মার্গারিটা মামুন বাংলাদেশে থাকলে কি অলিম্পিকে সোনা জিততে পারতেন?

নিতাই বাবু
Published : 22 Sept 2016, 06:08 PM
Updated : 22 Sept 2016, 06:08 PM

সারা দুনিয়ার মানুষে ব্রাজিলকে চেনে আমাজনের গভীর জঙ্গল, ফুটবল আর সাম্বা নাচের জন্য ৷ ব্রাজিলকে চেনে না এমন মানুষ বর্তমান বিশ্বে খুঁজে পাওয়া দায়, ব্রাজিল ফুটবল মানেই এক স্বপ্নের মায়াজাল, পেলে থেকে নেইমার পর্যন্ত যা প্রবাহিত ৷ ব্রাজিল ফুটবলের সমর্থক আমাদের বাংলাদেশেও কম নয়, বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা শুরু হলেই দেখা যায় ব্রাজিলের সমর্থনকারীদের মিছিল আর ব্রাজিলের পাতাকার বাহার ৷ সময় সময় এসব পতাকা অপসারণের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকেও অনুরোধ জানানো হয়, তারপরেও ওইসব পতাকা অপসারণ করা হয় না ৷

তখন মনে হয় বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদের বাংলাদেশেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে, আর খেলা হচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহরের স্টেডিয়ামগুলোতে ৷ আমাজন নদীর পথ বেয়ে গড়ে ওঠা আদিমতম জঙ্গল আজও গভীর রহস্যের জাল বোনে মানুষের মনে ৷ জায়গার ভয়মেশানো আতঙ্ক, আর সাম্বা মানেই তো উদ্দামতা উৎসব প্রাণের জোয়ারে ভেসে চলা ৷ আবার সাম্বা নাচের প্রাণকেন্দ্র হলো রিও-ডি-জেনেইরো, যেই রিও কার্ণিবাল দেখার জন্য পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে যায় এই শহরের কোপাকাবানায় কয়েক দিন ছুটি কাটানোর জন্য বা ভ্রমণের জন্য, ভ্রমণ আর ছুটি কাটানো মানেই জীবনটাকে সার্থক করা ৷ আর সেই স্বপ্নের শহর রিও-তেই ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট ক্রীয়াযজ্ঞ ৩১-তম অলিম্পিক ও ১৫-তম প্যারালিম্পিক গেইমস ৷ গত ৫ই আগষ্ট ২০১৬ইং শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী মারাকানা স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, শেষ হয় ২১ই আগষ্ট ২০১৬ইং এই স্বপ্নের অলিম্পিক গেইমস ৷ এবার অলিম্পিকে ৩০৬টি সোনার পদকের জন্য লড়েছিলেন ২০৭টি দেশ, বিশ্বের এই ২০৭টি দেশে ১১হাজার ৫৪৪জন ক্রীয়াবিদ অংশ নিয়েছে এই আসরে, তারমধ্যে অাছে একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত মার্গারিটা মামুন ৷

এই সদ্যসমাপ্ত রিও অলিম্পিক নিয়ে কিছু ভাবতে গেলেই ভাবতে হয় আমাদের বাংলাদেশী রাজশাহীর প্রয়াত আব্দুল্লাহ আল মামুন সাহেবের মেয়ে মার্গারিটা মামুনকে নিয়ে ৷ প্রয়াত আব্দুল্লাহ আল মামুন সাহেবের বাড়ি ছিল রাজশাহী দুর্গাপুরের ক্ষিদ্র কাশীপুর গ্রামে, তিনি মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং এ ছিলেন ডিগ্রীধারী ৷ বিয়ে করেছেন রাশিয়ার এক রিদমিক জিমন্যাস্টিক্স কন্যাকে, নাম আন্না ৷ তাদের'ই মেয়ে অলিম্পিক্সে সোনা প্রাপ্ত মার্গারিটা মামুন ৷ বলা হয় বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত মার্গারিটা মামুন ৷ জানা যায়, প্রয়াত আব্দুল্লাহ আল মামুন সাহেব কোন একসময় মার্গারিটাকে অলিম্পিকে বাংলাদেশী হয়ে খেলার জন্য বাংলাদেশ অলিম্পিক ফেডারেশনের কাছে বহু দৌড়ঝাঁপ দেয় ৷ সময়টা ছিল এক এগারো সরকারের আমলে, তখন কাজের কাজ কিছুই হয়নি , মোট কথা প্রয়াত আব্দুল্লাহ আল মামুন সাহেবকে তখন ফেডারেশন পাত্তাই দেয়নি ৷ সেসময় মার্গারিটা মামুনও বাংলাদেশের হয়ে অলিম্পিকে খেলতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল ৷ জানা যায়, প্রয়াত আব্দুল্লাহ আল মামুন সাহেব তখন বিষণ মনকষ্ট নিয়ে মেয়েকে সাথে নিয়ে ফিরে চলে যায় রাশিয়ায়, বহু প্রতীক্ষার পর মস্কোতে জন্ম নেওয়া মার্গারিটা মামুন মায়ের দেশ রাশিয়াতেই নিজেকে খুঁজে পায় একজন রিদমিক জিমন্যাস্টিক্স হিসেবে ৷

