষের স্নায়বিক বৈকল্য ঘটতে পারে। এর ভোক্তভোগি আমি নিজেই। ইন্টারনেটের কল্যানে, অনলাইন মিডিয়ার কল্যানে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে মানুষ দেশের আনাচ-কানাচে ঘটে যাওয়া প্রতিদিনকার ঘটনার টাটকা খবর পাচ্ছে। খারাপ খবরগুলো মানসিক স্বাস্থ্যেরজন্য, স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য ,হুমকি স্বরুপ হয়ে দেখা দিয়েছে। এখানে প্রতিদিনই এমন সব ঘটনা ঘটছে , বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের জন্য তা সহ্য করা ভয়াবহ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে এতো অনাচার,অন্যায়, অবিচার, নির্যাতনের চিত্র প্রতিদিন দেখতে হচ্ছে যেন দুর্ঘটনাই এখানে স্বাভাবিক বা দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

মতের অমিল থেকে মানুষ মানুষের গলা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করছে চাপাতির কোপে।প্রেমে প্রত্যাখ্যাত  হয়ে কাংখিত নারীকে ধর্ষণ করছে, মেরে ফেলছে। বিকৃতকাম পুরুষের লালসার শিকার হচ্ছে এমনকি দুধের শিশুরাও। পাঁচ বৎসরের শিশুর যৌনাঙ্গ কেটে নিজের বিকৃতি মেটাচ্ছে পৌঢ় ধর্ষকামী পুরুষ। এর থেকে বিকৃত, নির্মম, ভয়াল চিত্র আর কী হতে পারে? ধর্ষণ যেন এখনকার প্রাত্যহিক স্বাভাবিক ছবি। প্রতিদিনই ধর্ষিত হচ্ছে কোন না কোন নারী অথবা শিশু। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০/১১ বৎসরের মেয়ে শিশু। আমরা এমনও দেখেছি চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে  শিশুকে।দেশে নারী বা শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে  সুস্পষ্ট আইন আছে। কিন্তু তা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে  তাও দেখতে হবে। আর প্রচলিত এই আইনগুলো কি যথেষ্ট বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে তা পূনর্বিবেচনার দাবী রাখে। আইন থাকলেই হয়না। তার সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমেই অপরাধ রোধ করা সম্ভব। আর আইনকে এমনভাবে শক্ত করতে হবে যেন আইনের ফাঁক গলে এসব জঘন্য অপরাধীরা পার পেয়ে না যায়।

শুধু কি গলাকাটা আর ধর্ষণের মধ্যেই এসব অপরাধীর বিচরনক্ষেত্র সীমাবদ্ধ? তা নয়। অপেক্ষাকৃত দুর্বল জনগোষ্টির উপর দলবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়াও এই নরপশুদের আরেকটি বহুল চর্চিত অপরাধ। দুর্বল আদিবাসী বা হিন্দু জনগোষ্টি এদের শিকার। নিকট অতীতে রামুতে যা ঘটতে দেখেছি অতি  সম্প্রতি তাই ঘটে গেল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে।

সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্টির উপর নির্যাতনের যে নির্মম চিত্র তাতে এদেশের একজন সংখ্যাগুরু গোষ্টির মানুষরুপে নিজেকে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করছি।বর্বরতার সকল সীমা অতিক্রম গেছে নাসিরনগরে ঘটে যাওয়া ঘটনা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বলে খ্যাত বাংলাদেশের এ কোন অধঃপতন! পাকিস্তান আমলেও স্বাভাবিক অবস্থায়  হিন্দুদের উপর এমন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। একাত্তরের ঘটনা ছিল ভিন্ন। পাকিস্তানি সেনারা যেমন হিন্দু নির্যাতন করেছে, মেরে ফেলেছে তেমনি বাঙালি মুসলমানও রক্ষা পায়নি গুটিকতক দালাল বাদে। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- বাঙালি, আদিবাসী নির্বিশেষে যুদ্ধ করেছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। আজকে সেই বাঙালি আরেক বাঙালির উপর ঝঁপিয়ে পড়ছে শুধুমাত্র ধর্মীয় বিভাজনের কারনে!যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়ে একসাথে যুদ্ধ করে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা অর্জন করেছিলাম, সেই অঙ্গীকার আজ কোথায়? ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে একদিন আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু সেই বিভাজন যে ভুল ছিল অচিরেই প্রমানিত হয়েছিল। যার ফলে আবার ধর্মীয় বিভেদ ভুলে আমাদের দেশটিকে এক নতুন অসাম্প্রদায়িক দেশে পরিণত করেছিলাম। আজ সেই বাংলাদেশকে আবার ধর্মীয় বিভাজনের শিকারে পরিণত করার চেষ্টা করছে কারা?

বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের সরকার। এই সরকারের সময়েই বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের  স্বপ্নের এমন করুণ অবস্থা দেখতে হবে কল্পনাও করা যায় না। সরকারের প্রতি আকুল আবেদন সব অন্যায় -অবিচারের প্রতিবিধান করুন। দেশটার এই বেহাল দশা আর যে সহ্য হয় না!