জাপানের হিনামাতসুরি (কন্যা উৎসব) এবং বাংলাদেশি নারীর চালচিত্র

নুরুন নাহার লিলিয়ান
Published : 2 March 2016, 03:25 PM
Updated : 2 March 2016, 03:25 PM

জাপানি শব্দ হিনা হলো পুতুল। মাতসুরি মানে উৎসব । হিনামাতসুরি বা কন্যা উৎসব ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে জাপানের ঘরে ঘরে শুরু হয় । সরকারি ছুটি না থাকলেও প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে হিনা উৎসব জাঁকজমক ভাবে পালন করা হয়। পনেরটি পুতুল নিয়ে হিনামাতসুরির ষ্টেজ সাজানো হয়। সেখানে দুটি পুতুল থাকে আলাদা। যারা একজন রাজা অন্যজন রানী । মার্চের তিন তারিখ পুতুল গুলো নামিয়ে ফেলা হয়। এই পুতুল নামাতে যদি কেউ দেরি করে । যেমন চার তারিখ হয় তাহলে ধারনা করা হয় সেই ঘরের মেয়েদের দেরিতে বিয়ে হয়। জাপানে এমন অনেক ধরনের কুসংস্কার কিংবা বিশ্বাস প্রচলিত আছে। প্রকৃত পক্ষে এই দিনে জাপানি কন্যাদের স্বাস্থ্য , সম্পদ আর সৌভাগ্য নিয়ে আশীর্বাদ করা হয়।