২০১৫ সালে মস্কো গ্রাঁ প্রিঁ-তে অল-রাউন্ডার ইভেন্টে স্বর্ণ জয় করা মার্গারিটা অলিম্পিকের এবারের আসরে নিজে চার ইভেন্ট হুপে ১৮.৮৩৩ বলে ১৯.০০০ ক্লাবে ১৭.৫০০ ও রিবনে ১৯.০৫০ একক অল-রাউন্ডে মোট ৭৪.৩৮৩ পয়েন্ট পেয়ে যায় ৷ দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে যায় রাশিয়ার ইয়ানা কুদ্রিয়াভসেভা ৷ জানা যায়, মার্গারিটা মামুন সোনা জিতে নেয় দুটি, একটি রাশিয়ার হয়ে আরেকটি বাংলাদেশের হয়ে ৷ বাবা'র দেশ বাংলাদেশ, তাই নিজেরও দেশ, থাকি রাশিয়ায় তাতে কী হয়েছে, এই পদক দুই দেশের সম্মান, একটি রাশিয়ার আরেকটি বাংলাদেশের ৷ মহান অনুভূতি আর মহামায়ার বহিঃপ্রকাশ, সম্মান পয়সাকড়ি দিয়ে কেনা যায় না ৷ মার্গারিটা মামুন যদি বাংলাদেশের হয়ে অলিম্পিকে খেলতে পারতো, তবে তাঁর জেতা দুইটি সোনা'ই বাংলাদেশের ঘরে চলে আসতো, রাশিয়াকে ভাগ দিতে হতো না ৷ জানা যায়, মার্গারিটা মামুন ফাইনাল খেলার আগে জুনিয়র পর্যায়ে কিছুদিন বাংলাদেশের পতাকা তুলে প্রতিযোগিতা করেছিল, সেটি ছিল অল্প সময়ের জন্য ৷ বাংলাদেশ অলিম্পিক ফেডারেশনের কোন সারা না পেয়ে মস্কোর মেয়ে মার্গারিটা মামুন শেষ পর্যন্ত মায়ের দেশ রাশিয়াকে বেছে নিয়ে ফাইনালে যাত্রা শুরু করে ৷ বাংলাদেশ হয়ে খেলার এত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমাদের অলিম্পিক ফেডারেশন তাকে গ্রাহ্য করেনি ৷ এর কারণেই আজ এই সম্মানের ভাগ দিয়ে দিলাম রাশিয়াকে একটু না ভেবে, মার্গারিটার বাবাকে পাত্তা না দেওয়া কারণে ৷

