আমার প্রথম দেখা ছায়াছবি এবং বর্তমান চলচ্চিত্রের হালচাল ও সিনেমা হল!

নিতাই বাবু
Published : 5 June 2017, 00:54 AM
Updated : 5 June 2017, 00:54 AM

কোনো একসময়ের গুলশান সিনেমা হল। এর আশেপাশে সকাল থেকেই থাকত শতশত লোকের আনাগোনা। এখন নীরব, শুধু কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই সিনেমা হলটির সামনেই ডায়মন্ড সিনেমা হল, সেটিও এখন বন্ধ।

ক'দিন আগে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম আমার বড়দি'র বাসায়। বড়দি'র বাসা থেকে সামান্য একটু দূরেই গুলশান সিনেমা হল। এই সিনামা হলের সামনে দিয়েই দিদি'র বাসায় যেতে হয়। যখন গুলশান সিনেমা হলের সামনে দিয়ে যেতে থাকি তখনই মনে পড়ে সেসময়ের কথা, যেসময় এই গুলশান সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে আসতাম। একটা টিকেট সংগ্রহের জন্য কতরকম চেষ্টা চালাতাম তা লিখে শেষ করা যাবেনা। তবু লিখবো একসময়ের সিনেমা দেখা আর এদেশে অতীত বর্তমান চলচ্চিত্র ও সিনেমা হল নিয়ে কিছু কথা।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস আমার জন্মেরও ৭/৮ বছর আগের, যেহেতু আমার জন্ম ১৯৬৩ সালে। আর বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র 'মুখ ও মুখোশ' ছায়াছবিটি মুক্তি পায় ৩ আগস্ট ১৯৫৬ সালে। এ অঞ্চলের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে আলোড়ন তৈরি করে মুখ ও মুখোশ। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন আবদুুল জব্বার খান। আজ থেকে প্রায় ৬৪ বছর আগে বর্তমান আজাদ প্রেক্ষাগৃহে (তৎকালীন মুকুল প্রেক্ষাগৃহ) ছবিটির প্রথম প্রদর্শনী হয়। জানা যায়, প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। ছবিটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় একযোগে মুক্তি পেয়েছিল।

বাংলাদেশের প্রথম ছায়াছবি 'মুখ ও মুখোশ' এর পোস্টার। ছবি সংগ্রহ গুগল থেকে।

চলচ্চিত্রের কথা বলতে গেলে আগে বলতে হয় এর পূর্বসূরি বায়োস্কোপের কথা। যা আমরা ছোটবেলায় দেখতাম, হাটবাজারে বা কোনো ঐতিহ্যবাহী মেলায় অথবা নিজেদের বাড়ির উঠানে। বায়োস্কোপের সাথে বাঙালিকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মতো বিশেষ কোনোকিছুর নেই। বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের আগেপাছে গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে খুবই এক পরিচিত নাম বায়োস্কোপ। শুধু গ্রামেই এর পরিচিতি ছিলনা, শহরের অলিগলিতে আর বিভিন্ন লোকজ মেলায়ও ছিল এর পরিচিতি। ১৯৮০ দশকের পর যাদের জন্ম, তাদের কাছে মনে হতে পারে বায়োস্কোপ একটি খেলনার বাক্স। আসলে তখনকার সময়ে এই বায়োস্কোপ মোটেই খেলনার বাক্স ছিলনা। সত্যিকারার্থে এই বায়োস্কোপেই ছিল তখকার আমলের গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে সিনেমা হল। বায়োস্কোপের বাক্সটা মাথায় নিয়ে বায়োস্কোপওয়ালারা হাতে একটা ঝুনঝুনি বাজিয়ে রাস্তা দিয়ে যখন হেটে যেত, তখন তার পেছনে পেছনে ছোটছোট ছেলেমেয়েরা বায়োস্কোপ দেখার স্বপ্ন নিয়ে দৌড়াতে থাকতো।

বাংলার বায়োস্কোপ, যা একসময় ছিল গ্রামবাংলার মা-বোনদের সিনেমাহল। ছবি সংগ্রহ গুগল থেকে।

