কয়েক মাস হলো জাপান থেকে ফিরেছি। পিএইচডি শেষে অামার স্বামী ড.মোহাম্মাদ নজরুল ইসলাম ভূইয়া তার পূর্বের কর্মক্ষেত্র চিটাগাং বিসিএসআইআর এ জয়েন করেন।দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে নিজ কর্মক্ষেত্রের অনেক কিছু তার একটু অন্যরকম লাগছিল। প্রতিদিন ফোনে চিটাগাং এর অনেক গল্প ।মাস দুই হলো অামি চিটাগাং এসেছি। চিটাগাং এটাই অামার প্রথম অাগমন। শুরুতে এসেই অামি নিভৃত সবুজ প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যাই। এই সবুজ প্রকৃতি যেন নিরাপদ জাপানের সবুজ পাহাড় অার প্রকৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই অামি প্রকৃতির কাছে যাই। নতুন নতুন গাছ অার ফুলের সাথে পরিচিত হই।
দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু বেশিদিন বুঝতে বাকি রইলো না যে অামি বা অামরা একটি ভয়ংকর মৃত্যুপুরীতে অাছি। সবুজে ঘেরা সুবিশাল চিটাগাং বিসিএসআইআর এক বিচ্ছিন্ন বিরানভূমি। এখানে প্রথম নজরে যা পড়লো অনেক গুলো খালি বাসা পড়ে অাছে। কিন্তু কেউ থাকেনা। তবু ও নিয়মকানুনের কারণে সরকারি বাসা পেতে দেরি তাই থাকা খাওয়া গেস্ট হাউজে।
এতো বড় একটা কলোনি। হাতে গোনা কয়েকটা পরিবার। যোগাযোগটা যেন এক দ্বীপ থেকে অারেক দ্বীপ। নিসর্গ প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে একদিন দুপুরে গেস্ট হাউজের করিডোরে বসে বই পড়ছিলাম। হঠাৎ তিন চারটা শিশু পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। আমাকে দেখেই ওরা অাৎকে উঠে। চার পাচ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে বলে, আনটি এটাতো ভূতঘর। আগে এখানে একটা ভূত ছিল। আরেকটা শিশু কেঁদে ফেলে আর বলতে থাকে, তুমি তো ভুত। তুমি ফাঁসি দিয়ে মরে গেছো। তুমি আবার আসছো কেন? আমার মনে মনে হাসি পাচ্ছিল, আবার অপ্রস্তুত ও হলাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আসলে একজন নারী বিজ্ঞানী এই হাউজে ছিলেন। তিনি হঠাৎ পাগল হয়ে যান। কয়েকজন মানুষকে আহত করেন। নিজের রুমের জিনিস পত্র ভেংগে ফেলেন। রুমে নাকি প্রেতাত্মা অাছে। আরো অনেক কিছু। তারপরে একদিন এক পরিবারের পার্টি। দুই একটা পরিবারের সাথে পরিচয় কথা হলো। জানা গেল এখানে সবার বাসায় মানুষের সাথে সাপও বেড়াতে আসে। এক, দুই তিন যেকোন তলায় ড্রয়িংরুম এবং টয়লেটে নিয়মিতভাবে দেখা যায়।
এতো গেল সাপ আর ভূতপ্রেতের গল্প। নিভৃত জায়গায় নিঃসংগ থাকায় আমার স্বামী আমাকে প্রায়ই ল্যাবে নিয়ে যায়। সেদিন শুক্রবার। ১৯ শে ফেব্রুয়ারি। নিজের অফিস রুমে নিজের কনফারেন্স এর কাজ গোছাচ্ছিলেন। এমন সময়ে একটা অপরিচিত ফোন অাসে। পরিচয় দেয় 'পূর্ব বাংলা সর্বহারা কমিটির' নেতা। চাঁদা দাবি। না পেলে প্রাননাশের হুমকি। একে একে চৌদ্দ জনকে একই ধরনের হুমকি দেওয়া হয়।
