এক আলোছায়ার চিটাগাং বিসিএসআইআর

নুরুন নাহার লিলিয়ান
Published : 2 Nov 2016, 07:33 PM
Updated : 2 Nov 2016, 07:33 PM

হঠাৎ করেই কোন এক শীতের সকালে বরের কর্মস্থল চিটাগাং বিসিএসআইআর চলে যাই।সে যাত্রা ছিলো কর্মব্যস্ত বরকে অনেকটা সাইরপ্রাইজ দেওয়ার জন্য। সাথে ছিলো আমার ছোট ভাই। আমাকে রেখে সে চলে যায় হিমছড়ি কক্সবাজার।এই ভোরে সকাল বেলা আমাকে দেখে সে রীতিমত অবাক হয়। মনে মনে খুশি হলেও উপরে বুঝতে দেয় না। যাই হোক একটা অদ্ভুত পাগলামি নিয়ে চলে গিয়ে ছিলাম। বরের মুখে ফোনে চিটাগাংয়ের মনোরোম প্রাকৃতিক সৌনদর্যের কথা শুনে শুনে তা দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠেছিল।এটাই ছিলো আমার প্রথম চিটাগাং যাত্রা। হঠাৎ করেই সে অভয়ারন্যের সৌন্দর্যের টানে চলে যাই।

যাইহোক চিটাগাং থেকে ঢাকায় চলে আসার মানসিক প্রস্তুতি দেশের বাইরে থাকতেই ছিলো। তার অনেক গুলো কারনের মধ্যে চিটাগাং গবেষনার জন্য সুন্দর পরিবেশ থাকলেও যথাযথ যন্ত্রপাতি, ক্যামিক্যাল, লোকবল আর তার গবেষনার বিষয় বিবেচনা করে আমার বর সেখান থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন।

যেহেতু ঢাকায় চলে আসবে। তাই সরকারি বাসা নেওয়ার চিন্তা ভাবনা কিছুটা পরিস্থির উপর রেখে সেখানকার গেস্ট হাউজে আমার এক ভিন্ন জীবন শুরু হয়। এমন শিহরণ, ভয়াবহতা আর নাটকীয়তায় ভরপুর জীবন হয়তো গল্প উপন্যাস আর সিনেমার পর্দায় ও অনুপস্থিত থাকে । সেলুলয়েডের পর্দায় ও হয়তো অতিরঞ্জিত মনে হবে। কিন্তু বাস্তবতা খুব কঠিন। কিছু দূর্ঘটনার আকস্মিকতা যেনো নিজের কাছেই বেমানান মনে হয়। আমি শুধু ছুটে বেড়াই। আর চোখ যেদিকে যায় সেদিকেই যাই। হারিয়ে যাই নাম না জানা প্রকৃতির মাঝে। চারিদিকে প্রকৃতির হাজারো রঙে মনটা ঘরে রাখা যায় না। বিকেল হলেই আমি বিসিএসআইআর এর গবেষনাগার ঘুরে দেখি।মনের অজান্তে গেয়ে উঠি-

এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকে না তো মন।

কোন এক আলোছায়া পথের নিস্তব্ধ অরন্যের ভিতরে নিজেকে খুজেঁ ফেরা। গভীর অরন্য ঘেরা জীবনে প্রতিটি মুহুর্ত যেন শিহরনে ভরপুর। আছে প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসীদের হুমকি। আছে অসংলগ্ন অতিপ্রাকৃত পৃূর্ব ঘটনার ইতিহাস। আরো আছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্ভাব্য উৎকন্ঠা। প্রতিমুহূর্ত যেন মৃত্যুর ছায়াকে সঙ্গী করা। রক্ত হীম হয়ে যাওয়া সব অনুভুতির গল্প। চিটাগাং বিসিএসআইআর গবেষনাগারের কেপিআই এলাকা। মানে সর্ব সাধারনের চলাচলের জন্য এক নিষিদ্ধ কিংবা সংরক্ষিত অভয়ারণ্য। আবাসিক এলাকার গেট দিয়ে বের হলেই তিনটি রাস্তা। ডান দিকে চিটাগাং ক্যান্টনমেন্ট। বাম দিকে শহরে বের হওয়ার প্রধান রাস্তা। আর মাঝখান দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে সেটাই কেপিআই। আনসার চেক পোস্টের গেট দিয়ে ঠুকতেই প্রথমে হাতের ডানে আকর্ষনীয় একটা ছোট মসজিদ। তারপর শুরু হয় নানা রকম চেনা অচেনা গাছে ফুলে ছেয়েঁ যাওয়া এক অরণ্য।

