নারায়ণগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশনে কুমারী পূজার আয়োজন

নিতাই বাবু
Published : 25 Sept 2016, 08:43 PM
Updated : 25 Sept 2016, 08:43 PM

প্রতি বছরের মত এবারও মহাধুমধাম আর উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে নারায়ণগঞ্জের শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ মিশনে অনুষ্ঠিত হবে দূর্গাপূজারই একটি অংশ হিসেবে প্রচলিত কুমারী পূজা ৷ এবার নারায়ণগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশনে দূর্গাপূজার মহাঅষ্টমীর দিনে কুমারী পূজায় দেবীর আসনে বসবে "তুলি আচার্য" নামে ১২ বছর বয়সী একটি মেয়ে ৷ এই কুমারী পূজার কথা ভাবতে গেলেই আগে ভাবতে হয় শারদীয় দূর্গোৎসব বা দূর্গাপূজার কথা ৷ যা আগামী ৭ই অক্টোবর ২০১৬ইং অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আমাদের হিন্দুধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দূর্গোৎসব ৷ এবার 'মা' কৈলাস থেকে মত্যে আসছেন নৌকায়, সাথে আছেন গনেশ, কার্তিক, আর লাক্ষী, সরস্বতী ৷ কুমারী পূজার আগে দূর্গাপূজা নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু উল্লেখ করা দরকার ৷

ছবিখানা ফেসবুক থেকে আপলোড করা ৷
কারণ: মাটিমূর্তি দেবীদূর্গার অঙ্গরূপ বা বাস্তব রূপ হলো এই কুমারী পূজা যা হিন্দুশাস্ত্রের কয়েকটি ধর্মগ্রন্থে প্রমাণ পাওয়া যায় ৷ দূর্গাপূজা বা দূর্গোৎসব হলো হিন্দু দেবীদূর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে প্রচলিত একটি উৎসব যা সমগ্র হিন্দু সমাজেই প্রচলিত তবে বাঙালী হিন্দু সমাজে এটি অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব ৷ এই শারদীয় উৎসবটি আশ্বিন মাসের বা চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ দিন থেকে শুরু করে দশম দিন বা দশমী পর্যন্ত হয়ে থাকে ৷ এই পাঁচটি দিবস যথাক্রমে: "দূর্গাষষ্ঠী" "মহাসপ্তমী" "মহাঅষ্টমী" "মহানবমী" ও বিজয়া দশমী" ৷ আশ্বিন মাসের দূর্গাপূজাকে বলা হয় শারদীয় "দূর্গাপূজা" আর আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষকে বলা হয় "দেবীপক্ষ", এবং চৈত্র মাসের দূর্গাপূজাকে বলা হয় "বাসন্তীপূজা" ৷ আশ্বিন মাসের শারদীয়া দূর্গাপূজার জনপ্রিয়তা বেশি, বাসন্তীপূজার জনপ্রিয়তা কম, কারণ: এই বাসন্তীপূজা কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ৷


উপরে উল্লেখিত পাঁচটি দিবসের কার্যবিবরণী
হিন্দুশাস্ত্রমতে দূর্গাষষ্ঠী: বোধন, আমন্ত্রণ, ও অধিবাস
মহাসপ্তমী: নবপত্রিকা, প্রবেশ ও স্থাপন, সপ্তম্যাদিকল্পারম্ভ, সপ্তমী বিহিত পূজা ৷
মহাঅষ্টমী: মহাঅষ্টমীকল্পারাম্ভ, মহাঅষ্টমী বিহিত পূজা, বীরাষ্টমী ব্রত, মহাঅষ্টমী ব্রতেপবাস, কুমারীপূজা, অর্ধরাত্রবিহিত পূজা, মহাপূজা ও মহোৎসব যাত্রা, সন্দ্ধিপূজা ও বলিদান ৷
মহানবমী: কেবল মহানবমীকল্পারম্ভ, মহানবমী বিহিত পূজা ৷
বিজয়াদশমী: বিজয়াদশমী বিহিত বিসর্জনাঙ্গ পূজা, বিসর্জন, বিজয়াদশমী কৃত্য কুলাচারানুসারে বিসর্জনান্তে অপরাজিতা পূজা ৷

