আগুনে জ্বলেছি ৪০টি বছর!

-নিঝুম মজুমদার
Published : 7 Jan 2012, 04:08 AM
Updated : 7 Jan 2012, 04:08 AM

এক।

গ্লস্টার রোড থেকে আমি আর প্রফেসর মুনতাসীর মামুন স্যার ট্রেন ধরলাম। আমাদের গন্তব্য ব্রিক লেনের পাশের হ্যানবুরী স্ট্রিটের মন্টিফিয়োরী সেন্টার। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাতে যাব। সভা শুরু হবে সন্ধ্যা ছ'টায়। স্যার এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। অথচ ট্রেনে যখন আমরা উঠি তখন ঘড়ি প্রায় ছ'টার কাঁটা ছুয়ে ফেলেছে। ডিস্ট্রিক্ট লাইনের ঘট ঘট শব্দ করা ট্রেনে আমরা দু'জন পাশা পাশি বসে আছি। স্যার মনে হয় কিছুটা ক্লান্ত। ইংল্যান্ডে এসেই পাগলের মতো দৌড়িয়েছেন এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।তাঁর এখানকার সকল কাজই যুদ্ধাপরাধ বিচার সংক্রান্ত কিংবা মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, স্যারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেশ করলাম-

-স্যার, আমার একটি প্রশ্নের উত্তর চাই। উত্তরটিতে "যদি" কিংবা "কিন্তু" কিছুই চাইনা।শুধু সত্য কথাটি জানতে চাই।

স্যার মনে হয় আমার কথা শুনেই বুঝতে পেরেছেন, আমি কি প্রশ্ন করব। আমার প্রশ্ন করবার ভঙ্গি দেখেই খানিকটা মৃদু হাসলেন। বললেন-

-করো। প্রশ্নটা করো।

– স্যার, আওয়ামীলীগের এই টার্মেই যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে তো? এই টার্মে বিচার যদি না হয় আর আওয়ামীলীগ যদি পরের টার্মে ক্ষমতায় না আসতে পারে তবে খালেদা সব কটাকে ফুলের মালা গলায় দিয়ে ছেড়ে দিবে। সত্যিই বিচার হবে তো স্যার?

স্যার একবারও ইতস্তত করলেন না আমার কথা শুনে। আমার দিকে তাকিয়ে খুব সহজ অথচ দৃঢ় গলায় শুধু একটি কথা বললেন-

-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। আওয়ামীলীগের এই টার্মেই হবে।

আমার ভেতর একটা অজানা শংকা ছিলো। স্যারের এই উত্তরে নিমিষেই তা উবে যেতে থাকে। অপার্থিব জগতের একটা আনন্দ কোত্থেকে এসে যেনো আমাকে ঘিরে ধরে। আমরা সামনে বসে থাকা ছোট খাট মানুষটিকে এখন আর ক্লান্ত লাগে না। মনে হয় তেজস্বী আর উদ্দীপ্ত এক প্রাণবন্ত যোদ্ধা। যে যোদ্ধার এটি দ্বিতীয় যুদ্ধ।যে যোদ্ধা জীবনের প্রতিটি সময় কাটিয়ে দিয়েছেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে। যে যোদ্ধার সারাটি জীবন গিয়েছে বিচার চাইতে চাইতেই।

হ্যানবুরী স্ট্রীটে আমরা যখন ঢুকলাম তখন চারিদিকে অন্ধকার। স্ট্রীট লাইটিটি মনে হয় ঠিক করা হয় নি। সামনের রাস্তা থেকে ছিটকে আসা আলোতে স্যারের ছায়াটি আমার উপর দীর্ঘ হয়ে পড়ে। স্যারের পেছনে পেছনে আমি। যেন, স্যারকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি সন্তর্পনে। একটা সময় মনে হতে লাগলো সামনে যিনি ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন, তিনি মুনতাসীর মামুন নন। তিনি বাংলাদেশ। যেই বাংলাদেশের ভয়ে যুদ্ধাপরাধী আর তাদের সাথীরা প্রতিটি দিন আক্রোশ বাড়িয়ে দেয়, ঘৃণার ছোবল ছুঁড়ে দেয়। আমি আছি সেই বাংলাদেশের পেছনে, এই বোধটুকু আমাকে এক ধরনের আচ্ছন্নের মত করে রাখতে থাকে।

নিজের অজান্তেই বলি, আমি শত্রু চিনি প্রিয় বাংলাদেশ। তুমি নির্ভয়ে ঘুমাও। আমি আছি…আমরা আছি…… নিরন্তর..।