একটু সামনে গেলেই অর্জুনরূপে পুরো এলাকায় অর্জুন গাছ গুলোর প্রানোচছল প্রাধান্যতা যেন চোখে প্রকৃতির অনেক রঙিন ছবি একে দেয়। তারপর একটু কাছে গেলেই লালচে গালিচার মতো পথ ধরে আছে খুব সুন্দর একটা লোহার পুল। তার নিচ দিয়ে বয়ে গেছে তরঙ্গাহত লেক। লোহার পুলে দাঁড়িয়ে একবার লেকটার দিকে তাকালে মনের ভিতর স্মৃতির দুয়ার গুলো শুধু খুলতে থাকবে সুখ দু:খের পসরা সাজিয়ে। লেকের পাশেই মেডিসিনাল প্লান্ট এরিয়া। সেখান দিয়েও বেঁকে গেছে আরেকটা পথ।

লোহার পুল থেকে নামতেই হাতের বামে পড়বে আনসার চেকপোস্ট। সেখান থেকে বামে চলে গেছে যে পথটা সেটা এনিম্যাল হাউজের পথ। বেশ কিছু এনিম্যাল ও আছে সেখানে। মাঝেই মাঝেই এই পথে অভিমানী হরিণ বের হয়ে আসে পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখতে। এই সৌন্দর্যময় দৃশ্যগুলো যখন মনের ভিতর নানা ছবি আকতে থাকে তখন চোখ পড়ে ছবির মতো তিনটি তাল গাছ খুব অদ্ভুতুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন প্রতিটি মানুষের যাত্রাকে অবলোকন করছে। কাছেই বড় একটা পানির ট্যাংক। তাকে ঘিরে আছে ঘন জঙ্গল আর ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা। দুই পাশের অদ্ভুত সবুজের বিলাসিতা নিয়ে বয়ে গেছে কেপিআই পথ। সে পথে সব মানুষের মন হারিয়ে যাবে। সোনাঝোরা সোনালু গাছের আর সূর্যের আলোর মাখামাখিতে সব সময় গোটা পথটা একটা অদ্ভুত রহস্যে হাসতে থাকে।

পথের উপরে সোনালি ছায়া আর নিচে লজ্জাপতি গাছ আর কাশফুলের ব্যাখাহীন সম্পর্ক। মাটির ভিতর যেন সোনাঝোরা প্রেমের সুদীর্ঘ ইতিহাসের মায়া। বনের মাঝে মাঝে অনেক রকম নাম না জানা গাছের ছোট পথ বয়ে গেছে ভিতরের দিকে। কেপিআই এর মাঝামাঝি পথেই চোখ পড়বে একটি উইনড মিলের দিকে। নিজস্ব ঢঙে নিজের পাখা গুলো নিয়ে বাতাসের নিরব মিতালী করে আছে। তাই পথে হাটার সময়ে হঠাৎ উইন্ড মিলটা বাতাসের চাপে যখন ঘুরতে থাকে মনে হবে সেখানে কোন অস্তিত্ব আপন মনে জেগে উঠছে। বড় বড় ঘাসের ফাকেঁ ফাকেঁ অনেক ফুল এবং ফলের গাছ আপন বৈশিষ্ট্যময় পরিচয় বহন করছে।

সে গাছ গুলোর সাথে পরিচয় হতেই হতেই কানে আসে ট্রেন চলে যাওয়ার নিস্তরঙ্গ শব্দ। কেপিআই এর দেয়াল সীমানার সাথে ঘেসানো বাইরে ট্রেন স্টেশন। তারপর পার হতে হয় আরো একটি ছোট কৃত্রিম লেক। তার সাথেই আবার আনসার চেকপোস্ট। সেটা অতিক্রম করলেই সারি সারি রং করা পাইন গাছের পথটা নিয়ে যাবে চিটাগাং বিসিএসআইআর গবেষনাগারের অফিস ভবনে। তার পাশেই লেমন গ্রাসের বিলাসিতা আর দিগন্ত জোড়া মাঠ। সে মাঠ থেকে আকাশের নানা রং এলোমেলো মন প্রশান্তময় করে তোলে।

