আমি কি ঠিক পথে চলছি?

নিতাই বাবু
Published : 29 March 2016, 02:13 AM
Updated : 29 March 2016, 02:13 AM

বাবা মৃত্যুবরণ করার পর খুবই কষ্টের দিন তখন আমাদের, অামি বাদাম বিক্রয় করিয়া ও লেখাপড়ার খরচ যোগাড় করতে পারছিলাম না। আদর্শ কটন মিলটি তখন বন্ধ অবস্থায়, বড় ভাইও বেকার। তখন আমাদের আদর্শ কটন মিলের একটা মসজিদ নির্মাণ এর টেন্ডার হয়, সেই টেন্ডার পেয়ে যায় চট্রগ্রামের এক কনট্রাকটর। কাজ চালু হল, কাজের লোকের প্রয়োজন হল, বাদাম বিক্রী ছেড়ে সেই মসজিদ নির্মাণ এর রাজমিস্ত্রিদের সথে রাজযোগালীর কাজে যোগদান করি। কিছুদিন পর কনট্রাকটর সাহেব সাহেব আমার কাজ দেখে আমাকে উনার চট্রগ্রামে যেত বলেন। দৈনিক রোজের মুজুরী মাত্র ১২ টাকা। সবার মুজুরী ১০ টাকা শুধু আমার মুজুরী ১২ টাকা। তখন কাজের মুজুরী পেতাম ৮ টাকা মাত্র, চট্রগ্রাম যদি যাই তবে ৪ টাকা বেশী!! আমি রাজি হয়েছি যাবার জন্য, আরো দুইজনকে রাজি করেছিলাম। আমার মাকে বললাম, মা বলল না দরকার নেই যাওয়ার, তোকে কোন কাজ করতে হবে না। মাকে আবার বললাম, মা তখন রাগ হইয়া বলেন তবে যাও। জিজ্ঞাসা করিলেন সাথে কত জন লোক যাচ্ছি। আমি বললাম তিনজন। মা বলিলেন যাও, তবে অতি সাবধানে থাকিবে, আর চিঠি দিয়ে জানাবে।

তিন চার দিন পরই তিনজন মিলে রওনা হলাম চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে। তখন ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম ট্রেনের ভাড়া ২০ টাকা মাত্র। গেলাম চট্রগ্রাম বায়েজিদ বোস্তামী মাজার সংলগ্ন একটা পাহাড়ে। রাত্রির গাড়ি করিয়া যাওয়াতে সেইদিন আর কাজ করতে হয়নি আমাদের, শুধু ঘুরেছি সন্ধ্যা পর্যন্ত। ভেবেছি কাজ করতে পারব, কোন সমস্যা হবেনা। পরদিন সকালে কাজে যোগদান করি, কাজ হলে পাহাড়ের নিচ থেকে বালু উঠাইতে হইবে উপরে। সকাল ৮ ঘটিকা হইতে ১০ ঘটিকা পর্যন্ত। করেছি ভালভাবে, তারপর অার পারছিলাম না, বললাম পারবো না। কনট্রাকটর বললেন দুইদিন করতে থাক, তারপর তোমাদের আমি নিয়ে যাব কক্সবাজার মহেশখালী। সেখানে শুধু রাস্তার কাজ, আর সেই কাজ তোমরা করতে পারবে।

তখন খুব কষ্ট করে তিনদিন কাজ করলাম। তিনদিন পর ছুটলাম কক্সবাজার এর উদ্দেশ্যে। তখন চট্রগ্রাম হইতে বাস ভাড়া মাত্র ১০ টাকা। বাস থেকে কক্সবাজার নামিলাম, সেই সময় কক্সবাজার এখনকার মত ছিল না। বেশী একটা দোকান পাটও ছিলো না। কনট্রাকটর সাহেব সহ আমরা হোটেল থেকে কিছু খাইয়ে নিলাম। পরে মহেশখালীর ট্রলার ঘাট হইতে ট্রলারে উঠে মহেশখালীর উদ্দেশ্যে রওনা হইলাম। ট্রলার চলছে আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি চারদিক, কি সুন্দর যে লাগছিল চারদিক সেটা আর লিখে শেষ করা যাবেনা। যেতে যেতে একসময় ট্রলার থামল ঘাটে, ট্রলার থেকে নেমে সোজা চলে গেলাম মহেশখালীর বাজারে। সেখানে আবার চা বিস্কুট খাওয়ার পর কনট্রাকটর সাহেব আমাদের নিয়ে গেল মহেশখালী বাজারের একটু পশ্চিমে রাস্তার পার্শ্বে একটা সরকারী গুদাম ঘরে। সেখানেই আমদের থাকা খাওয়ার জায়গা। সেই গুদাম ঘর পাহাড়া দেওয়ার জন্য একজন প্রহরী ছিল, কনট্রাকটর সাহেব সেই প্রহরীর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রহরী আমাদের পেয়ে বেজায় খুশি, কারণ হলে আমরা তিনজনই ঢাকার লোক তাই। পরে আবার কনট্রাকটর সাহেব ও প্রহরী সহ আমরা তিনজন মহেশখালীর বাজারে আসি, রান্নাবান্না করার জন্য কিছু খরিদ করতে। তখন প্রায় বিকাল শেষে সন্ধ্যা। কেনাকাটা এক প্রকার শেষ করে কনট্রাকটর সাহেব প্রহরীর নিকট আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে আমাদের কাছ থেকে আজকের জন্য বিদায় নিলেন। কনট্রাকটর সাহেব রাত যাপন করবেন মহেশখালী বাজারে বোডিং এ। আমরা চলে এলাম আমাদের জাগায়। সেই গুদাম ঘরে এসেই তিনজন মিলে রান্নার কাজ সেরে নিলাম। রাতের খাবার সেরে তিনজন একসাথে ঘুমালাম।