দুই।

অনেক আগে একটা গল্প পড়েছিলাম হুমায়ুন আহমেদের। গল্পটির নাম "জলিল সাহেবের পিটিশান" । গল্পের মূল চরিত্র জলিল সাহেব। যার দুটো ছেলে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশকে রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন। সেই শহীদের পিতার করুন আর্তনাদ গল্পের প্রতিটি শব্দে জ্বলজ্বল করে। হু্মায়ুন আহমেদের এই গল্পটি যতবার পড়েছি ততবারই একটা সাধারন অনুভূতি হয়েছে। সেটি হচ্ছে, একজন বাবা বিচার চান, তার ছেলে হত্যার জন্য। একজন পিতা বিচার চান সব নিরীহ মানুষগুলোর হত্যার। আর সেজন্যই তিনি ছোটেন পথ থেকে প্রান্তরে, মানুষ থেকে মানুষে। এলাকার মানুষ জলিল সাহেবকে দেখে পালিয়ে বাঁচেন, কেটে পড়েন। পাছে না আবার জলিল সাহেবের "মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক" কথার মধ্যে "পড়ে" যেতে হয়, তেমন ভেবেই। কেউ কেউ বলেন ক্ষমা করে দিতে, কেউ কেউ বলেন, "পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে কি হয়?", কেউ কেউ বলেন, "আপনি একটা বাড়িড় জন্য দরখাস্ত করে দিন", কেউ কেউ তাড়িয়ে দেন।

এই পাগলাটে জলিল সাহেবের গল্পটি এই পর্যন্ত ২০-২২ বার পড়া হলেও, একজন পিতার আর্তনাদ আর আর্তি ছাড়া গল্পটিকে আর অন্য কিছু ভাবিনি। গল্পের শেষে একটা ব্যাথা অনুভুত হয় জলিল সাহেবের জন্য। এই যা। কিন্তু অনেকদিন পর আজ আবারো পড়লাম গল্পটি। এবারের পড়াটি অন্যবারের থেকে আলাদা। হয়ত চিন্তার প্যাটার্ন কিংবা প্রেক্ষিত পালটে যাচ্ছে বা গিয়েছে। হতে পারে, দুঃখবোধ আগের থেকে আরো বেশী চূড়ান্ত হয়েছে, বিদীর্ণ করেছে, ভেঙ্গেছে, চুরমার করে দিয়েছে। এবার গল্পটি পড়ে পুরো শরীর বেয়ে এক ধরনের কষ্টের স্রোত বয়ে গেলো। বুকটা ক্রমশ ভরে যেতে লাগলো সব অচেনা, অপার্থিব আর আশ্চর্য ব্যাথায়। গল্পটি হুমায়ুন আহমেদ আকাশ থেকে লিখে নিয়ে আনেন নি কিংবা গায়েবী ওহী থেকেও নয়। গল্পটি হুমায়ুন আহমেদ আমাদের আশে পাশের বাস্তবতা থেকেই নিয়েছেন। একজন পিতার আর্তনাদ শুনবার কেউ নেই। নেই রাষ্ট্র, নেই মানুষ, নেই আদালত, নেই বিচার।

গল্পটি পড়বার এক পর্যায়ে চট করে আমার পাঁচ মাস বয়সী ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকি। নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে ইথান। আমার একমাত্র সন্তান। ইথানের দিকে তাকিয়ে জলিল সাহেবের কষ্টটি বুঝবার চেষ্টা চালাই। ইথানকে একদল লোক নৃশংস ভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারছে, কিংবা এদেশেরই কিছু জানোয়ার ইথানকে ধরে নিয়ে গিয়েছে সেসব জানোয়ারদের কাছে, এমনটি ভেবে দিশেহারার মত লাগতে থাকে। আমার এই কষ্টটি এতটা সুক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, মনে হতে থাকে যেন, কেউ আমার শরীর কেটে আমার কলজেটিকে ফালি ফালি করে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হতে থাকে যেন, আমি একজন শূন্য মানুষ। আমি একজন ফাঁপা মানুষ। আমি একটি কষ্টের উপখ্যান প্রাচীন গ্রীস পুরানের মত। মনে হতে থাকে আমিই জলিল সাহেব। আমিই সেই লোক।

অথচ… আজ বিচার চাইতে এসে কাদের বাঁধার মুখে পড়েছি আমরা? আজকে কাদের গালাগালের মুখে পড়েছি আমরা? আমরা কি পাকিস্তানের চাপের মুখে রয়েছি? আমরা কি আমেরিকানদের চাপের মুখে রয়েছি? আমরা কি সৌদি আরবের চাপের মুখে রয়েছি? আমরা কি ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ঘানা, চিলি, বাহারাইন, আরব আমিরাত, ভারত, কিউবা, দক্ষিন আফ্রিকা, রেড ইন্ডিয়ান, কালো, সাদা,আফ্রিকানদের চাপের মুখে রয়েছি?

