নদীমাতৃক বাংলাদেশে শীতলক্ষ্যা বাঁচলে নারায়ণগঞ্জবাসী বাঁচবে

নিতাই বাবু
Published : 1 May 2017, 05:15 AM
Updated : 1 May 2017, 05:15 AM


শীতলক্ষ্যা এখন জীবিত থেকেও মৃত, শীতলক্ষ্যার পানি এখন আর কেউ স্পর্শ করেনা। শীতলক্ষ্যা বাঁচলে যে নারায়ণগঞ্জবাসী বাঁচবে তা সবাই জানে, কিন্তু নদীটিকে বাঁচানোর উদ্যোগ স্বয়ং প্রশাসনই নিচ্ছেনা। তবু শীতলক্ষ্যাকে নিয়ে একটু কান্নাকাটি করতে হয়। কারণ, শীতলক্ষ্যার সাথে আমার গভীর সম্পর্ক অনেক আগের। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যখন আমরা গ্রাম ছেড়ে সপরিবারে নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণখোলা সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলে আসি তখন থেকে। স্কুলে আসাযাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মিলের প্রাচীর ঘেঁষা নদীর পাড়ের পরিত্যাক্ত ছোট জায়গায় কিছু সবজির চারাও রোপন করতাম শখের বশে। আদর্শ কটন মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মিলে আর আমারা থাকতে পারি নাই। মিল ছেড়ে চলে এসেছি ঠিক, কিন্তু শীতলক্ষ্যা আমাকে ছাড়ে নাই। ভাগ্যের টানে যেখানেই গিয়েছি, ঘুরেফিরে আবার এই শীতলক্ষ্যার পাড়েই থাকতে হয়েছে আমাকে। কখনো এপার কখনো ওপারে। শত দুঃখকষ্টের মাঝেও প্রতিদিন একবার আমি শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে গিয়ে বসতাম, এখনো আমার সেই নিয়মটা বলবত আছে। দূরে থাকি আর কাছে থাকি, শীতলক্ষ্যার সাথে আমার মধুর সম্পর্কটা কিন্তু ছিন্ন হয় নাই। সেই সুসম্পর্কের টানে এখনো দিনে একবার শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে গিয়ে বসতে হয়। পাড়ে বসে শীতলক্ষ্যার আগের রূপের সাথে বর্তমান রূপ নির্ণয় করার চেষ্টা করি, আর ভাবি শীতলক্ষ্যাকে নিয়ে।


আগে যেমন সকাল-বিকাল সময় অসময় শীতলক্ষ্যায় ঝাঁপ দিয়ে পরতাম, সাঁতার দিয়ে নদীর ওপারে যেতাম আবার আসতাম, এখন আর তা হয় না। কারণ, শীতলক্ষ্যা এখন জীবিত থেকেও মৃত। শীতলক্ষ্যার এখন আর আগের মতো রূপ-যৌবন নাই। মানুষ মরে গেলে কয়েকদিন পর যেমন দেহটা পঁচে দুর্গন্ধ বের হয়, শীতলক্ষ্যা থেকে ঠিক তেমন দুর্গন্ধ বের হচ্ছে সবসময়। এ যেন এক কুষ্ঠরোগী! শীতলক্ষ্যার পানি সেই আগের মতো কেউ কলসিতে ভরে নেয় না। ছোটবেলায় দেখতাম শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ঘেঁষা গ্রাম থেকে মা-বোনেরা দলবেঁধে আসতো স্নান করতে, সাথে নিয়ে আসতো মাটির কলস আর পিতলের কলস। সবাই স্নান করে যাওয়ার সময় শীতলক্ষ্যার স্বচ্ছ পানি কলসে ভরে নিয়ে যেতো পরিবারের সবার পিপাসা মেটানোর জন্য। শুধু গ্রামের মা-বোনেরাই নয়, শীতলক্ষ্যার পানি নিয়ে যেতো তেলবাহী আর মালবাহী জাহাজের নাবিকরা। শীতলক্ষ্যার পানি ছিল যেমন স্বচ্ছ তেমন পরিষ্কার ও মিষ্টি। এখন সেই দৃশ্য আর চোখে পরেনা কারোর, পরবেও না কোনোদিন। কারণ, শীতলক্ষ্যা এখন জীবিত থেকেও মৃত, শীতলক্ষ্যার এখন জীবন নেই।


