হৃদয় ছোঁয়া নীল সাকোতান পেনিনসুলা

নুরুন নাহার লিলিয়ান
Published : 6 August 2016, 07:22 PM
Updated : 6 August 2016, 07:22 PM

ল্যাটিন শব্দ Paeninsula এসেছে Paene অর্থ almost এবং insula হল Piece of land .এমন এক ভূমি খণ্ড যার তিন দিকে পানি কিন্তু কোন এক অংশ মূল ভূমির সাথে সংযুক্ত থাকে । আর এই ভূমি খণ্ড সাধারন কোন ভূমির মতো নয়। এই চেনা শহর থেকে অনেকটা দূরে । দূর প্রকৃতির মাঝে অদ্ভুত সব নীলের বিলাসী খেলা । প্রকৃতি ,প্রেম আর সৌন্দর্য যেন মানুষের মনে গভীর ভাবে মিশে থাকে । এই তিন যখন মানুষের জীবনে ধরা দেয় তখন জাগতিক চিন্তা ভাবনা আর জীবন যেন অন্য কিছুর টানে ছুটে চলে । বেঁচে থাকা হয়ে উঠে এক অনবদ্য কবিতা । প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে হয় । চোখ ভরে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হয় । জীবন পায় আরেক ছন্দ । অভিজ্ঞতায় যোগ হয় নতুন অধ্যায় ।

প্রতিটি মানুষের মন নতুনের বিচিত্রতা আর সৌন্দর্য অবগাহনে তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকে । কেননা একঘেয়েমি জীবন সব মানুষের কাছেই সুর হীন কোন সঙ্গীত । তাই জীবনের সব টানাপোড়েন আর দুঃস্বপ্ন ভাসিয়ে দিতে মানুষ খুঁজে প্রকৃতির স্নেহ ,ভালবাসা আর প্রেম ।হাজার কোটি মানুষের ভিড়ে কখনও কখনও মানুষ অনুভব করে গভীর এক নিঃসঙ্গতা । প্রানহীন হয়ে যায় যাপিত জীবন । তখন মানুষ হাজার মানুষের মাঝে নতুন নতুন জীবনের গল্প খুঁজে । শত শত জীবন গল্পে অসহায় হৃদয় নিজের গল্পের আশ্রয় খুঁজে । মানুষের জীবনের বিচিত্র সব গল্প মানুষকে অভিজ্ঞ করে তুলে । চিন্তার আকাশ বিস্তৃত করে । অচেনা জীবনের পথ কে পরিচিত করে তুলে । সব উত্থান পতন আর ঘাত প্রতিঘাত কে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা কে শাণিত করে । তাই হাজার ও অপ্রত্যাশা ,অকল্পনা আর অনাকাঙ্ক্ষার মাঝে জীবন হল বিচ্ছিন্ন রহস্যে ঘেরা এক খণ্ড স্বপ্ন দ্বীপ । এক গোলক ধাঁধাঁ । প্রতি মুহূর্তে মানুষকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করে । অভিজ্ঞতাই মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ।

