লাঙ্গলবন্দ অষ্টমী স্নান শুরুর আগে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা জরুরী

নিতাই বাবু
Published : 16 March 2017, 04:52 PM
Updated : 16 March 2017, 04:52 PM

একদিন এক বিকেলে গিয়েছিলাম শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে ঘুরতে । নদী পাড় হয়ে পরিচিত একজনের অটোরকশা করে গেলাম, একেবারে লাঙ্গলবন্দ তীর্থস্থানের কাছাকাছি। ভাবলাম এশীয়া মহাদেশের প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থানের কাছে যখন এসেই পড়েছি, তাহলে একটু ঘুরে দেখে যাই বর্তমানে কী হালে আর কী অবস্থায় আছে এই ব্রহ্মপুত্র নদ? যেখানে পুণ্যলাভের আশায় আসে, দেশ-বিদেশের হাজার-হাজার পুণ্যার্থী!

কচুরিপানার রাজতরু ব্রহ্মপুত্র নদ।

দেখলাম, একসময়ের খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদ একটা মরা খালের মতো, সমস্ত নদীই কচুরিপানায় ভরা । জায়গায়-জায়গায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ভাসমান ড্রেজিং মেশিন, সূক্ষ্ম নদীর পাড়ে রয়েছে অসংখ্য বালুর টিকাদারি ব্যবসা, রাস্তার পাশে নাই কোনো রেলিং । অথচ কয়দিন পরেই শুরু হতে যাছে এই নদের পাড়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পুণ্যস্নানের অষ্টমীস্নান। প্রতিবছর চৈত্রমাসে এমনিতেই নদী থাকে সূক্ষ্ম, চৈত্রমাসে বৃষ্টিও হয় খুব কম, নদীর পানি থাকে ঘোলা।

লাঙলবন্দ তীর্থস্থানের ঐতিহ্যবাহী রাজঘাট দিয়ে নদীর ওপারে যাওয়ার ট্রলার।

তখন নদীর অল্প জলে হাজার-হাজার মানুষ স্নান করতে-করতে নদীর জল হয়ে যায় ঠিক দইয়ের মতো। তবু মনের বাসনা পূরণের আশায় এই কাদা-পানিতে স্নান করে দেশ-বিদেশ থেকে আগত হাজারো পূণ্যার্থী । দেশ-বিদেশ থেকে আগত হিন্দু পূণ্যার্থীদের সুবিধার্থে এখনই উপযুক্ত সময় ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের ড্রেজিং ও কচুরিপানা পরিষ্কার করার । কিন্তু দাবি জানাই কার কাছে? সিটি মেয়রের কাছে নাকি মাননীয় সংসদ সদস্য মহোদয়ের কাছে । কে শুনবে এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কথা, আর কে তাকাবে হিন্দুদের পুণ্যস্থানটির দিকে? অথচ এই পুণ্যস্থানের ইতিহাস সারা পৃথিবী জুড়ে।

ঐতিহ্যবাহী রাজঘাট, পরিতপ্ত অবস্থিতায় পরে আছে মহিলাদের কাপড় পাল্টানোর ঘর।

বাংলাদেশের কোথায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই তীর্থস্থনটি?

এই লাঙ্গলবন্দ পুণ্যস্থানটি ঢাকা থেকে প্রায় ২০ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোল ঘেঁষে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ও নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে দাসের গাঁও গ্রাম পেরিয়ে অবস্থিত। প্রতিবছর চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে এই স্থানে ব্রহ্মপুত্র নদে পুণ্যস্নানার্থে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভক্তপ্রাণের আগমন ঘটে। ভক্তগণের বিশ্বাস এ সময় ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান খুবই পুণ্যের, এ স্নানে ব্রহ্মার সন্তুষ্টি লাভ করে পাপমোচন হয়। এই স্নানই অষ্টমী স্নান নামে পরিচিত।

পুণ্যস্নানে আগত ভক্তদের থাকার জন্য আশ্রম।

মেলায় থাকে ব্যাপক আয়োজন;