শীতলক্ষ্যার বুক থেকে এখন পশু মরা পঁচা দুর্গন্ধ বের হয়, পঁচা দুর্গন্ধে আশেপাশের বাতাস ভারী হয়ে যায়। যেই পানির গন্ধে দম যায়, সেই পানি জাপানের তৈরি সুবিশাল পানি শোধনাগারেও শোধন করতে হিমশিম খায়। তাই এখন আর কেউ শোধন করা ছাড়া শীতলক্ষ্যার পানি পান করেনা ভয়ে, করলেই নির্ঘাত মৃত্যু। কেউ স্নান করতে আসেনা শরীরে ঘাঁ হবার ভয়ে। কোনো ফসলি জমিতেও শীতলক্ষ্যার পানি দেয়না কৃষকেরা। বর্তমানে শীতলক্ষ্যার পানি ফসলি জমিতে দিলে জমিতে রোপণ করা ফসলি গাছ মরে যায়। আগে দেখতাম, বিদেশ থেকে ইংরেজদের সাথে মেমসাহেবরা আসতো স্পিডবোট নিয়ে শীতলক্ষ্যায় আনন্দ করার জন্য। স্পিডবোডের পিছনে রশি বেঁধে পায়ে লম্বা জুতোর মতো লাগিয়ে পানির ওপরে রশি ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো। স্পিডবোট শোঁ শোঁ করে ছুটে চলতো, পিছনে রশি ধরে হাফ প্যান্ট পড়া একজন মেমসাহেবও স্পিডবোট এর সাথে সাথে দৌঁড়াতো। এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে ওইসব কথা বললে ওরা মনে মনে বলবে যা বলছি সবই রূপকথার গল্প। সেজন্য আর কারো কাছে ওইসব কথা বলি না, সত্য বলেও হবো মিথ্যেবাদী।


তাই আর কারো কাছে না বলে মাঝেমাঝে শীতলক্ষ্যার কাছে গিয়ে নিজেই মনে করতে থাকি শীতলক্ষ্যার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। মনে করতে থাকি সেই আগের স্মৃতিগুলোকে, দেখতে থাকি শীতলক্ষ্যার পাড় যে আজ মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করছে সেই দৃশ্য। যেখানে ছিল ফসলি জমি, সেখানে আজ বর্জ্যের স্তুপ আর ময়লার ভাগার। নাই পালতোলা গয়না নৌকা, দেখা যায়না দিনরাত জেলেদের মাছধরার জাল ফেলার দৃশ্য। বর্ষার আগমনের আগে দেখা যেতো নদীর পাড় ঘেঁষে জেলেদের বাঁশ দিয়ে ঘেরাও করা চাক। সেই চাক থেকে বড়বড় মাছ ওঠানোর দৃশ্য আর কারোর নজরে পড়েনা। যেই দূষিত পানিতে পোকামাকড় বাঁচেনা, সেখানে মাছ থাকবে কী করে?