বায়যিদ থানা এবং হাটহাজারি থানায় পৃথক পৃথক জিডি হয়। পুলিশ অাসে। অনেক গুলো দৃশ্য রচনা হওয়ার পর ঘটনা কিছুদিনের জন্য থামে। তারপর ২৭ ফেব্রুয়ারী ডিরেক্টর মিসেস মাহমুদা খাতুনের উপর দিবাগত রাতে সন্ত্রাসী হামলা হয়। উল্লেখ্য, তিনি ভিআইপি গেস্ট হাউজে একা থাকেন। তার তিন ছেলে। একজন আর্মিতে, একজন নেভিতে ট্রেনিং এ। অারেক ছেলে রাজশাহীতে তার স্বামীর সাথে যার যার কর্মক্ষেত্রে। বিশাল ডিরেক্টর বাংলোটা খুবই ভূতুরে। তিনি এ বছর জানুয়ারিতে জয়েন করেছেন। এর আগের ডিরেক্টরও ফ্যামিলি নিয়ে থাকতেন না। তার ফ্যামিলি ঢাকায় থাকতো। তিনিও ডিরেক্টর বাংলোতে একা ঘুমাতে ভূতের ভয় পেতেন। কেয়ার টেকার সংগে থাকতো। হাস্যকর হলেও এটাই সত্যি।
অাজ রাতে আবার ডিরেক্টর বাংলোতে হামলা। এভাবে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা অনেক। প্রকৃত পক্ষে বিশাল এই নিভৃত গবেষনাগারে যথেষ্ট লোকবল নেই।স্থানীয় সন্ত্রাসীদের অাধিপত্য অনেক বেশী। ফরেস্ট এরিয়া গুলো খুব অনিরাপদ । অনেক ধরনের অপরাধ কার্যক্রম ঘটে।নিরাপত্তা টহলে আনসার বাহিনী থাকলেও তা প্রয়োজন অনুযায়ী কম। যেকোন সময়ে যেকোন দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। গবেষনারগারের বাইরের মানুষদের জীবনমান খুব নিম্নমানের। বালুচরা জায়গাটা শহর থেকে দূরে। গবেষনাগার থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব খারাপ। প্রতিদিন অাতংকের সাথে বসবাস। মাঝে মাঝে দিন দুপুরে ভয়ে রক্ত হীম শীতল হয়ে যায়। জীবনের ভয় সবার। এখানে জীবন যেন মৃত্যুকে সংগি করে বসবাস। গবেষনা করার সকল যোগ্যতা থাকা সত্তেও নিরাপত্তার অভাব আর কর্ম পরিবেশের অভাবে কেউ থাকতে চায়না। অনেক নতুন কর্মকর্তারা বুঝতে পেরে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যায়। নারী কর্মকর্তাদের জীবন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো ভয়াবহ।তাই নারী কর্মকর্তারা কেউ থাকতে চায়না। গবেষনার চাকরি সব মানুষের সারা জীবনের স্বপ্ন থাকে। আর স্বপ্ন যদি ভয়ংকর হয়! সেই স্বপ্নের সাথে জীবনও যেন ভয়াবহ।প্রায় প্রতিদিনের এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে সবাই পালিয়ে যেতে চায়।বিদেশে আমার স্বামীর গবেষণা করার অনেক আকর্ষনীয় সূযোগ থাকা সত্তেও তিনি দেশকে ভালবেসে দেশে ফিরেন।এমন অব্যবস্থা আর নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির কারনে আজকাল তিনি ও দ্বন্দ্বে ভুগেন। বাংলাদেশে থাকবেন নাকি বিদেশেই ফিরে যাবেন।চলে যাওয়া সঠিক সমাধান নয়।এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ মেধাশক্তিহীন হয়ে পড়বে। আশাকরি যথাযথ লোকবল নিয়োগ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কর্তৃপক্ষ সুনজর দিবেন।তবে এটাও সত্যি মানুষের ভিতরে দেশপ্রেম না থাকলে স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বন্দ্বমুখর অস্থির সময়ে এই বিজ্ঞানীদের কে দিবে নিরাপত্তা?