আমি নিজেও কোনো একসময় বায়োস্কোপ দেখার জন্য দৌড়াতাম, বায়োস্কোপ দেখতাম ধান না হয় চাউল দিয়ে। বায়োস্কোপওয়ালা থাকতে থাকতে দৌড়ে আসতাম বাড়িতে, প্রথমে মায়ের কাছে চাইতাম দুই আনা পয়সা অথবা ধানচাল। মা যদি দিতে অমত করতো, পরে আবদার করতাম বড়দি'র কাছে। ব্যাস, হয়ে গেল বায়োস্কোপ দেখার খরচ, দৌড়ে যাতাম বায়োস্কোপের সামনে, দেখতাম বায়োস্কোপ। এখন আর সেই বায়োস্কোপ চোখে পড়েনা। টিভি, ভিসিডি আর আকাশ সংস্কৃতির সহজলভ্যতার কারণে এই বায়োস্কোপ আজ হারিয়ে গেছে। কয়েকবছর পর এই বায়োস্কোপ যাদুঘরে প্রদর্শিত করা বা স্মৃতি করে রাখার জন্য কোথাও খুঁজে পাবেনা।

বায়োস্কোপের যুগ শেষ করে আমরা পা রেখেছি চলচ্চিত্রের যুগে, চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় সিনেমাহলে, এই চলচ্চিত্রও কোনো একদিন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে কালের বিবর্তনের সাথে তালমিলিয়ে। যাক সেটা পরের কথা, এবার চলচ্চিত্র নিয়ে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে।

সিনেমা হলে গিয়ে যখন সিনেয়া দেখতাম, তখন চলচ্চিত্র কী এবং কীভাবে এর নির্মাণ কাজ তা আমার জানা ছিলনা। শুধু বুঝতাম চলচ্চিত্র হলো সিনেমা মুভি বা ছায়াছবি আর কী? বর্তমান ডিজিটাল যুগের অনলাইনে বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে বুঝলাম, চলচ্চিত্র এক প্রকারের দৃশ্যমান বিনোদন মাধ্যম। চলমান চিত্র তথা "মোশন পিকচার" থেকে চলচ্চিত্র শব্দটি এসেছে। এটি একটি বিশেষ শিল্প মাধ্যম। বাস্তব জগতের চলমান ছবি ক্যামেরার মাধ্যমে ধারণ করে বা এনিমেশনের মাধ্যমে কাল্পনিক জগৎ তৈরি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। বাংলায় চলচ্চিত্রের প্রতিশব্দ হিসেবে ছায়াছবি, সিনেমা, মুভি বা ফিল্ম শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়। এবার আলোচনায় আসি আমাদের দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে, কখন শুরু এবং বর্তমান অবস্থা কী?

ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণ

১৯২৭-২৮ সালে ঢাকায় প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। নওয়াব পরিবারের কয়েকজন তরুণ সংস্কৃতিসেবী নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র সুকুমারী। এর পরিচালক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন ক্রীড়াশিক্ষক অম্বুজপ্রসন্ন গুপ্ত। চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা ছিলেন খাজা নসরুল্লাহ ও সৈয়দ আবদুস সোবহান। উল্লেখ্য তখন নারীদের অভিনয়ের রেওয়াজ চালু হয়নি। নাট্যমঞ্চের নারীচরিত্রেও পুরুষেরাই অভিনয় করতেন। ছোটবেলায় আমি নিজেও দেখেছি অনেক যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক। দেখেছি সেসব যাত্রাপালায় ও মঞ্চনাটকে কোনো মেয়ে নায়িকা রূপে ছিলনা, অভিনয়ে যারা ছিল সবাই পুরুষ। ম্যাকাপ আর পরচুলা ব্যবহার করে মেয়ে রূপধারণ করে সেসব যাত্রা আর মঞ্চনাটকে অভিনয় করতো পুরুষেরা। আমি যখন কক্সবাজার সংলগ্ন মহেশখালী লবণের মিলে চাকরি করতাম, তখন সেই মিলে আমরা শ্রমিকেরা যাত্রাপালা করেছিলাম। যাত্রাপালার নাম ছিল 'চাঁদ কুমারী ও চাষার ছেলে'। সেই যাত্রাপালায় নায়িকা চাঁদ কুমারীর অভিনয় করানো হয়েছে মিলের এক ২০ বছর বয়সী ছেলেকে দিয়ে। এমনভাবে মেকআপ করা হয়েছে, কেউ ধরতেও পারেনি যে এটা পুরুষ। পরদিন এলাকার সবাই আমাদের জিজ্ঞেস করছিলেন, এই নায়িকা আমরা কোত্থেকে এনেছিলাম।