জীবন যেন সত্যি কোন থ্রিলার গল্প কিংবা উপন্যাসের মতো। সে গল্পের প্রতিটি পর্ব শুধু ভয়াবহ আতংকে ভরা।
প্রথম দিনেই ভি আই পি গেস্ট হাউজে চা খেতে গিয়ে পরিচয় এবং সখ্যতা তৈরি হয় বিশাল এই গবেষনাগারের বিজ্ঞানী এবং ডিরেক্টর মিসেস মাহমুদা খাতুন ম্যাডামের সাথে। তিনি ও সেই সময় রাজশাহী থেকে সম্প্রতি চিটাগাংয়ে জয়েন করেছেন।ডিরেক্টর মিসেস মাহমুদা খাতুন ভীষন অমায়িক এবং সাহিত্যপ্রেমী মানুষ।
প্রতিদিন বিকালে তিনি আমাকে ডেকে নিতেন এক সাথে চা খাওয়া আর সাহিত্য আড্ডা দেওয়ার জন্য।এক অফুরন্ত সময়ের বিলাসিতা। আমি অনলাইনে গল্প লিখি, ব্লগ লিখি আর আমার নারী বিষয়ক নিউজ পোর্টাল মহীয়সী.কম এ মানুষের পাঠানো গল্প এডিট করে পোষ্ট দেই। সেই সাথে বিশ্ব সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনাও চলে। দিন গুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিল।

একদিন সকাল বেলা আমি কফি তৈরি করছি। হঠাৎ এক মেয়ে আমার পেছনে দাড়িয়ে। আমি ভূত ভেবে কিছুটা অপ্রস্তুত হই। তিনি হলেন ড.সাদিয়া। চায়না থেকে পিএইচডি করে এসে নতুন জয়েন করেছেন। পরিচয়টাও ভীষন মজার।
এরপর আমার আরও একজন সাথী হলো। গেস্ট হাউজ গুলো এমন ভাবে পরিত্যক্ত থাকে যে ভূত প্রেত আর সাপেরা তো জায়গা করে নিবেই।দিনে দুপুরে মনের অজান্তে ভয়ে শরীর হীম হয়ে যায়।
গাছে গাছে সাপ ঝুলে থাকা, আর টয়লেটের কমোডে সাপ থাকা সবাভাবিক ব্যাপার। তবুও অনেক জায়গা ঘুরাঘুরি আর সাহিত্যের চর্চা করে ভালোই চলছিল।
সেদিন ছিলো শুক্রবার।আমার বরের তুরস্ক এক কনফারেন্সে জয়েন করার কথা। পাশাপাশি টেবিলে আমি কম্পিউটারে আর আমার বর ল্যাপটপে কনফারেন্সের বিষয়ে কাজ করছিলো ।

খুব সুনসান নিরবতার মধ্যে আমরা দুজন মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলাম।
হঠাৎ ফোনটা এলো। কোন এক সন্ত্রাসী গ্রুপের। খুব বকা বাজি করতে লাগলো। খুব কাছাকাছি থাকায় আমি শুনে ফেলেছিলাম। এক মিনিট সময় নষ্ট না করে আমরা বায়জিদ থানায় গেলাম এবং চাদাঁ চেয়ে প্রাননাশের হুমকি দেওয়ার বিষয়ে সাধারন ডায়রি করি।
এরপর শুনলাম প্রায় সাত আটজন বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ার কে একই হুমকি দেওয়া হয়েছে।
সেদিন থেকে পাহাড়ায় থাকা আনসারকে ও সন্দেহ হতো।
পেটের ভাত আর রাতের ঘুম সব অভিশপ্ত হয়ে উঠলো। অমাবস্যায় ঢেকে গেলো চিটাগাং বিসিএসআইআর। আর গবেষনাগারের আবাসিক এলাকায় যেনো নিরব আতংক ছড়িয়ে গেলো।

সবার মধ্যে ভয় আতংক। আমি আর ড.সাদিয়া এক সাথে থাকি। প্রতিটি মূহূর্তে যেনো মনে হতো এই বুঝি কেউ গেটের তালায় গুলি করলো। জানালার কাচ ভেঙে ভেতরে ঢুকলো।


