স্মৃতিচারণ: ডেংগু এবং চোখের জলে নিপু

নুরুন নাহার লিলিয়ান
Published : 9 Sept 2016, 07:42 PM
Updated : 9 Sept 2016, 07:42 PM


প্রানপ্রিয় মানুষের অকাল প্রয়ান প্রতিটি মানুষকে গভীর বেদনার সাগরে ভাসায়। দগ্ধ করে। নি:শেষ করে দেয়। কিছু প্রিয় মানুষের না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার সাথে কিছু শিক্ষা নিভৃতে শিখিয়ে দিয়ে যায়।নিরন্তর সে শিক্ষা একান্ত বুকে চেপে জীবনের নিয়ম মেনে নেয়।
নিপু। পুরো নাম কাজী রোকসানা সুলতানা। পরিচয়টা হয়েছিল ২০০২ সালে। জীবন তখন স্বপ্নঘোরে। বাস্তবতা তখন কঠিন নিয়মের শাসনে। আমি ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের বিএফএম হলে ৩২৭ নাম্বার রুমে উঠেছি। আমাদের ভাগ্যটা ভীষন ভালো ছিলো। অর্থনীতি বিভাগের সাতটা মেয়ে পাশাপাশি রুমে সিট হয়েছে। দুজনের সাথে আমার ক্লাসেই পরিচয় হয়েছে। জেবিন তাহমিনা হক লীনা আর কানিজ ফাতেমা। বর্তমানে লীনা সোনলী ব্যাংকে প্রিন্সিপাল অফিসার আর কানিজ ম্যাজিস্ট্রেট। নিপু ছিলো রাজধানীর বিখ্যাত সিটি কলেজের প্রভাষক। কতো গুলো মেধাবী মেয়ে আমার জীবনটাকে নতুন করে সাজাতে লাগলো। সেদিনই প্রথম পরিচয়।সদাহাসোজ্জল মায়া ভরা কণ্ঠ। আমি রুমে কি যেন করছিলাম। কে যেন কি বলছিল।আমি ফিরে তাকালাম। " এই যে খুকি। আমি কিন্তু আপনার পাশের রুমে। আপনার বড় আপু। অর্থনীতিতে আপনার সাথেই আছি।"
আমি হেসে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম কি আন্তরিক। কি সুন্দর মেয়ে।কতো আপন তার মুখের ভাষা।


(বর রাহাত জামিল এবং মেয়ে রোহিনী প্রিয়দর্শীনির সাথে)

তারপর ধীরে ধীরে সকালের নাস্তা,দুপুরবেলা, বিকেল বেলা আর রাত গভীর রাতের হঠাৎ আড্ডায় ও আমরা একে অন্যের হয়ে গেলাম। নিপু প্রথমে ইতিহাসের ছাত্রী ছিলো। পরে ইয়ার ড্রপ দিয়ে ভালো সাবজেক্ট পেতে অর্থনীতিতে আসে। ওর সেই আগের বন্ধুদের সাথে ও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।কোন ভ্রমন পরিকল্পনা হলে এক সাথে আছি সবাই।
নিপু ছিলো পাচঁ ভাইয়ের একমাত্র আদরের বোন। সবার আদরের।
নিপুর পুরো পরিবারটা এতো আন্তরিক যে আমরা ভুলেই যেতাম নিপুর ভাই ভাবি মা আমাদের বন্ধুর। একই পরিবারের আমরা। জগন্নাথ হলে পূজা। নিপু আমাকে সবুজ রঙের নিজের পছন্দের শাড়িটা নিজ হাতে পড়িয়ে নিজের সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। এমন করে সব জায়গায় নিয়ে যেতো। বাড়ি থেকে মায়ের হাতে পিঠা আমাদের ছাড়া খায়নি কোনদিন। তারপর আমার জন্মদিন। সেদিন নিপু আর ওর রুম মেটরা কতোটা আপন করে আনন্দ করেছিল। তা কেবল চোখের সামনে ভাসে। নিপু নিয়ে এলো বড় একটা ফুলের তোড়া। আমার প্রিয় বই আর ফুল। কেমন করে যেন মনের খবর জেনে নিতো। একদিন ইনকোর্স পরীক্ষা শেষে রুমে ঘুমাচ্ছিলাম। কে যেন কানের পাশে ফিস ফিস করে বলছে ফেনী যাবি?
আমি চোখ খুলে দেখি নিপু। ফেনি নিপুদের বাড়ি ফেনীর এস কে রোড। আমরা কয় বান্ধবী চললাম। ঢাকার বাইরে যাওয়ার সাহস আর পরিবারের অনুমতি কোনটাই ছিলো না। কিন্তু নিপু এমন একটা মেয়ে যাকে না করা যায় না। যার ভালোবাসায় মানুষ সিক্ত হবেই। আমরা সবাই এডভেঞ্চারে গেলাম নিপুদের বাড়ি ফেনী। সাথে বান্ধবী নিসাত,সুমনা, কানিজ, লিনা আর নিপুর ফুপাতো বোন শাওন। সে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা। নিপুর ভাই বাবু ভাইয়া আর উর্মি ভাবির আন্তরিক ভালোবাসায় আস্থায় মনেই থাকে না আমরা দেশের অন্য জায়গা থেকে এসেছি। তাদের সাথে চিটাগাংয়ের সিতাকুন্ড ভ্রমন আজীবনের সুখ স্মৃতি। নিপু নিজের হাতে তুলে দেওয়া ছবি গুলো আমাকে শুধু কান্নার সমুদ্রে ভাসায়। নিপুর কোন বোন ছিল না। আমাকে বুকে চেপে ধরে প্রায়ই বলতো "তুইতো আমার বোন। "
আমার সেই বোনটার কাছ থেকে যে ভালোবাসাটুকু দিনের পর দিন জমা করেছি তার কিছুই যে ফিরত দিতে পারলাম না। এতো তাড়াতাড়ি এই পৃথিবীটা ওকে বিষাক্ত করে দিল। এই পৃথিবীর প্রতি সব মায়া নিরবে ছেড়ে দিয়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলো। কেনো এতো তাড়াতাড়ি। কোন অব্যক্ত অভিমানে!