১৯৫৬ সালের কোনো একসময় আবদুল জব্বার খান পরিচালিত বাংলাদেশের প্রথম সবাক বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ মুক্তির মধ্যদিয়ে শুরু হয় এদেশের চলচ্চিত্রের পথচলা। পরিচালক নাকি নিজেই নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। নায়িকা চরিত্রে ছিলেন চট্টগ্রামের পূর্ণিমা সেন। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন ইনাম আহমেদ, নাজমা (পিয়ারী), জহরত আরা, আলী মনসুর, রফিক, নুরুল আনাম খান, সাইফুদ্দীন, বিলকিস বারী প্রমুখ। চিত্রগ্রাহক কিউ এম জামান, সুরকার সমর দাস, কণ্ঠশিল্পী আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসানাত এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধু, পরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি) এর উত্থাপিত বিলের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হলে এর সহযোগিতায় ১৯৫৯ সালে থেকে প্রতিবছর চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে। এফডিসি ছাড়াও পপুলার স্টুডিও, বারী স্টুডিও এবং বেঙ্গল স্টুডিও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিরাট ভূমিকা পালন করে।

এফডিসি প্রতিষ্ঠার পরে চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় অনেক যোগ্য ব্যক্তি এগিয়ে আসেন। ১৯৫৯ সালে ফতেহ লোহানীর আকাশ আর মাটি, মহিউদ্দিনের মাটির পাহাড়, এহতেশামের এদেশ তোমার আমার এই তিনটি বাংলা চলচ্চিত্র ছাড়াও এ জে কারদারের জাগো হুয়া সাভেরা উর্দু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের শুরুর দশকে নির্মিত পাঁচটি চলচ্চিত্রের প্রতিটিই নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শিল্পমানে উত্তীর্ণ বলেই চলচ্চিত্রবোদ্ধারা মনে করেন। অর্থাৎ আমাদের চলচ্চিত্রের অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল শুদ্ধতার অঙ্গীকার নিয়েই। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। বেবী ইসলামের তানহাও উর্দু ভাষার নির্মিত। এটি ১৯৬০ সালে সেন্সর সার্টিফিকেট পায় কিন্তু মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে। জানা যায় উইকিপিডিয়া থেকে

১৯৭২ সালে মোস্তফা মেহমুদ পরিচালিত এফডিসি থেকে মুক্তি পায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ছায়াছবি 'মানুষের মন'। এতে অভিনয় করেন নায়করাজ রাজ্জাক, ববিতা ও আনোয়ার হোসেন। আমার বয়স ৮/৯ বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সাল, দীর্ঘ নয়টি মাস যুদ্ধের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের একবছর অতিক্রম করছিল। সেসময় আমরা সপরিবারে আমাদের বাড়ি নোয়াখালীতে থাকি, বাবা আর বড়'দা থেকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন আদর্শ কটন মিলে। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম, ভালমন্দ বুঝার একটুআধটু জ্ঞান তখন আমার হয়েছে। একদিন আমার মাসিমা আর বড়মামা আমাদের বাড়িতে আসেছিল বেড়াতে। বড়মামাকে দেখে আমরা বাড়ির সবাই মামার কাছে আবদার করলাম সিনেমা দেখার জন্য। আমাদের আবদারে মামা রাজি হয়ে বাড়ির সবাইকে নিয়ে চৌমুহনী দর্পণ সিনেমা হলে নিয়ে যায় সিনেমা দেখানোর জন্য। আহ! কী আনন্দ সবার, সাথে মা, মাসিমা, আমার জেঠিমা, কাকী, দুইজন বড়দিদি। সকাল ৯ টায় মর্নিং শো, ছায়াছবি 'মানুষের মন'