সকালে গুদামের প্রহরী আমাদের ঢেকে নিয়ে কাজের জায়গায় নিয়ে গেলেন, কাজ হল মহেশখালী বাজার হইতে জনতা বাজার প্রর্যন্ত রাস্তার পাথর ঢালাই এর কাজ। সুন্দর কাজ পারবো করতে, আমরা তিনজন খুবই খুশি। দুই তিন সাপ্তাহ ভাল ভাবেই করিলাম, তারপর আর পারছিলাম না শুধু বৃষ্টিপাতের কারণে। কনট্রাকটর সাহেবও মহেশখালীতে নেই, সাবকনট্রাকটর সাহেবও আমাদের খাওয়ার টাকা দিতে কৃপণতার ভূমিকা নিচ্ছে। তখন বাজারে চা দোকানে ঘোড়াশালের একজন লোকের সাথে আমাদের পরিচয় হয়, সেই লোক আমাদের ভাষা শোনে আমাদের জিজ্ঞাসা করিল আমাদের দেশ কোথায়, বাড়ী কোথায়। আমরা বলিলাম ঢাকা। লোকটি তখন জানতে চাইলেন এখানে কিভাবে এলাম, তখন লোকটির কাছে সব বিস্তারিত খুলে বললাম আমাদের এই মহেশখালী আসার ঘটনাবলী। লোকটি মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করলেন আমাদের কথা। লোকটির এক প্রকার দয়া বর্ষিত হলে আমাদের উপর। লোকটি বলল তোমরা আমার সাথে যাবে? আমরা বলিলাম কোথায় যাব আপনার সাথে? লোকটি জবাব দিলেন (জাকিরিয়া সল্ট) লবনের মিলে। আমরা লবনের মিলে তো আমার কখনো কাজ করিনি, লোকটি বলিলেন সেটা না হয় পরে দেখা যবে, আগে বল তোমরা বর্তমান কাজের কোন মুজুরী পাবে কিনা? আমরা বললাম না,বরং আরো ঋণ থাকিতে পারি। লোকটি বলিলেন তাহলে আর কোন সমস্যা নাই চলো আমার সাথে। আগে ঘুরে দেখে আস পরে কাজের ব্যবস্থা হবে।

লোকটির সাথে রওনা হলাম আমরা তিনজন, অনেক বড় মিল, লোকটির সাথে ঘুরতে লাগলাম মিলের সমস্ত জায়গায়। তখন মিলের কর্মরত সকল কর্মচারী বৃন্দ আমাদের দেখে ফেলফেল করে শুধুই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। মিলটি ঘুরে দেখার পর লোকটি সোজা আমাদের নিয়ে গেল মিলের ম্যানেজার এর নিকট। ম্যানেজার আমাদের দেখে কাজ কররিতে পারিব কি না জিজ্ঞাসা করিলেন। আমরা হ্যাঁ সূচক জবাব দিলাম, ম্যানেজার বললেন ঠিক আছে আগামীকাল সকালে কাজে যোগদান করিতে। মুজুরী কত জানতে চাহিলাম, ম্যানেজার উত্তর দিলেন অনেক টাকা, তহা তোমরা খেয়েদেয়ে বাড়ীতেও অনেক টাকা পঠাতে পারিবে। আবারও জানতে চাহিলাম মুজুরী কত? ম্যানেজার বলিলেন ২৫ টাকা প্রতিদিনের মুজুরী। শুনে তো মহা খুশি আমরা তিনজন। মনে মনে হিসাব কষতে লাগলাম ১০ টাকা খরচ হবে আর ১৫ টাকা মায়ের কাছে পাঠাতে পারিব। এইরকম ভাবিতে ভাবিতে সেইদিন রাতে আর ঘুমই হল না, শুধুই স্বপ্ন আর স্বপ্ন, কি করিব এত টাকা দিয়ে! সকালে জানতে পারিলাম তিনজের একরকম অবস্থাই গিয়াছে সারারাত।