মাছ না থাকার করণে শীতলক্ষ্যার পাড়ের জেলেরা আজ নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাঁরা ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে পদ্মা-মেঘনা পেরিয়ে দূরে কোথাও জলাশয়ে গিয়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে। ছেলেপিলে নিয়ে দিন কাটাচ্ছে কোনরকমভাবে। শীতলক্ষ্যার পাড়ে বহু জেলেপাড়া আছে, তারমধ্যে একটা জেলেপাড়ার নাম, গোদনাইল 'হাজারীবাগ' জেলেপাড়া। বর্ষার শুরুতে তাঁদের ঘরে ঘরে ছিল আনন্দমুখর পরিবেশ, সময় অসময়েও ছিল তাদের পূজাপার্বণের ধুম। এখন আর তাদের সেই আনন্দ নেই, অর্থাভাবে নিয়মের পূজাই করতে পারেনা, অতিরিক্ত খরচ করবে কীভাবে? তাদের মাছধরার নৌকাগুলো সবসময় ঘাটেই বাঁধা থাকে। ওরা আর মাছধরার নৌকা নিয়ে রাতের আঁধারে হারিকেন জ্বালিয়ে শীতলক্ষ্যায় গিয়ে মাছ ধরে না, ওরা চলে যায় দূরে কোথাও অচেনা নদীতে।


আগের মতো নদীর প্রস্থতাও নাই, নদীর নব্যতা হারানোর সাথেসাথে বেদখলও হয়ে যাচ্ছে নদীর পাড়। নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠেছে বিশাল বিশাল মিল ইন্ডাস্ট্রিজ। সেসব মিল ইন্ডাস্ট্রিজের নির্গত বিষাক্ত কেমিক্যালের পানি গড়াচ্ছে শীতলক্ষ্যার বুকে। নিধন হচ্ছে মাছ, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, মরছে জেলে সম্প্রদায় আর পানি খেয়ে রোগাক্রান্ত হচ্ছি আমরা ও আমাদের সন্তানরা। তবু নিরুপায় হয়ে শহরে বসবাসকারী মানুষ এই শীতলক্ষ্যার দূষিত পানি পান করে যাচ্ছে। কেউকেউ আবার এই আধুনিক সময়ে শীতলক্ষ্যার দূষিত পানি পান করেনা, যাদের টাকা আছে। তারা বাজারের (মিনারেল ওয়াটার) ফিল্টার পানি পান করে সবসময়। মরছি শুধু আমরা অসহায় গরিব মানুষেরা, যাদের সীমিত আয়ের মধ্যে সংসার চলে। আগে দেখতাম নদীর মাঝখানে ড্রেজিং শিপ, মাসের পর মাস ধরে নদী ড্রেজিং করতো, এখন আর ওইসব চোখে পরেনা। অথচ শীতলক্ষ্যার পাড়েই ড্রেজার সংস্থা, যা হাজীগঞ্জ কিল্লার পুল সংলগ্ন সুবিশাল ড্রেজার অধিদফতর। এই ড্রেজার সংস্থায় আছে ড্রেজার শিপ ও ড্রেজার মেশিন মেরামত করার কারখানা, এটিকে ড্রেজার ওয়ার্কশপও অনেকে বলে থাকে। নদীতে ড্রেজিং নাই বলে বর্তমানে নদীর গভীরতা দিনদিন কমে যাচ্ছে, বাড়ছে পাড়ের প্রস্থ, আর দিনদিন ছোট হয়ে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যা।


শীতলক্ষ্যা নদী বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নরসিংদী গাজীপুর, ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি নদী। যেই নদীটি নারায়ণগঞ্জের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলছে। জানা যায়, নদীটির দৈর্ঘ্য ১০৮ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ২২৮ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা 'পাউবো' কর্তৃক শীতলক্ষ্যা নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর ৫৫ উত্তর কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী। এই নদী দিয়ে আগে গাজী ইস্টিমার সহ ছোট ছোট লঞ্চ যাতায়াত করতো। এখন দুএকটা তেলবাহী জাহাজ আর অসংখ্য বালুবাহী কার্গো ট্রলার চলাচল করে। এই নদীটি ব্রহ্মপুত্র নদের একটি উপনদী। এর গতিপথের প্রাথমিক পর্যায়ে এটি দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পরে নারায়ণগঞ্জের পূর্ব দিয়ে কালাগাছিয়ার কাছে ধলেশ্বরী নদীর সাথে গিয়ে মিশেছে। আগে রাতেরবেলায় যখন ঘুমিয়ে থাকতাম, নদী দিয়ে চলা তেলবাহী জাহাজের ভেঁপুর শব্দে পিলে চমকে ওঠাতো। সেসব জাহাজের মাস্তুলের আঘাতে নদীর ওপর দিয়ে টানা টিএন্ডটির তারও ছিঁড়ে গিয়েছিল কোনো একসময়। সেসব বড় জাহাজ এখন আর শীতলক্ষ্যা নদীতে আসেনা ভয়ে। কারণ, যদি জাহাজ মাটিতে ঠেকে যায় তাই। একবার দেখলাম, নদীর সীমানা নির্ধারণ করে নদীর পাড়ে সীমানা-পিলার স্থাপন করছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ।