প্রিয় পাঠক, আমরা হিন্দুধর্মাবলম্বীরা দূর্গাপূজার আগমনে আনন্দে সবাই উল্লেসিত হয়ে উঠি 'মা' দূর্গাদেবীকে পূজা করার জন্য 'মা'কে প্রণাম করার জন্য ৷ আসলে আমরা ক'জনে জানি দূর্গা মায়ের প্রণামী মন্ত্র আর পুষ্পঅঞ্জলী দেয়ার মন্ত্র ৷ পূজা উপলক্ষে শহরে বা গ্রামের প্রতিটি পূজামন্ডপে ঘুরে-ঘুরে 'দূর্গা' মা'কে দর্শন করি বা প্রণাম করি শুধু দুহাত জোর করে, আর মনে মনে বলি হে' মা' দূর্গা তুমি আরার মনের বাসনাপূর্ণ করে দায়, আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করো, আমার সংসারে শান্তি দাও ইত্যাদি ইত্যাদি ৷ আসলে আমরা বহু হিন্দুরাই 'মা'দূর্গাকে প্রমাণ করার মন্ত্রটাই জানিনা, তাহলে জেনে নেই 'মা'দূর্গার প্রণামী মন্ত্র আর পুষ্পঅঞ্জলী দেয়ার মন্ত্র ৷

'মা'দূর্গাকে প্রণাম করার মন্ত্র"

"সর্ব মঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ
শরণ্যে ত্রাস্বকে গৌরী নারায়ণী
নমোহস্তুতে নমোঃ"

"দূর্গাপূজায় পুষ্পঅঞ্জলী দেয়ার মন্ত্র"

"ঔঁ জয়ন্তি মঙ্গলা কালী, ভদ্র কালী, কপালিনী
দূর্গা শিতা ক্ষমা ধত্রী, স্বাহা স্বধা নমস্তুতেঃ
এস-স্ব-চন্দন পুষ্প বিল্ব প্রত্রাঞ্জলী নম
ভগবতী দূর্গা দেবী নমহঃ"

"মা'দূর্গা'কে স্মরণ করা বা জাগ্রত করার মন্ত্র"

"ইয়া দেবী সর্বভূতেষু মাতৃ রূপেন সংস্থিতা
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রূপেন সংস্থিতা
ইয়া দেবী সর্বভূতেষু বুদ্ধি রূপেন সংস্থিতা
নমোস্তেসৌঃ নমোস্তেসৌঃ নমোস্তেসৌঃ
নমোঃ নমোঃ"

এ সমস্ত মন্ত্রগুলি আমাদের হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ছোট-বড় সবার জানা থাকা দরকার বলে আমি মনে করি, কারণ: দেবদেবীদের শুধু হাতজোর করে ডাকলে হবেনা, দেবদেবীদের সন্তুষ্টিও করতে হবে মন্ত্রদ্বারা ৷ না হয় এত কষ্ট করে ঘুরে-ঘুরে 'মা' কে প্রণাম করাও একপ্রকার বৃথা বলেই আমার মনে হয় ৷ তবু শাস্ত্রে বলা আছে ভক্তিতে ভগবান অভক্তিতে অপমান, ভক্তির সাথে যদি ধর্মগ্রন্থের নিয়মটা জানা থাকে তাহলে সবচেয়ে উত্তম বলে মনে হয় ৷

এখন কুমারি পূজা নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক, আগেই বলা হয়েছে কুমারী পূজা হলো দূর্গাপূজার একটা অঙ্গরূপ, মাটিমূর্তি দেবীদূর্গার একটা বাস্তব রূপ ৷কুমারী পূজা হলো তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোল বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা ৷ বিশেষত দূর্গাপূজার অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়, এছাড়া ও কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা, এবং অন্নপূর্ণা পূজা উপলক্ষে এবং কামাখাদী শক্তি ক্ষেত্রে কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে ৷