মার্গারিটা মামুন যেদিন রিও অলিম্পিক্স থেকে সোনা জিতলেন, সেদিন আমাদের দেশের মেয়েই সোনার পদক জিতেছেন সাত সমুদ্র তের নদীর পারের রিও থেকে, আমরা সবাই খুশিতে গদগদ ৷ আর যেসব কর্তারা যেদিন মার্গারিটার বাবা প্রয়াত আব্দুল্লাহ আল মামুন সাহেবকে পাত্তা দেয়নি, মার্গারিটা মামুন সোনা জেতার পরপর সেসব কর্তারা প্রচণ্ড ধাক্কাও খেয়েছিল তাদের খামখেয়ালীর জন্য ৷ কপালে সুখ থাকলে কেউ তাকে দুঃখ দিতে পারেনা এটাই বাস্তব কথা এবং সত্যি কথা ৷ সেদিন বাংলাদেশের ফেডারেশনের কর্তারা পাত্তা না দেয়ার কারণেই মার্গারিটা মামুন চলে যায় রাশিয়ায়, সেখানে গিয়েই হল মার্গারিটা মামুনের সোনা জয় ৷ মার্গারিটা মামুন যদি রাশিয়ায় ফিরে না যেত তাহলে কী হতো? তাহলে এই সোনার পদক মার্গারিটার কপালে না' ও জুটতো ৷

যদি মার্গারিটা মামুন বাংলাদেশে থেকে যেত, তখন আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থায় কি বিকশিত হতে পারত মার্গারিটা মামুন? স্বল্প পোষাকে মার্গারিটাকে দেখে আমরা কি তখন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম? মোটেই না ৷ আবার মার্গারিটা মামুন যে দামী পোষাক পরে পারফর্ম করেন তার খরচ কি আমাদের দেশের অলিম্পিক ফেডারেশন বহন করতো? সেটাই হল ভাবার বিষয় ৷

যেখানে বাংলাদেশর ফুটবলে সদ্য গৌরব কুড়িয়ে লওয়া ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের কিশোরী কন্যারা কত অবহেলার শিকার হচ্ছে পদেপদে ৷ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের খেলার প্রশংসা করে বলেছিলেন, যেখানে ছেলেরা ৫ গোল খায়, সেখানে আমার দেশের সোনার মেয়েরা গোল দেয়, জিতে যায় ৷

তারপরেও আমরা দেখেছি সেসব সোনার মেয়েদের কীভাবে অবেলা করা হয়েছে ৷ তাদের যাতায়াতের জন্য গাড়ি বরাদ্দ নেই, নাম মাত্র গাড়ি ভাড়া দিয়ে তাদের ঢেকে আনা হয়, ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় ৷ তাদের ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ আসা-যাওয়ার জন্য দেয়া হয় সনাতনি মুড়িরটিন বাসের ভাড়া ৷ নানা দিক থেকে পিছিয়ে থাকা ভারত সীমান্তবর্তী ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কলসিন্দুর, সোনার মেয়েদের জন্য এখন সবার কাছে এক পরিচিত নাম ৷ সেই গ্রামের কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি অবস্থিত, এই বিদ্যালয়ের মেয়ে শিশুরা তাক লাগিয়ে দিয়েছে ফুটবল খেলে ৷ দেশে তো বটেই, বিদেশের মাটিতে ও অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে লাল-সবুজ পতাকার গৌরব বাড়িয়ে দিয়েছে তারা ৷ গতবছর এপ্রিলে নেপালের এএফসি অনুর্ধ্ব-১৪ টুর্নামেন্টের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে ১৮ সদস্যের বাংলাদেশ দলে এক সঙ্গে খেলার সুযোগ পায় কলসিন্দুরের ১০ কন্যা, এটা একটা বিশাল গৌরবের কথা ৷

সে মতে মার্গারিটা মামুন তো মস্কোতে জন্ম নেয়া রাশিয়ার নাগরিকতা এক বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত ৷ যেখানে এত সুন্দর গৌরব অর্জনকারী দেশের মেয়েরাই অবহেলার শিকার, সেখানে ভিনদেশে জন্ম নেয়া একজন মার্গারিটার জন্য কি সবকিছু পরিপূর্ণ ভাবে ব্যবস্থা করা থাকত? বাংলাদেশ অলিম্পিক ফেডারেশন কী যথাযথ ভাবে মার্গারিটার জন্য এত ব্যয়বহুল সুযোগসুবিধা দিয়ে রিও অলিম্পিকে পৌঁছাতে পারতেন?
পাঠকের মাতামত একান্ত কাম্য ৷

ছবি সংগ্রহ: গুগল ৷