কিছুদিন আগে আমার জাপানিজ হোস্ট দাদির সাথে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে পরিচয় হল সুয়া পরিবারের সাথে । মায়ের নাম কেইকো সুয়া আর মেয়ের নাম কানেকো সুয়া ।তারা জাপান এর ওসাকাতে থাকে । হোক্কাইডোতে এসেছে গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাঁটাতে । জাপানিজদের স্বাভাবিক ভাবে বয়স বোঝা যায়না । তারা দুজন পাশাপাশি বসা ।প্রায় আধা ঘণ্টা বিভিন্ন দেশ এবং সংস্কৃতি নিয়ে কথা হচ্ছিল । জানতে পারলাম একমাত্র মেয়ে কানেকো সুয়া এখন আমেরিকার বোস্টন বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়ে । এর আগে পাঁচ বছর সে তাইওয়ানে পড়াশুনা করেছে । তার ইংরেজি এবং সংস্কৃতি স্বাভাবিক জাপানিদের চেয়ে একটু আলাদা । ভবিষ্যৎ সে শিক্ষক হবে । সেদিন সবার মনোযোগ যেন কানেকো সুয়া কে ঘিরে । এই বছর তার বিশ বছর পূর্ণ হবে । জাপান এ মেয়েদের বিশ বছর বয়সকে ঘিরে থাকে অনেক রকম পারিবারিক আয়োজন । সব চেয়ে মজার বিষয় আমি তাদের মধ্যকার সম্পর্ক দেখে ভেবেছিলাম তারা বন্ধু । অনেকটা সময় যাওয়ার পর তাদের মা সম্পর্কটা পরিস্কার করল যে তারা মা মেয়ে । আমি অবাক হলাম । খুব মজা পেলাম । খুব অল্প পরিচয়ে তাদের সাথে আমার একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল । শুরু হল সংস্কৃতি বিনিময় । তারা জানতে চায় বাংলাদেশ সম্পর্কে । অনেক প্রশ্ন আর কৌতূহল । তাদের আমন্ত্রনেই তাদের সাথে গিয়ে ছিলাম হোক্কাইডো থেকে একটু দূরের বিচ্ছিন্ন নীল অন্তরীপ সাকোতান পেনিনসুলা দেখতে । হোক্কাইডোর সাপ্পরো শহর থেকে আড়াই তিন ঘণ্টার পথ । আমরা পাঁচ জন ।আমাদের সাথে আমার হোস্ট জাপানিজ দাদা দাদি । তাদের ব্যক্তিগত গাড়ীতেই সকাল নয়টায় যাত্রা শুরু ।পথে অনেক রকমের চিন্তা ভাবনা দেশ সংস্কৃতি নিয়ে হয় কথা বার্তা । সময়টা গ্রীষ্মকালীন । তাই চারিদিকে যেমন প্রচণ্ড রোদ তেমনই বাতাস । এই গভীর বাতাসে যেন কোন নিভৃত অস্তিত্ব দোলা দিয়ে যায় ।চারিদিকে সবুজের অদ্ভুত ঘ্রান ।

আর সেই বাতাসের ঘ্রান নিতে নিতে মনের অজান্তে জীবনানন্দ দাস এর কবিতায় হারিয়ে যাই ।
আমি কোন এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছি
তুমি কোন এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছো
হয়তো হাজার হাজার বছর পরে
মাঘের নীল আকাশে
সমুদ্রের দিকে যখন উড়ে যাবো
আমাদের মনে হবে হাজার হাজার বছর আগে আমরা এমন উড়ে যেতে চেয়েছিলাম।

সাকোতান সিটিতে প্রায় ২৫০০ লোকসংখ্যা ।সাপ্পরো শহর থেকে উত্তর পূর্বে ৩০ কিমি দূরে অবস্থিত এই শহর সাকোতান । উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে মাছ এবং সামুদ্রিক খাবারের জন্য ভাল জায়গা ছিল । সামুদ্রিক তরতাজা এক ধরনের উরচিন খুবই সুস্বাদু । সাকোতান পেনিনসুলাতে প্রবেশ পথ হল ইয়চি শহরের মধ্য দিয়ে ।

সেখানেই আমরা নামলাম মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য ।সেখানে এক ঐতিহ্যবাহী জাপানিজ রেস্টুরেন্ট এ মধ্যাহ্ন ভোজ হল কাইসেনদন নামের সামুদ্রিক ডিস । এই কাইসেনদন খাবারে যা আছে তা হল কাঁচা মাছ এর মধ্যে বুরি ফিস , শেলমন ,সামুদ্রিক চিংড়ি ,ক্রাব গাজর, বিশেষ পদ্ধতিতে আদা ,মাছের উনচি আর এই সবজি মাছের নিচে জাপানিজ আঠালো ভাত । সাথে আছে মিতসু সুপ আর কিউরি সালাদ । কিউরি হল শসা । জাপানিজ ভাষায় শসা কে কিউরি বলে । এই কিউরিকে সয়া সসে ভিজিয়ে রেখে তারপর পরিবেশন করে । এর পর হট মুগি চা ,ও চা কিংবা কফি । সেখান থেকে আমরা যাত্রা শুরু করলাম ।