১৯৭২ সালে নির্মিতি ছায়াছবি 'মানুষের মন' এর পোস্টার। আমার জীবনে সিনেমাহলে প্রথম দেখা ছায়াছবি।

তখন নোয়াখালীর দর্পণ সিনেমা হল ইট সিমেন্টের ছিলনা, ছিল টিনের বেড়া। মামা সবার জন্য টিকেট কিনে এনে সবাইকে নিয়ে সিনেমা হলের ভিতরে সিটে বসালো। সবাই সিটি বসলেও আমার ভাগ্যে আর সিট জুটেনি, আমি আমার মায়ে কোলে বসা। তখন টাকার খুব দাম! সবাইকে সিনেমা দেখানো তো মামার দম যায়যায় অবস্থা। সিনেমার শো শুরু হলো, সিনেমা দেখলাম। আমার জীবনের প্রথম ছায়াছবি মায়ের কোলে বসে দেখা 'মানুষের মন'

তার কিছুদিন পর আমরা সপরিবারে নোয়াখালী থেকে ঘরবাড়ী নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে চলে আসি নারায়ণগঞ্জে। বড় হতে থাকি আরো দশজন ছেলেপেলের সাথে হেসেখেলে। বহু ছায়াছবি দেখেছি টেলিভিশনে আর সিনেমাহলে গিয়ে।

আমাদের চৌধুরীবাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতে প্রথমেই চোখে পড়ে 'নিউ মেট্রো সিনেমাহল' এটিও এখন বন্ধ। আগে সবসময় ছিল লোকে লোকারণ্য, এখন নীরব নিস্তব্ধ।

সেসময় একটা ছায়াছবি মুক্তি পাওয়ার একমাস আগে থেকে রেডিও টেলিভিশনে এডভার্টাইজিং করা হতো সিনেমায় দর্শক বাড়ানোর জন্য। তখন এমন একটা সময় ছিল যে, সিনেমা সবার কাছে ছিল গ্রহণযোগ্যতা। সিনেমা দেখার জন্য মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই একসাথে হলে গিয়ে সিনেমা উপভোগ করতো। তখন মানুষের মনে সিনেমা ছিল আনন্দের, শখের, আস্তে আস্তে সেই আনন্দ আর শখ নষ্ট হতে শুরু করে যখন ভিসিয়ারের আগমন ঘটে।

বেশিরভাগ মানুষ তখন ভারতীয় ছায়াছবির দিকে ঝুকে পরে, বাংলা ছায়াছবি থেকে মুখ ফেরাতে থাকে। উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেনী কেন সিনেমা হল বিমুখী হওয়া শুরু করলেন, তার একটা কারণ মোটামুটি সবারি জানা, স্যাটেলাইট চ্যানেল এর আগমন, ভারতীয় চলচ্চিত্র এর গ্ল্যামার এ মোহাবিষ্ট বাংলাদেশী দর্শকশ্রেণী, আর ফলাফল অবহেলিত দেশীয় চলচ্চিত্রের দৈন্যদশার শুরু।

আমাদের শিক্ষিত শ্রেণী থেকে যখন হল বিমুখী হওয়া শুরু করলেন, ঠিক তখন থেকেই সিনেমার সাথে সাথে হলগুলোর পরিবেশও খারাপ হওয়া শুরু করলো। অবস্থা এতটাই খারাপ হল যে, আমি নিজেও যদি কোনোদিক সিনেমাহলে যাই, তাহলে অন্তত কয়েকবার এদিক সেদিক ভালো করে দেখে নেই, কেউ আবার দেখে ফেললে তো বিপদ। আবার হলে গিয়ে সিটে বসে যদি দেখি পাশের সিটে বসা আমার ছেলের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু, তাহলে তো একেবারেই মানইজ্জত শেষ।