একটা সময় জাপান খুব রক্ষণশীল ছিল। সেখানে মেয়েদের কোণঠাসা করে রাখা হতো। কিন্তু আজকের জাপানে সমস্ত কুসংস্কারকে অতিক্রম করে মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আজ নারীর স্বাধীনতা ঈর্ষনীয়। নারীরা আজ অনেক বেশি শিক্ষিত আর সচেতন। অনেক আগের সময় থেকে এই উৎসব পালন করা হয়। জাপানিরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা করতে ভালোবাসে ।এই উৎসবে অনেক বার অনেক ভাবে যোগ দিয়েছিলাম। খুব মজার। অনেক কিছু শিক্ষণীয়। মনের মধ্যে এসেছে অনেক ভাবনা আর পার্থক্য নিয়ে নানা অনুভুতি। নারীর প্রতি সম্মান আর ভালবাসার প্রতীক হয়ে যেন হিনামাতসুরি আরও সমৃদ্ধি অর্জন করছে। আজকের জাপানে নারী অনেক বেশি স্বাধীন। অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল। দেড়িতে বিয়ে কিংবা বিয়ে না হওয়া নিয়ে তাদের ভিন্ন রকম চিন্তা । সেখানে নারী কে অর্থনৈতিক দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার সব ধরনের সুবিধা এবং নিরাপদ পরিবেশ আছে। তবে বাংলাদেশের মতো অভাব অনটনে পড়ে নারীকে আত্মহনন এর পথ বেছে নিতে হয় না। কাল পত্রিকায় দেখলাম একটি গ্রামে দুজন বোন অভাব আর দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে । খবরটা পড়ার পর আমি কতোটা মুহূর্ত স্তব্ধ ছিলাম আমি নিজেও জানি না। আজকের বাংলাদেশের মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক ভাল আর গর্ব করার মতো খবরগুলোর মাঝে এমন ঘটনা অনেক বেশি আতংকিত করে। নগর জীবনের কাব্য নিয়ে আমরা যারা ব্যস্ত তারা হয়তো জানি না সমগ্র বাংলাদেশে সত্যিকারের নারীর অবস্থা। স্বাবলম্বী হওয়ার লড়াইয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণী খেয়ে না খেয়ে মেয়েকে পড়াশুনা শেখাচ্ছে। চাকুরির পর বিয়ে করছে। তারপরও কি মেয়েরা স্বাধীন ভাবে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারছে! যুগের সাথে সাথে ছেলের বাবা মা এখন শিক্ষিত পাত্রী উচ্চ বেতন ভোগী পাত্রী খুঁজে। বিয়ের পর দেখা যায় নারীর উপর নেমে আসে ভিন্ন মাত্রার নির্যাতন। তখনও মেয়েটির রোজগার আর জীবন এর সিদ্ধান্ত গুলো স্বামীর কাছ থেকেই নিতে হয়। স্বামী তার রোজগার কোথায় কিভাবে খরচ করছে তা জানানো স্ত্রীর কাছে বাধ্য নয়। কিন্তু একজন নারীর রোজগার এর উপর শ্বশুর বাড়ীর সকলের কাছে জবাবদিহি করতে হয় । কোন কোন পরিবারের স্বামীরা স্ত্রীর বাবা মা কে আপন ভাবতে পারে না। একটি মেয়ে তার শ্বশুর শাশুড়িকে আপন করে নিতে তাঁদের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয় । কিন্তু কয়টা ছেলে তার শ্বশুর শাশুড়ি কে আপন ভাবে।খুব অদ্ভুত সমাজ ব্যবস্থা। আজো নারী শিক্ষিত কাজের বুয়া। শুধু তা নয় উচ্চ শিক্ষিত পরিবার গুলোতেও দেখা যাবে অনেক ধরনের নির্যাতন। আমাদের সমাজে ছেলেরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং সামাজিক উচ্চ মূল্য নির্ধারণে নিজেদের শিক্ষিত করলেও মনের দিক থেকে সেই নারীর প্রতি অবজ্ঞামূলক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। শিক্ষিত ছেলেরা অনেক বড় উচ্চ শিক্ষা সার্টিফিকেট নিয়েও নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে শিখেনি । প্রতিদিন যৌতুকের জন্য নারীকে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশের গ্রাম আর মফঃস্বল গুলোতে যে নারী নির্যাতনের কি ভয়ংকর রূপ হয়তো এই পৃথিবীর কারও জানা নেই। যারা অশিক্ষিত তাদের বলা যায় তারা নারী সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের অভাব। কিন্তু যারা শিক্ষিত তারা! আমাদের দেশের কর্ম ক্ষেত্রে একজন মেয়ের বিয়ে না হওয়া বা দেরিতে বিয়ে নিয়ে নারীকে নানা ভাবে মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। পারিবারিক নির্যাতন কোন ভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। তাই প্রতিনিয়ত ডিভোর্স আর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা গুলো বেড়েই যাচ্ছে। আমাদের সমাজকে আরও একটু বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। আপনার পাশের নারীর বাস্তবতা বুঝে তার প্রতি সম্মান নিয়ে আচরন করুন। তার প্রাপ্য টুকু তাকে বুঝিয়ে দিন ।গায়ের জোরে নয়। ভালোবাসায় আর সম্মানে সাথে নারীকে পাশে রাখুন । এই সমাজ এই পৃথিবীতে আপনার পাশের নারীটিই আপনাকে আপনার কঠিন বিপদে সাহায্যের হাত বাড়াতে পারে । হতে পারে আপনার মা ,বোন ,স্ত্রী ,বান্ধবী ,প্রতিবেশী কিংবা সহকর্মী। আমাদের সমাজে নারীর প্রতি সম্মান আর স্বাধীনতা বিষয়ে আরও অনেক বেশি আয়োজন দরকার । একটি মেয়ে যথাযথ সুযোগ ,পরিবেশ আর সম্মান পেলে সেও আপনার জীবনে আদরের হিনা পুতুল হয়ে উঠতে পারে । আরও একটু সচেতনতা । আরও একটু শিক্ষার প্রয়োজন । সেটা উচ্চ শিক্ষার সাথে কিছু মানবিক শিক্ষা। নারীর প্রতি সম্মানের শিক্ষা ।