উত্তর হচ্ছে, "না"।

আমরা আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবী শুনি কাদের মুখে? তাদেরই মুখে যাদের বাবারা ছিলো ১৯৭১ সালের রাজাকার, আলবদর কিংবা আল শামস। কিংবা খোদ সেইসব রাজাকার-আলবদরদের আজকের দোসর বি এন পি'র কর্মীদের কাছ থেকে। শুধু মাত্র রাজনীতি আর জোট বদ্ধতার কারনেই আজকে তাদের এই অবস্থান। তাদের বাবারা ১৯৭১ সালে মেরেছে আমাদের বাবাদের, ভাইদের, বোনদের। এবার এরা মারছে আমাদের, আমাদের ভাইদের। এদের সন্তানরা মারবে আমাদের সন্তানদের। এরা প্রতিটি মুহূর্তে বাঁধা দেবে আমাদের মুক্ত চিন্তা, মুক্ত বুদ্ধি। এরা বাঁধা দেবে আমাদের একাত্তরকে।

আমরা তারপরেও বসে থাকি স্থানুর মত। জড় বস্তুর মত। এক আশ্চর্য দেশের আশ্চর্য মানুষ আমরা। এদেরকে খুবলে খেতে কতক্ষন লাগে? কতক্ষন লাগে এদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিতে? কয়টি মানুষকে প্রয়োজন? কয়টি হাতের প্রয়োজন? প্লিজ, কেউ কি আছেন উত্তর দেবার জন্য? উত্তর কি দেবেন?

৩।

আজকে যুদ্ধে নেমেছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতে। আমার বাপ-চাচারা করছেন সম্মুখ সমর। লড়েছেন দেশের জন্য। এবার আমরা লড়ি বেঁচে যাওয়া শত্রুদের পাট চুকাবার জন্য। মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবিরদের এটা দ্বিতীয় যুদ্ধ। আমাদের জন্য এটি প্রথম।

সুখেই তো থাকতে পারতাম!! নিজের ব্যাক্তিগত অর্থকড়ি না থাকলেও, বাবার অর্থে সুখেই কাটাতে পারতাম জীবন। আইন পড়েছি। দেশ বিদেশ থেকে ডীগ্রি হাঁকিয়েছি। কি দরকার ছিলো সব কিছু ফেলে দিয়ে লিখবার? কি দরকার ছিলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে, তাদের মিথ্যে প্রোপাগান্ডার জবাব দিতে গিয়ে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে কাটাবার? কি দরকার ছিলো অমি পিয়ালের আজকের এই অবস্থানের জন্য? যে কিনা সংসার চালাতে পারে না, সন্তান চালাতে পারেনা শুধু মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনাবে বলে? কি দরকার ছিলো তার এইসবের? ইচ্ছে করলেই তো তার বয়সী একটি যুবক কোটি কোটি টাকা উপার্জন করতে পারে। কেন তিনি তা করেন নি? মুহম্মদ জাফর ইকবাল কেন তার অমূল্য সময় নষ্ট করে পত্রিকায় লিখবেন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে? আবু সাঈদ জিয়া উদ্দিন, একরামুল হক শামীম, সাঈদ আহমেদ, রাগিব হাসান, আশফাক আনুপ, রাজকুমারী, রায়হান রশীদ,আরিফ জেবতিক মাহবুব, শনিবারের চিঠি, মাহবুব আজাদ হিমু, এরা কেন তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে ব্লগে লিখবে যুদ্ধাপরাধীদের কথা? কেন তারা এই সময়টিতে অর্থের পেছনে ছুটবে না? কেন তারা ছুটবে না তাদের স্ত্রীর কাছে, মেয়ে বন্ধুটির কাছে, ঘরের কাছে, পরিবারের কাছে?

যে জীবন কাটাতে পারতাম যাবতীয় আনন্দ উল্লাসে । যে জীবন হতে পারত অর্থের,উপার্জনের, আয়েশের, শীশা পল্লীর, সোনার গাঁর বুফের, গুলশানের, বনানীর, নারীময়তার, যে জীবন হতে পারত অলস বুদ্ধিজীবির, সে জীবনে যুদ্ধকে বেছে নিয়েছি কেন?

শুধু একটি কারনেই। স্রেফ একটি কারনেই।

৩০ লক্ষ স্বজনকে হত্যা করে ওই নোংরা পিন্ডেরা ভালো থাকবে। সুখে থাকবে। আনন্দে থাকবে। শান্তিতে থাকবে। এটি মেনে নিয়ে ওদের মত নোংরা পিণ্ড হতে পারিনি বলেই।