(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভ্যানে আমাদের সাথে)

একদিন আমার কি হাই ফিভার। সারা রাত নিপু সহ সব বান্ধবী গুলো পাশে। নিপু গা মুছিয়ে দেয়। মাথায় পানি ঢেলে দেয়। এতো আদর আর মায়া করার ক্ষমতা পৃথিবীর খুব কম মানুষের আছে। একদিন আমাদের বান্ধবী তামান্না দূর্ঘটনায় পঙ্গু হাসপাতালে। আমরা সবাই দুজন দুজন করে হাসপাতালে থাকি।নিপু আমাকে প্রতিদিন যাওয়ার রাস্তা শিখিয়ে দেয়।আমাদের সবার ভালোবাসায় আর দোয়ায় তামান্না অল্প কিছুদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে গেল। তামান্না এখন আল্লাহ্‌র রহমতে জার্মানি পিএইচডি করছে। আমাদের বান্ধবীদের মাঝে নিপুর সবার আগে বিয়ে হলো। ওর ভালোবাসার মানুষের সাথে। আমরা সব বান্ধবীর এক সাথে আনন্দ সেটাই হয়ত শেষ। তারপর একদিন অনেক খুজেঁ নিপুর শশুড় বাড়ি মিরপুর গেলাম। সেখানের সেই পরিবারের সবাই বেশ আন্তরিক। সাদা খয়েরি রঙের শাড়িতে কি সুন্দর লাগছিল। নতুন সংসার। মনটা ভরে গেলো। এরপর অনেক দিন। আমরা সবাই চাকরি আর জীবন নিয়ে প্রতিদিনের যুদ্ধে নেমেছি। মাঝে মাঝে ফোন আর ফেসবুকে কথা। এর মাঝে আমি চলে গেলাম জাপান। আরো অনেকদিন। তারপরে হঠাৎ একদিন ফেসবুকের টাইম লাইনে ভাসছে নিপুর শরীরের অবস্থা ভাল না। প্রচুর রক্ত লাগবে। আমি আৎকে উঠি। সব কাজ ফেলে খোজঁ নেই। শুনলাম নিপু সেকেন্ড বেবি হবে। এরই মাঝে কয়বছর পর আমি ফিরেছি দেশে। আমি চিটাগাং আর ঢাকা দৌড়ঝাঁপের উপর। জীবনের প্রয়োজন। নিপুকে ফোন দেই, কাতর কণ্ঠে বলে, তুই আসবি না।। আমাকে দেখতে আসিস নি কেনো।