এখানে সব চেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা গুলো হল ক্যানডেল রক ,কেপ অগান ,সিমামুই কোষ্ট আর কেপ কামুই । গাড়ি ছুটে চলছে আর সেখান থেকেই দেখা যাচ্ছে ক্যানডেল রক ।এই ক্যানডেল রক এর উচ্চতা ৪৬ মিটার ।ইয়চি শহর থেকে ১২ কিমি উত্তর পূর্বে ।অদ্ভুত সুন্দর এই ক্যানডেল রক যেন বিশাল সমুদ্রের বুকে জেগে থাকা আলোর প্রহরী । আমরা আবার নামলাম কেপ অগান এ কাছেই মিসাকি নামক ব্রিজের কাছে । অদ্ভুত সুন্দর নীল আর সবুজের মায়ার পৃথিবী । এই পৃথিবীর অন্য রূপ যেন নীল সবুজ আর সমুদ্র এর দুর্বোধ্য সম্পর্ক। কোন ভাষা দিয়ে বোঝান সম্ভব নয় । কেপ অগান হল ইয়চি শহর থেকে ২৫ কিমি উত্তর পূর্বে অবস্থিত পোর্ট । যেখান থেকে জাপান সাগর, আইল্যান্ড, বিকুনি পোর্ট এর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য চোখে পরবে। এখানে থেকে পর্যটকরা শিপ নিয়ে জাপান সাগর উপভোগ করে ।বিশাল এই পৃথিবীর রহস্য ।প্রকৃতির কতোই না খেয়াল। আর সেই অদ্ভুত সব খেয়াল এর মহৎ সৃষ্টি এই কেপ অগান । মন হারিয়ে যায় প্রাকৃতিক নৈসর্গিকতায় ।সেখানকার ঢেউয়ের শব্দ কানের কোথাও রহস্য ছুঁইয়ে দিয়ে যায়। যেন নীল সমুদ্র ,সবুজ পাহাড়, মাথার উপর সূর্য এর মুচকি হাসি আর সব মিলে প্রকৃতির বুকে চিরে শোনা যায় ঢেউয়ের কোন অচেনা নিভৃত সঙ্গীত ।সেই ঢেউয়ে আমরা পা ছুঁয়ে দেখি নীল জল কনার অস্তিত্ব । আর সুখ স্মৃতি ধরে রাখতে আই ফোন কিংবা ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক ছন্দ । চিৎকার করে মনের কোন অব্যক্ত ইচ্ছে জাপান সাগরে ভাসিয়ে দেয়া । প্রানবন্ত প্রকৃতির সাথে আরও কিছুটা সময় মিশে যাওয়া ।এর পর সিমামুই কোস্ট ।কেপ সাকোতান এর খুব কাছেই এই সিমামুই কোস্ট । আর পেনিনসুলার একদম উত্তরে এই কোস্ট অবস্থিত । এখানকার পানি এতো পরিস্কার এবং স্বচ্ছ যে সব জায়গায় এর নাম সাকোতান ব্লু হিসেবে খ্যাত । এখানেও প্রকৃতির আরেক সৌন্দর্য ।এরপর কেপ কামুই । এটি পেনিনসুলার একদম উত্তরে অবস্থিত। এখান থেকেও জাপান সাগরের অদ্ভুত সব দৃশ্য চোখে পরবে । কেপ কামুইর বিচিত্র দৃশ্য যেকোন মানুষের চোখ স্থির হবে । মূল ভুখণ্ড থেকে কেউ যেন আঁকাবাকা লাইন কেটে সমুদ্রের দিকে চলে গেছে । ঠিক যেন তাই । কেপ কামুইর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত অনেক ইতিহাস আর প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই চোখে পরবে আরেক কামুই রক । অতীত লোক কথা থেকে জানা যায় হৃদয় ভাঙ্গা কোন মেয়ে অনেকে আগে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে ছিল । আর সেই মেয়ে কোন একদিন কামুই রক হয়ে ফিরে এসেছে । উঠতি বয়সি ছেলে মেয়ে কিংবা প্রেমিক প্রেমিকাদের কাছে এই গল্প শোনা ভিন্ন অর্থ বহন করে । হৃদয় ভাঙা ভালবাসা প্রকৃতির বুকে এই ভাবে নীরবে চিহ্ন হয়ে রয় । তাই প্রেমিক প্রেমিকাদের কাছে কামুই রক অন্য রকম আকর্ষণ । যা সব বয়সী মানুষের হৃদয় ছুঁইয়ে যায় !