স্নান উপলক্ষে লাঙ্গলবন্দের ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই তীর্থস্থানটি বিভিন্ন বয়সের ধর্মপ্রাণ ও পুণ্যার্থী মানুষের কলকোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে। দীর্ঘ এলাকা জুড়ে তিন-চার দিনবাপী এক বিরাট মেলা বসে। এ মেলায় লোকজ ও কারুশিল্প থেকে শুরু করে সব রকম জিনিস পাওয়া যায়। মেলায় আশপাশের অঞ্চল থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন সওদা করতে আসে।

এই রাস্তার ধারে বসে বিভিন্ন রকমের জিনিসের দোকান, সামনে স্নান করার স্নানঘাট।

লাঙলবন্ধ অষ্টমী স্নান সম্পর্কে একটি দীর্ঘ পৌরাণিক কাহিনী ।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, কোন এক দূর অতীতে জমদগ্নি মহামুনির রেনুকা নামে এক রাজবংশীয় পরমাসুন্দরী স্ত্রী ছিল। তাদের ছিল পাঁচ পুত্র। সর্বকনিষ্ঠের নাম ছিল পরশুরাম। ঘটনাক্রমে মার্তিকাবর্ত দেশের রাজাকে সস্ত্রীক জলবিহার করতে দেখে আশ্রমবাসিনী রেণুকা কামস্পৃহ হয়ে পড়েন এবং নিজের পূর্ব-রাজকীয় জীবন সম্পর্কে স্মৃতিবিষ্ট হন। মুনি স্ত্রীর এই আসক্তি দেখে ক্রোধান্বিত হয়ে পাঁচ পুত্রকে তাদের মাতাকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কোন পুত্রই মাতৃহত্যার মতো নিষ্ঠুর কাজ করতে রাজি হলো না। তখন মুনি তার প্রিয় পুত্র পরশুরামকে আদেশ দিলে পরশুরাম এক কুঠারের আঘাতে মাকে হত্যা করেন।


স্নানঘাট।

মাকে হত্যা করে পরশুরাম পরম পাপী হিসেবে চিহ্নিত হন। পাপের শাস্তি হিসেবে কুঠারটি তার হাতে আটকে থাকে। শত চেষ্টা করেও তা থেকে তিনি মুক্ত হতে পারলেন না। তখন পিতা তাকে বিভিন্ন তীর্থস্থানে গিয়ে পাপমুক্ত হতে বলেন। মাতৃহত্যার ভয়াবহ পাপের অনুশোচনা নিয়ে তিনি তীর্থ থেকে তীর্থে ঘুরে বেড়ান।

নতুন করে সংস্কার করা স্নানঘাট।

দেবতা ব্রহ্মপুত্র তখন হিমালয়ের বুকে হ্রদরূপে লুকিয়ে ছিলেন। দৈবক্রমে পরশুরাম ব্রহ্মপুত্রের মাহাত্ম্যের কথা জানতে পারেন। তিনি খুঁজে পেলেন হিমালয়ে লুকায়িত ব্রহ্মপুত্র হ্রদ এবং প্রার্থনা জানালেন যেন এর পবিত্র জলে তার পাপ মুক্ত হয়। তিনি হ্রদের জলে ঝাঁপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতে আটকে থাকা কুঠারখানা খসে পড়ে। এভাবে তিনি মাতৃহত্যার প্রায়শ্চিত্ত থেকে মুক্ত হলেন। ব্রহ্মপুত্রের এই অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন পাপহরণকারী জল যাতে সাধারণ মানুষের উপকারে আসে এ উদ্দেশ্যে পরশুরাম সেই জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন।

স্নানঘাটের সাথে পূজা দেওয়ার মন্দির।

তিনি কুঠারখানা লাঙলের ফলকে বেঁধে সেই ফলক দিয়ে নালা সৃষ্টি করে ব্রহ্মপুত্রের পবিত্র জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ সময় ও পথ পরিক্রমায় পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে তিনি ব্রহ্মপুত্রের জলধারাকে বিভিন্ন জনপদ ঘুরিয়ে অবশেষে বর্তমান লাঙ্গলবন্দে এসে ক্লান্ত হয়ে থেমে যান এবং লাঙল চষা বন্ধ করে দেন। তার লাঙলের ফলকে তৈরি পথ ধরে ব্রহ্মপুত্র প্রবাহিত হতে থাকে। সেই থেকে এ স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্দ এবং তা হয়ে ওঠে হিন্দুধর্মের মানুষের জন্য পরম পুণ্যস্থান। এরপর পরশুরাম এ পবিত্র ব্রহ্মপুত্র নদের অলৌকিক শক্তি ও মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন তীর্থস্থান ভ্রমণে গিয়ে তিনি এই তীর্থস্থানটির কথা মানুষের কাছে তুলে ধরেন।