(ঢাবির বিএফএম হলে চাইনিজ ফ্রেন্ড এবং আমাদের সাথে)

তারপর শত ব্যস্ততার মাঝেও নিপুকে দেখার জন্য মনটা কেমন করছিল। কতো বছর পর। ঠিকানা খুজেঁ নিপুর নতুন বাসা ধানমন্ডির কোন এক পশ্চিমের রাস্তায়। লিফট থেকে নেমেই দেখি নিপুর মা দরজা খুলে দাড়িয়ে আছে। আমাকে জড়িয়ে ধরলো। নিপু,নিপুর মা আর আমি সে কতো যে জীবনের গল্প। নারীর জীবন।পরতে পরতে যুদ্ধ। ছোট তিন মাসের ছেলে রেহান আর পাচঁ বছরের মেয়ে রোহিণী প্রিয়দর্শিনী কে দেখে বুকটা ভরে গেলো। আমাদের নিপুর নিজের পরিপূর্ণ সংসার করছে। নিপুকে জিজ্ঞেস করলাম তোর শশুড় শাশুড়ি কোথায়? স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে হালকা ভাবে বলল তারা আলাদা বাসায় গ্রিন রোড থাকে। আর কোন কথা হয়নি আমাদের। যদিও আমাদের দুজনের অনেক কথা বাকি ছিলো। সেদিন আমার বরের ফোন পেয়ে আরেক দিন আসবো বলে বিদায় নিলাম। তারপর শেষ জুন মাসের ১২ তারিখে ক্ষনিকের দেখা। ঈদের পর গেটটুগেদার হবে। আরো কতো যে আয়োজন আর পরিকল্পনা। ঈদের ছুটিতে আমরা সবাই যে যার বাড়ি। ফেসবুকে টাইম লাইন জুড়ে শুধু আর্তনাদ। প্রিয় মানুষটির নাকি ডেঙ্গু জর হয়েছিল। মাত্র দুই তিনের জর। যেনো কোন কালো যাদু আমাদের চিরচেনা নিপুকে অদৃশ্য করে দিলো। সারাটা রাত শুধুই আল্লাহ্‌ কে ডেকেছি। আল্লাহ্‌ তুমি মহান। আল্লাহ্‌ তুমি মহান। নিপুকে আমাদের মাঝ থেকে ছিনিয়ে নিও না।


( সীতাকুন্ড পাহাড়ের ঝর্নার কাছে নিপু এবং আমরা)

কিন্তু ৫ জুলাই ২০১৬ ভোর হতে না হতেই নিপু অচেনা গ্রহের তারা হয়ে গেলো। বুকের কোথাও শুধু আমি ভাঙনের আওয়াজ পেলাম।রেখে গেলো চার মাসে ছেলে রেহান আর পাঁচ বছরের মেয়ে রোহিণী প্রিয়দর্শিনী। যতোক্ষন জ্ঞান ছিল হয়তো ভেবেছে ভালোবাসার মানুষ জামিলের কথা, অবুঝ দুটো শিশুর কথা, নিসঙগ একাকি মায়ের কথা ভাই ভাবিদের কথা আর ওকে ঘিরে থাকা অজস্র ভালবাসার মানুষের কথা।
তারপর একদিন বাসার কাছেই সেই ধানমন্ডির কোন পশ্চিম রাস্তায় আমার ঠিকানা হলো। সাত তলা ভবনের ছয় তলায় আমার বসবাস।খুব সুন্দর ছিমছাম জীবন। পড়ন্ত বিকেলে বারান্দায় গেলেই অনুভব করতে পারি আমার দুচোখ ভরে অশ্রু ঝরছে। বুকের পাজর গুলো শুধু হু হু করছে। আমার বাসার বারান্দা থেকে নিপুর বাসাটা দেখা যায়। একদম পরিস্কার আমি নিপু কে দেখতে পাই ।। কিন্তু ছুঁতে পারি না। সে সাধ্য পৃথিবীর কারোই নেই
আমার মাঝে মাঝে জীবনটাকে ভারী মনে হলে নিপু কে ডাকি। নিপু নিভৃতে আসে।জানিয়ে দিয়ে যায় কিছু কান্নার মূল্য এতো বেশি যে পৃথিবীর মানুষের বুঝবার ক্ষমতা নেই। তাই নিপু অন্য পৃথিবীতে এই অর্থহীন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছে।

লেখক:সাহিত্য সম্পাদক www.mohioshi.com