জাপান দেশটার প্রতিটা জায়গা এমন সুন্দর করে প্রকৃতি আর ইতিহাস লোককথায় সমৃদ্ধ যে মানুষ বিমুগ্ধ হবেই ।অতীত ইতিহাসের উপর দাঁড়িয়ে থাকা বর্তমান প্রকৃতির বিনীত শ্রদ্ধা। যে প্রকৃতি দেখে এবং ইতিহাস থেকে শেখার অনেক কিছুই আছে । ফিরে আশার পথে আমরা ঢুকলাম একটি গ্রাম । এই ছোট গ্রাম এর নাম আঁকাইগাওয়া । জাপানিজ শব্দ আঁকা অর্থ লাল আর কাওয়া অর্থ হল নদী । আর শেখান থেকেই পুরো শব্দ আঁকাইগাওয়া মানে লাল নদীর গ্রাম ।সেখানেও অতীত ইতিহাস সংস্কৃতি কে তুলে ধরতে অনেক অনেক ছোট ছোট সুভেনিয়র শপ বা গিফট দোকান । অতীত ঐতিহ্য কে বিভিন্ন আয়োজনে যেন বর্তমানে জীবন্ত করে রেখেছে ।গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে মানুষ মনের অজান্তেই অনেক বছর পিছনে অতীত ইতিহাসে চলে যাবে ।গভীর অরণ্য ঘেরা এই গ্রাম ।কতো নিরাপদ আর আনন্দে চলছে । গ্রাম ঘিরে সব মনোমুগ্ধকর আয়োজন ।এই লাল নদীর গ্রাম এ আমরা কিছুটা সময় হাল্কা জাপানিজ মাণজূ ,আঁকা মামে পান মানে রেড বীণ ব্রেড আর চা কফি পানে বিশ্রাম । কে যে প্রশান্তি যা বলে বুঝান যায় না । ভেসে আসে অচেনা জাপানিজ গানের সুর ।মনের কোনে অদ্ভুত আনন্দ দোলা দিয়ে যায় । সেই গ্রাম এর কাছেই পিয়ানো হোটেল । এমন গভীর পাহাড়ি অঞ্চলে অভিজাত হোটেল চিন্তা করা যায় না । এই হোটেল এর শিল্প কারুকার্য যে কোন মানুষের চোখ কৌতূহলী হবে । ছেলে মেয়েদের বিয়ের জন্য এই পিয়ানো হোটেল বিখ্যাত । পাহাড়ি কোলে থাকা এই হোটেল এর ভিতরে যেন আরও অনেক হোটেল আর রেস্টুরেন্ট ,সুইমিংপুল ,মিউজিয়াম ,লাইব্রেরী ।যেন পৃথিবীর ভিতর আরেক পৃথিবী । রহস্য ভেদ করে আরেক রহস্য । এরপর সব রহস্য মন আর মস্তিষ্কে নিয়ে ঘরে ফেরার পালা ।