সূত্র: বাংলাপিডিয়া।

ঐতিহ্যবাহী গান্ধীঘাট।বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংঘটনগুলো পুণ্যার্থীদের সেবা দিতে বদ্ধপরিকর।

সমাগত ভক্তবৃন্দের জন্য স্নান সম্পন্ন করাকে সহজ করার জন্য বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি ঘাট নির্মাণ করেন। বর্তমানে এমন ১৩টি বাঁধানো ঘাট আছে। এই ১৩টি ঘাট হলো প্রেমতলা ঘাট, অন্নপূর্ণা ঘাট, রাজঘাট, বরদেশ্বরী ঘাট, গান্ধীঘাট, জয়কালী ঘাট, পাঠানকালী ঘাট, শ্রীরামপুর ঘাট, কালীবাড়ী ঘাট, কালীদহ ঘাট, শঙ্কর ঘাট, শিখরী ঘাট ও রক্ষাকালী ঘাট। এই ঘাটগুলির পাশাপাশি সেখানে রয়েছে ১০টি মন্দির ও কয়েকটি আশ্রম। স্নানের সময় ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এখানে অসংখ্য মানুষ আসে।

ঐতিহ্যবাহী প্রেমতলাঘাট। নারায়নগঞ্জের লাঙলবন্ধ হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থানের জন্য ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ২০০ কোটি টাকার থোক রবাদ্দের প্রস্তাব করেছিলো সরকার।

অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, নারায়নগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি তীর্থস্থান, যেখানে প্রতিবছর দেশ-বিদেশের অগণিত হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুণ্যস্নান করে থাকেন। তীর্থস্থানটিতে পুণ্যার্থীদের জন্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের প্রয়োজন রয়েছে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে ২০১৬-১৭ বাজেটে ২০০ কোটি টাকা ‌থোক বরাদ্দের প্রস্তাব করছি । সেসময় বাজেট অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী বলেন, ধর্মীয় সম্প্রীতির পরিবেশ নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি । দেশে এখন প্রায় ২৪ হাজার মন্দির আছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ৫০০ মন্দিরে শিশু শিক্ষার প্রকল্প চালু থাকায় এদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো। বাকিগুলোতে অধিকতর মেরামত ও সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।সূত্র; বিজনেস নিউজ পোর্টাল, অর্থসূচক ।

এই বাজেটের পর লাঙলবন্দ পুণ্যস্থানটির বেশ উন্নয়ন হয়েছে ঠিক, হয় নাই নদী খননের কাজ। ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম পাড়ে নতুন করে তৈরি হয় নাই কোনো ঘাঁট। দেশ-বিদেশ থেকে আগত মহিলা-ভক্তবৃন্দেদের স্নান করে কাপড় পাল্টানোর কোনো স্থান বা নতুন করে একটি ঘরও নির্মাণ হয়নি। (যা আছে, সেগুলি বহু আগের যা একসেথে ১০/১২ জন ভক্ত কাপড় পাল্টাতে কষ্ট হয়ে যায়)। স্নান উৎসব চলাকালীন সময়ে সেখানে গেলে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যুবতি আর বুড়ো মহিলারা হাজার-হাজার পুরুষলোকের সামনেই তাদের ভেজা কাপড় পাল্টাচ্ছে বাধ্যতামূলক ভাবে, যা এক লজ্জাজনক ব্যাপার। আবার স্নান উপলক্ষে নদীতে থাকা কচুরিপানা পরিস্কার করারও নেওয়া হয় না কোনো পদক্ষেপ। এদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এসব সমস্যাগুলি দেখবে কে? আর এসব সমস্যা সমাধানের জন্য দাবি জানাই কার কাছে।