বর্তমানে কুমারী পূজার প্রচলন কমে গেছে, বাংলাদেশে সূদূর অতীত থেকেই কুমারী পূজার প্রচলন ছিলো এবং তার প্রমাণ পাওয়া যায় কুমারী পূজার প্রয়োগ গ্রন্থের পুঁথি থেকে ৷ বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের মত বাংলাদেশের বহু জেলা শহরের রামকৃষ্ণ মিশনগুলোতে কুমারী পূজার প্রচলন বেশি দেখা যায় ৷ প্রতিবছর দূর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজা দিবসে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়, তবে মতান্তরে নবমী পূজার দিনেও এ পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে ৷
শাস্ত্রমতে কুমারী পূজার উদ্বভ হয় কোলাসুর কে বধ করার মধ্য দিয়ে, গল্পে বর্ণিত রয়েছে কোলাসুর একসময় স্বর্গ-মত্যে অধিকার করায় বাকি বিপন্ন দেবগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হয় ৷ সে সকল দেবগণের আবেদনে সাড়াদিয়ে দেবী পূনর্জন্মে কুমারী রূপে কোলাসুর কে বধ করেন ৷ এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয় ৷
যোগিনীতন্য, কুলার্নবতন্য, দেবীপুরাণ, স্তোত্র, কবচ, সহস্রনাম, তন্যসার, প্রাতোষিনী, পুরোহিত দর্পণ ৷ এসকল প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহত্ম্য বিশদ ভাবে বর্ণিত হয়েছে ৷ বর্ণানানুসারে কুমারী পূজায় কোন জাতি, ধর্ম, বা বর্ণভেদ নাই ৷ দেবীজ্ঞানে যে-কোন কুমারীই পূজনীয়, এমনকি বেশ্যাকুল জাত কুমারীও দেবীর আসনে বসতে পারে ৷ তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত হয়ে থাকে ৷ এ ক্ষেত্রে এক থেকে ষোল বছর বয়সী যে-কোন কুমারী মেয়ের পূজা করা যায়, বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে এই সকল কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয় ৷
যেমন:
* এক বছরের কন্যা=সন্ধা
* দুই বছরের কন্যা = সরস্বতী
* তিন বছরের কন্যা= ত্রিধামূর্তি
* চার বছরের কন্যা = কালিকা
* পাঁচ বছরের কন্যা = সুভগা
* ছয় বছরের কন্যা = উমা
* সাত বছরের কন্যা = মালিনী
* আট বছরের কন্যা = কুষ্ঠিকা
* নয় বছরের কন্যা = কাসন্দর্ভা
* দশ বছরের কন্যা = অপরাজিতা
* এগারো বছরের কন্যা = রূদ্রানী
* বারো বছরের কন্যা = ভৈরবী
* তেরো বছরের কন্যা = মহালপ্তী
* চোদ্দ বছরের কন্যা = পিঠনায়িকা
* পনেরো বছরের কন্যা = ক্ষেত্রজ্ঞা
* ষোল বছরের কন্যা = অন্নদা বা অম্বিকা

কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ব হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত ৷ কুমারী প্রকৃতি বা নারীতে জাতির প্রতিক ও বীজাবস্থা, তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয় ৷ এ সাধনাপদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির রূপ ধারণ করে, তাই তার নিকট নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা ৷ পৌরাণিক কল্পকাহীনিতে বর্ণিত আছে এ ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শী জ্ঞানে পূজা করেছিলেন ৷ এবং ইতিহাসে জানা যায়, ১৯০১ সালে ভারতীয় দার্শনিক ও ধর্মপ্রচার স্বামী বিবেকানন্দ সর্বপ্রথম কলকাতার বেলুর মঠে কুমারী পূজার মাধ্যমে এর পূনঃপ্রচলন করেন ৷ তখন থেকে প্রতিবছর দূর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে এ পূজা চলে আসছে যা আজও পর্যন্ত চলছে ৷

দূর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে কুমারী পূজার দিন নির্বাচিত কুমারীকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হয় ৷ হাতে দেয়া হয় ফুল, কপালে দেয়া হয় সিঁদুর এবং পায়ে দেয়া হয় আলতা ৷ ঠিক সময়ে সুসজ্জিত আসনে বসিয়ে ষোড়শোপচারে পূজা করা হয় ৷ পূজার পর অগ্নি, জল, বস্ত্র, পুষ্প ও বাতাস এই পাঁচটি উপকরণে দেওয়া হয় "কুমারী" মা' এর পূজা ৷ অর্ঘ্য প্রদানের পর দেবীর গলায় পরানো হয় পুষ্পমাল্য ৷ পূজার শেষে প্রধান পূজারী দেবীর আরতী নিবেদন করে দেবীকে প্রণাম করবেন, পূজার মন্ত্রপাঠ করে ভক্তদের মধ্যে চরনামৃত বিতরণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় কুমারী পূজার আনুষ্ঠানিকতা ৷

জানা যায়, এবার নারায়ণগঞ্জ সহ সারাদেশে ২৯ হাজার ৩৯৫টি মন্ডপে শারদীয় দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে ৷ তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জে হবে ১৯০টি পূজা, যা গতবছরের চেয়ে এবার পাঁচটি বেশি ৷ আর কুমারী পূজা হবে একটি, প্রতিবছরের মত এবারও রামকৃষ্ণ মিশনে এই কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হবে ৷ নারায়ণগঞ্জ শহরে রামকৃষ্ণ মিশন ছাড়া আর কোথাও এই কুমারী পূজা হয় না ৷
পরিশেষে সকল হিন্দুধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে একটি কথাই বলবো, দূর্গাপূজায় দূর্গা 'মা' কে প্রণাম ও ভক্তি করুন মন্ত্রপাঠে ৷ পুরোহিতের কাছ থেকে সঠিক মন্ত্র জেনে নিন, ভুল মন্ত্রপাঠে পুণ্য নয়, হয় পাপ ৷
পোস্টের ছবি সংগ্রহ: গুগল
তথ্য সংগ্রহ; উইকিপিডিয়া ও সনাতন ভাবনা