সীমানা পিলার হয়েছে ঠিক, এখন সেই পিলারগুলি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কিছুকিছু পিলার হেলে ধূলে পড়ে যাচ্ছে, এগুলো মনে হয় কোনো একসময় নদীর পলিমাটির নীচে চাপা পড়ে যাবে। অনেকদিন আগে খবরের কাগজে দেখলাম, ইকোপার্ক নির্মাণ কাজ শুরু করতে যাচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ। সিদ্ধিরগঞ্জের কাঁচপুর ব্রিজের পশ্চিম তীরে শিমরাইল মৌজায় কয়েকবছর ধরে চলছে এর প্রস্তুতি। এখানে লাগানো হবে কয়েকশ গাছ, বর্তমানে সেই কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। যদি এই কাজটি সম্পন্ন হয় তবে খুব সুন্দর হবে, এমন করে যদি শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপশ্চিম দুই পাড়ে পার্ক নির্মাণ করা হয়, তখন নদীর সৌন্দর্য আরো বেড়ে যাবে। কিন্তু তা-কি কখনো হবে? মনে হয় না। একসময়ের খরস্রোতা নদী শীতলক্ষ্যার কান্না কী কেউ শুনবে? তাও জানা নাই। তবু লিখে যাই শীতলক্ষ্যাকে নিয়ে, গেয়ে যাই শীতলক্ষ্যার গান, যতদিন দেহে থাকে মোর প্রাণ।


নদীর এই করুণ অবস্থার মধ্যেও বর্তমানে শীতলক্ষ্যার পাড়ে গড়ে ওঠা শিল্প মালিকরা আরো বেশি করে শীতলক্ষ্যার বুকে বিষাক্ত কেমিক্যাকের পানি ঢেলে দিয়ে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে দিনরাত, মাসের পর মাস আর বছরের পর বছর। তাঁদের পানি শোধন করার প্রজেক্ট করা থাকতেও তাঁরা ওই প্রজেক্ট ব্যবহার করেনা খরচের ভয়ে। তাঁরা মানছে না নদী আইন আর পরিবেশ দূষণ আইন। (নদীর অবৈধ দখল, পানি ও পরিবেশ দূষণ, শিল্প কারখানা কর্তৃক সৃষ্ট নদী দূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণ ও নানাবিধ অনিয়ম রোধকল্পে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখা)। যদি আগে থাকতে ওইসব অনিয়ম রোধ করা না যায়, তবে কোনো একসময় হারিয়ে যাবে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শীতলক্ষ্যা সহ আরো অনেক নদী। যে কারণে বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। সেই নাম ইতিহাসের পাতা থেকে একদিন হারিয়ে যাবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন এইডের উত্থাপিত তথ্যমতে, এই বদ্বীপে মোট তেরশ নদী ছিল। শুধু গত একশ বছরের হিসাবেই মরে গেছে ৭শ নদী। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে 'মাছে ভাতে বাঙালি' নামে আমাদের সেই ঐতিহ্যও। আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে হলে আগে আমাদের নদী বাঁচাতে হবে, শীতলক্ষ্যাকে বাঁচাতে হবে। শীতলক্ষ্যা বাঁচলে আমরা বাঁচবো, শীতলক্ষ্যা বাঁচলে নারায়ণগঞ্জবাসী বাঁচবে।