চৌধুরীবাড়ি 'বন্ধু সিনেমাহল' গত কয়েকমাস আগে এটিও বন্ধ হয়ে যায় দর্শক অভাবে।

এর কারণ হলো বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিককার বাংলা চলচ্চিত্রের নাম যদি হয় নগ্ন হামলা, খাইছি তোরে, বোমা হামলা, লাল কোট কালো চশমা ইত্যাদি ইত্যাদি, তাহলে বুঝাই যায় যে এসব ছায়াছবিতে কী দেখাবে। ছবিতে দেখা যায় বিশ্রী ভাষায় গালাগালি, অর্ধনগ্ন নাচগান আর কাটপিসের ছড়াছড়ি। আবার খ্যাতিমান নায়ক-নায়িকাদের দেশত্যাগ ও চিত্রজগত ছেড়ে দেওয়া, নায়ক-নায়িকার অভাব, যা ছিল শাকিব নির্ভর বাংলা চলচ্চিত্র, বর্তমান সময়ে তাকেও করেছে নিষিদ্ধ।

বাংলা চলচ্চিত্র হালচিত্র বুঝতে মোটেই বেগ পেতে হবে না, যদি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের মতো করে সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায়। না হয় আর কখনো বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালী সুদিন ফিরে আসবে না, মানুষ সিনেমা হলের কথাও মনে রাখবে না। এই সময়ের মধ্যেই মানুষের মন থেকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেছে বাংলা ছায়াছবি দেখার ইচ্ছা আর স্বাদ, আনন্দ। বেশিরভাগ সিনেমাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে দর্শকের অভাবে।

দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে তো আছেই, প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রায় সবগুলো সিনেমাহল এখন আর নেই। কোনোকোনো সিনেমাহলের জায়গায় এখন সুবিশাল মার্কেট, নাহয় গার্মেন্টস। করার কিছুই নেই, দর্শক ছাড়া মাসের পর মাস সিনেমাহলের কর্মচারীদের বেতন, নানাবিধ খরচাদি বহন করা মালিক পক্ষের দ্বারা সম্ভব নয়, যদি সিনেমাহলে দর্শকই না আসে। যারা দর্শক, তারা আজ ডিশএন্টেনা সংযোগিতায় ঘরে বসেই দিনেরাতে শ'খানেক ছায়াছবি দেখতে পারে। তাহলে কষ্ট করে হলে যাবে কেন? আর আমাদের দেশের চলচ্চিত্রে তো আগের মতো সামাজিক কাহিনী নাই। আছে ডিজিটাল যুগের ফুফা আর নগ্ন নৃত্যের ঝলকানি, যা সপরিবারে একসাথে বসে দেখা যায়না।

একটা সময়ে অশ্লীল চলচ্চিত্রের দৌরাত্ম্য দেখা গিয়েছিল যে, সেই দুর্গন্ধটা মনে আজীবন বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের গায়ে থেকেই গেল। সেই দুর্গন্ধ দূর করতে হলে চাই সুস্থ্যধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ করা, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের তৈরি চলচ্চিত্রগুলি অনুসরণ করা, নতুন নতুন নায়কনায়িকা খুঁজে বের করা জরুরী। তা নাহলে এদেশ থেকে একদিন বাংলা চলচ্চিত্রের নাম মুছে যাবে, সেই নাম আর কোনোদিন জেগে উঠবে না। তাই ভাবি আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি কবে দেখব? নাকি সেই দেখা এই জন্মমেও দেখা হবে না। যেসব সিনেমা হল বিলুপ্তি হয়ে গেছে, সেই পরিমাণ সিনেমাহল কী এদেশে আর কখনো গড়ে উঠবে? নাকি যেগুলি আছে সেগুলিও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

চলচ্চিত্র তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া।