সকালে গুদাম ঘরের প্রহরীকে ঘুম হইতে উঠিয়ে তার কাছে বিস্তারিত বলেকয়ে আমরা তিনজন ঐ জাকিরিয়া সল্টে চলে আসি। মিলে আসার পর ঐ লোকটি মহাখুশি, কাজে যোগদান করলাম, কাজ করিতেছি। কাজের সময় হলে সকল ৮ ঘটিকা হইতে বিকাল ৫ ঘটিকা। বিকাল ৫ ঘটিকার পর সন্ধ্যা হইতে হাতে সময় থাকে আরো প্রচুর। সেই সময়ে চলে যেতাম মিলের উত্তরে আদিনাথ পাহাড়ে, আদিনাথ পাহাড়ে হিন্দুদের একটি মন্দির ছিল, মন্দিরটির নাম আদিনাথ মন্দির। সময় পেলে'ই ছুটে যেতাম সেই আদিনাথ মন্দিরে। খুবই সুন্দর মন্দিরটি, সেই পাহাড়ের উপর অবস্থিত আদিনাথ মন্দির। সেই মন্দিরে একজন ঠাকুর ছিলেন, আমাকে দেখামাত্র হাসি দিয়ে বলতেন আস আস নিত্যানন্দ, আস আমার কাছে আস বস। ঠাকুর মহাশয়কে আমারও খুবই ভাল লাগিত। কাছে যখন বসতাম তখন তিনি আরো দুইজনকে ডেকে কাছে বসাতেন। শুরু করে দিতেন জন্মকাল হইতে মৃত্যুবরণ প্রর্যন্ত আলাপসালাপ। শুনিতে খুবই ভাল লাগিত কথা গুলো। শুনতাম কিন্তু বুঝতামনা, আমার ছিল কথার দিকে মনোযোগ কম আর দেখার দিকে মনোযোগ বেশী। তিনি আমাদের বুঝাইতে চেয়েছেন মাকে ভালবাস, পিতাকে ভালবাস, মানুকে ভালবাস অনেক বেশী। মনুষের মাঝেই প্রভুত্ব। আজ সেই ঠাকুর মহাশয়ের কথা গুলো মনে পড়িলেই নিজের মনকে নিজে প্রশ্ন করি আমি কি ঠিক আছি?

এই দুনিয়ায় কেউ থাকবেনা ফকির সাধু আর ওলীগণ
রাজা বাদশা চলে গেল ছেড়ে দিয়ে সিংহাসন।

আমার একদিন যেতে হবে সব দিয়ে বিসর্জন।

ছিলাম কোথায় আসলাম কোথায় আবার যাবো কোথায়রে

ডাক পড়িলে যেতে হবে থাকার শক্তি কার আছেরে।

স্বার্থের জন্য মারামারি কাটাকাটি কতইনা কি করেছি,

বিদায় নিব খালি হাতে একবার ও কি ভেবেছি

আমার আমার আমার বলে করছি সদা তবজি জপ,

যে পাঠিয়েছে সে বলে তোর কিছুই নেই আমার'ই সব

"লোভ লালসার প্রেমে পড়ে করছি আমি কত কি,

স্বাদের জনম যাক বিফলে চিন্তা ভাবনার দরকার কি"

জন্ম দিল পিতায় আমার গর্ভে ধরছে জননী,

সুন্দরী রমণীর কুমন্ত্রণায় তাদের কথাও ভাবিনী"

স্বার্থের লোভে দিশাহারা দয়া নাই মোর অন্তরে,

স্বার্থের টানে পাগল হয়ে ছুটেছি মাঠ ঘাট আর প্রান্তরে"

আজকে আমি ক্ষমতাদারী আছে আমার ক্ষমতা,

ক্ষমতাকে পূজি করে রেখেছি হাজার জনতা"

জনতার মহারাজা আমার নেই যে কোন ভয়,

দূ্র্নীতির মন্ত্র দিয়ে করব আমি বিশ্ব জয়"

লোক দেখানে সরলতা সদা আমি ভালো,

কেহ তো জানেনা মোর অন্তর কত কালো"

নিজে বাঁচি নিজে খাই সদা চিন্তা মোর,

এসব চিন্তা করতে করতে রাত্রি করি ভোর"

তবুও ভাবিনা আমি পরকালের কথা,

ভাবতে গেলে দুষ্ট মনে পায় যেন ব্যথা"

লাভের হিসাব করতে করতে আসল হিসাব করলাম না,

দন্ত পড়িল চুল পাকিল গুরুর চরণ ধরলাম না"

চিত্ত হইতে চিতা হল চিতাই আমার ঠিকানা,

চিতার আগুনে করবে শেষ যতই করি বাহানা।