১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলস্ এর শ্মশানঘাট সংস্কার অত্যন্ত জরুরী

নিতাই বাবু
Published : 7 Dec 2016, 01:56 AM
Updated : 7 Dec 2016, 01:56 AM

'শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ঘেঁষে খোলা জায়গায় ৭২ বছরের প্রাচীনতম ১নং ঢাকেশ্বরী শ্মশানঘাট।' সামনে একটা প্রাচীনতম হাই স্কুল, পাশে জনসাধারণের যাতায়াতের রাস্তা, দিনের বেলায় মরদেহ দাহ করার সময় গালাগালি করে পথচারী, স্কুল থেকে দৌড়ে আসে স্কুলের দারোয়ান, লাশ পোড়ানো বন্ধ করার জন্য৷

গত ৩১ অক্টোবর থেকে চোখের সমস্যাটা বাড়তে থাকার সাথে সাথে আমার জন্মদাতা বাবার কথা ভীষণভাবে মনে পরতে লাগলো। দিনরাত সবসময় এই চোখের তারায় শুধু স্বর্গীয় বাবাকে দেখছি, মনে হচ্ছিল বাবা যেন অামাকে ডাকছে। বলছে, আয় না, আমাকে একটু দেখে যায়, আমিও তোকে অনেক দিন যাবৎ দেখিনা। কিন্ত আামি যেতে পারছিনা একমাত্র নিজের চোখের সমস্যার কারণে, নারায়ণগঞ্জ আর ঢাকা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একরকম ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। শেষ অবধি গত ২৫শে নভেম্বর খুব সকালবেলা সাথে পরিচিত একজন লোক নিয়ে রওনা দিলাম, নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন উত্তর লক্ষণখোলা ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলস শ্মশানঘাটে, যেখানে আমার বাবার অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করা হয়েছিল।

১৯৪৬ সালে ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলস এর মালিক সূর্য বোস মিলের হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রমিকদের অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করার লক্ষ্যে মিলের পশ্চিম পার্শ্বে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে এই শ্মশানঘাটখানা করে দেয়। যাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রমিকদের কোন আত্মীয়-স্বজন মৃত্যুবরণ করলে, মৃত লাশ নিয়ে কোথাও যেতে না হয়।

শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে উত্তর লক্ষণখোলার সরু পথ হেঁটে ১নং ঢাকেশ্বরী শ্মশানঘাটে পৌঁছাই। শ্মশান ঘাটে পৌঁছে দেখি সেই ছোটবেলার চিত্র, ওই এলাকার রাস্তাঘাট সব কিছুর উন্নয়ন হয়েছে, হয়নি শুধু এই প্রাচীন আমলের গড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্মশানঘাটের। আগেকার মতোই খোলা জায়গা, মাটির উপর কয়টা ইট বিছিয়ে চারকোণায় চারটে লোহার এঙ্গেল গাড়া, সেই প্রাচীনতম শ্মশানঘাটখানা যেন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! অথচ বহু আগেই এই ১নং ঢাকেশ্বরী মিলের মালিকগণ বিদায় নিয়ে চলে গেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগেই তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকার এদেশের মালিকানাধীন মিল কারখানার সম্পত্তিগুলি বাজেয়াপ্ত করে, মালিকদের হাতে একটা হারিকেন ধরিয়ে দিয়ে, সরকারের অধীনে নিয়ে নেয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করার পর, এসব মিলগুলিকে জাতীয়করণ করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বেশ কয়েক বছর পুরোদস্তুর ভাবে মিলগুলো চলছিলো ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। তারপর শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড় আর পশ্চিম পাড়ের ৫/৬ টা বস্ত্র কারখানা লোকসানের কারণে বিক্রি করে দেয়৷ ব্যক্তিমালিকগণ সরকারের কাছ থেকে মিল বুঝে নিয়ে শুরু করে দেয় ভাংচুরের বাণিজ্য, আর উচ্ছেদ অভিযান।

১নং ঢাকেশ্বরী শ্মশানঘাট মন্দির নাই, লাশ স্নান কারানোর মত কোন আলাদা ঘর বা জায়গা নাই, আগে যা ছিল, এখনো সেই আগের মতোই প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই শ্মশানঘাটখানা।

মনে পড়ে সেই ১৯৭৫/৭৬ সালের কথা, মনে পড়ে সেই সময়ের ১নং ঢাকেশ্বরী মিলের বাজারে আর মন্দিরে ঘোরাঘুরির কথা। মিলের ভিতরে ছিল বিশাল দীঘির মত পুকুর, পুকুরের মাঝখানে ছিল দুটি তিনতলা বিশিষ্ট পাকা জলটংগী। শ্রমিকরা মিলের ডিউটি শেষ করে মিল থেকে বাহির হয়ে জলটংগীতে বসে গাঁ জুড়াইত, শরীরটাকে ঠাণ্ডা করে আস্তে ধীরে বাসায় ফিরতো। শ্রমিকদের বসবাসের জন্য ছিল তিনতলা ভবন, শ্রমিকদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য ছিল স্কুল, মুসলমান শ্রমিকদের জন্য ছিল মসজিদ-মাদ্রাসা, হিন্দুদের পূজা করার জন্য ছিল সুবিশাল মন্দির, মিল পরিচ্ছন্ন করার জন্য ছিল সুইপার, তাদের জন্য ছিল আলাদা করে থাকার ব্যবস্থা। যাই হোক ওইসব বর্ণনা না দিয়ে মূল কথায় আসা যাক, কথা হলো ১নং ঢাকেশ্বরী শ্মশানঘাটের সংস্কার নিয়ে।