ভয় আর আতংকে ড. সাদিয়া এক সময়ে অসুস্থ হয়ে গেল। আমরা কেউ গবেষনাগারের বাইরে যাই না। এর ভেতরেই চলে জীবন। যা কিছু লাগে কেয়ার টেকার এনে দেয়।
সে আতংক আরও কয়েকশগুন বেড়ে যায় যখন জানা গেলো ভিআইপি গেস্ট হাউজে রাতে মাইক্রোবাস করে ডিরেক্টর ম্যাডামকে অপহরণ করতে এসেছিলো ।
আবারও সাধারন ডায়রি। এবার হাটহাজারি থানায়। পুলিশের এসপি, ওসি আসে। গেস্ট হাউজে সিসি ক্যামেরা লাগাতে বলে।
ভয়ে আর আতংকে আমি হয়তো আজও স্বাভাবিক হতে পারিনি।
সে আতংকটা এখনও মনের মধ্যে মাঝে মাঝেই ঝাকিয়ে উঠে।
এরপরের ঘটনা আরও ভয়াবহ। ডিরেক্টর ম্যাডামের এক ছেলে আর্মিতে এবং আরেক ছেলে নেভিতে। প্রায়ই মায়ের সাথে দেখা করতে আসে। ছেলের সাথে দেখা করে ফেরার পথে তার গাড়িতে হামলা হয়।
কপালের জোরে সেদিন তারা বেচেঁ যায়।
কে বা কারা রহস্যজনক ভাবে এমন করছে তা আজও রহস্য।

৯২.৫ একরের এই বিশাল গবেষনাগারের যথাযথ লোকবল সেখানে নেই।
সরকারের এই সম্পদকে স্থানিয় কিছু মাস্তান সময় সূযোগে নিজেদের মতো ব্যবহার করছে।
উচ্চ পদস্থ যারা আসে তারা ঢাকা কিংবা অন্য এলাকার হওয়ায় স্থানিয় চিটাগাংয়ের লোকজন এই বিশাল এলাকাকে নিজেদের সম্পদই মনে করে।

গায়ের জোরে কিংবা কৌশলে বনভূমির গাছ চুরি থেকে যেকোন অপকর্ম নির্দিধায় তারা করে।
নিরাপত্তা আর প্রশাসনিক জটিলতার কারনে অনেকেই নিরবে চাকরি করে।
এতো বড় একটা গবেষনাগার। অথচ এর সামনে বিশাল ময়লার স্তুপ। আশে পাশে কোন ভালো রেস্তরাঁ নেই।
ভাল রেস্তরাঁয় খেতে গেলে শহরে যেতে হবে।
তাছাড়া সংস্কৃতি এবং জীবন যাত্রার দিক থেকেও সেখানকার মানুষ গুলো রক্ষনশীল এবং কিছুটা স্বার্থপর প্রকৃতির।চিটাগাংয়ের বাইরের
নতুন কেউ চাকরিতে গেলে তার জীবন খুবই কঠিন।

তবে এটা ঠিক দুই একটা ভালো মানুষ পৃথিবীর সব জায়গায় আছে। সেখানকার কমিশনার শহীদ( বালুচরা বর্তমান কমিশনার ) এবং তার ছোট ভাই ব্যবসায়ী ফটোগ্রাফার জুবায়েত আরেফিন সহ তাদের পরিবার আমাদের সবাইকে খুবই মানসিক সহযোগীতা দিয়েছেন। যেকোন পরিস্থির সময়ে তিনি চলে এসেছেন।
তাদের সার্বিক সহযোগীতার জন্য হয়তো আমরা দু:সময়ের তীব্রতা ভুলে থেকেছি।

গবেষনা একটি দেশ এবং জাতিকে উন্নত করে।
দেশের সম্মান এবং সমৃদ্ধি বাড়ায়। অথচ এই দেশে গবেষক এবং গবেষনাগার দুটোই অবহেলিত।
যেকোন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকেরা এই বিষয়গুলোর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকে কিন্তু দায়িত্ববান হতে খুব কম মানুষকে দেখা যায়।

একদিন সে জীবনটাও অতিত হয়ে গেলো। ড.সাদিয়া সহ আমরাও ঢাকা চলে এলাম।
কিন্তু অপরূপ সৌন্দর্যময় চিটাগাং বিসিএসআইআরের মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম
এই পৃথিবীর বিবেকবান আর শিক্ষিত মানুষ গুলো কি অবহেলা আর অবিচারই না করছে।
একদিন এই পৃথিবীর মানুষের ঘুমন্ত চোখ খুলবে। কিন্তু পৃথিবী ততোদিনে দু:খ ধারন করার ক্ষমতা হারাবে।