১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলস এর শ্মশানঘাটে সেদিন সকালবেলা বাবার সমাধিস্থলে, ছোটবেলায় যেভাবে দেখেছি বর্তমানেও একভাবেই আছে শ্মশানঘাটখানা কালের সাক্ষী হয়ে৷ উন্নয়ন বা সংস্কারের ছোঁয়াও লাগেনি এই শ্মশানঘাটে।

এই শ্মশান ঘাটখানার বয়স প্রায় ৭২ বছরের উপরে হবে, বলতে গেলে বলা যায় এটি অতি প্রাচীনতম শ্মশানঘাট। এই শ্মশানঘাটের সংস্কার হয়নি বিধায়, এই উত্তর লক্ষণখোলার সব হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ ও ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলস এর মানুষ এই শ্মশানঘাটে মরদেহ দাহ করতে চায় না। অনেকে লাশ নিয়ে চলে যায় নারায়ণগঞ্জ মাসদাইর কবরস্থান সংলগ্ন পৌর শ্মশানঘাটে৷ তারা লাশ নিয়ে প্রথমে শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে, পায়ে হেঁটে লাশ কাঁধে নিয়ে যায় সেই মাসদাইর পৌর শ্মশানঘাটে, দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার৷ তাহলে কারা এই শ্মশানঘাট ব্যবহার করে? যাদের অর্থকরী তেমন একটা নেই, যাদের নূন আনতে পান্তা ফুরায় তারা এই শ্মশানঘাটে তাদের স্বজনদের মরদেহ দাহ করে, নিরুপায় হয়ে, বাধ্য হয়ে। বর্তমানে ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলস ও উত্তর লক্ষণখোলায় বহু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বসবাস। উল্লেখ করা যায় যে, বর্তমানে এই প্রাচীন শ্মশানঘাটখানা নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় আছে, যা নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২৬নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত।

১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলস শ্মশানঘাটে সাথে নিয়ে যাওয়া ঘনিষ্ঠ একজন স্বজন।

এলাকাবাসীর মুখের কথা: আগে এই শ্মশানঘাট ছিল মিল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে, তারপরে ছিল নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার, এরপর কদমরসূল পৌরসভার আওতায় ছিল দীর্ঘ সময়। এখন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২৬ নং ওয়ার্ডে আমরা বসবাস করছি, শ্মশানঘাটখানাও সিটি কর্পোরেশনের আওতায় একটা সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্থান। সদ্য পদত্যাগকারী মেয়র দুইবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, ওনার উন্নয়নে ছোঁয়ায় নারায়ণগঞ্জ আজ সারাদেশের একটা উন্নয়নের মডেল। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় সকল রাস্তাঘাট ডোবা-নালা ওনার উন্নয়নের ছোঁয়ায় আজ প্রায় পদ্মফুলের মত ফুটন্ত। কোথাও পেঁক-কাদার রাস্তাঘাট নেই, সব রাস্তাঘাটই রড-সিমেন্টের সমন্বয়ে ঢালাই করা রাস্তা৷ অথচ আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্মশানঘাটখানার কোন উন্নয়ন হয়নি বা করার কোন উদ্যোগও নেয়নি। শ্মশানঘাটখানা খোলা জায়গায় হওয়াতে মরদেহ দাহ করার সময়, পাশের রাস্তা দিয়ে পথচারী লোকজনের খুবই অসুবিধা হয়। অনেক সময় মরদেহ দাহকারী লোকের সাথে পথচারী লোকদের সাথে বাক-বিতণ্ডাও বেধে যায়। আবার সামনে আছে একটা প্রাচীনতম হাই স্কুল, স্কুল চলাকালীন সময়ে তো শ্মশানে আগুন দেয়াটা মহামুশকিল হয়ে পড়ে।

ঢাকেশ্বরী মিলস স্কুল এন্ড কলেজ, শ্মশানঘাটের সাথেই সুবিশাল এই নামকরা স্কুলটি। এই হাই স্কুলেই একদিন লেখাপড়া করতাম। আগে এই স্কুলটির নাম ছিল, ঢাকেশ্বরী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়।

এমতাবস্থায় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২৬ নং ওয়ার্ডের উত্তর লক্ষণখোলাস্থ, ১নং ঢাকেশ্বরী শ্মশানঘাটের একটি লাশ স্নান কারানোর পাকাঘর আর চতুর্দিকে বাউন্ডরী (প্রচীর) একান্ত জরুরী হয়ে পরেছে। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের হাওয়া বইছে শহর ছেড়ে শহরের বাইরেও। নির্বাচনে কে হারবে আর কে জিতবে সেটা বড় কথা নয়, নির্বাচনে জয়লাভ করে যেই মেয়র হয়ে আসুক না কেন, আমাদের শুধু একটাই দাবি এই প্রাচীন শ্মশানঘাটের সংস্কার ও উন্নয়ন। যাতে আমাদের কোন আত্মীয়-স্বজন মৃত্যুবরণ করলে মাইলের পর মাইল হেঁটে নারায়ণগঞ্জ শহর ডিঙ্গিয়ে মাসদাইর পৌর শ্মশানঘাটে না যেতে হয়। কথাগুলো বলছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ২৬নং ওয়ার্ডের উত্তর লক্ষণখোলার ঢাকেশ্বরী মিলস এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা।