বিজ্ঞানী ও চিত্রশিল্পী মাহমুদা লাভলীর প্রথম গ্রন্থ ‘পাঁচফোড়ন’

নুরুন নাহার লিলিয়ান
Published : 26 March 2017, 09:09 AM
Updated : 26 March 2017, 09:09 AM

চিত্রশিল্পী মাহমুদা লাভলী নিজের মনের প্রশান্তির জন্য মনের নানা অভিব্যক্তিকে পেন্সিল কিংবা রঙে রূপ দিতে ভালবাসেন। কিন্তু এই বছর তিনি তার দীর্ঘ বর্ণীল জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, অর্জন, অনুভূতি আর ঘাত প্রতিঘাতকে আপন মনে শব্দে রূপ দিয়েছেন। সৃষ্টিশীল প্রকাশনা সংস্থা এ্যালবাম থেকে প্রকাশ হয় প্রথম গ্রন্থ "পাঁচফোড়ন"। কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে নয় বরং তার নিজের অনুভূতিতে লেখা গল্প, কবিতা, আত্মকথন, স্মৃতিকথা, অনুগল্প, মুক্তিযুদ্ধ, প্রকৃতি আর প্রেমানুভুতি সবই এক বইয়ে নিজস্ব শৈলীতে জায়গা করে নিয়েছে। সেই সাথে প্রতিটি লেখার সাথে তার নিজের আঁকা ছবিগুলোও আছে।

তিনি কোন প্রফেশনাল লেখক নন। কিন্তু তাঁর ব্যস্তময় জীবনের মাঝে নিজের অনুভূতি আর মতবাদ ব্যক্ত করতেই বিভিন্ন সময়ে লিখেন। বিজ্ঞানী মাহমুদা লাভলী বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত চট্টগ্রাম বিসিএসআইআর গবেষণাগার এর পরিচালক পদে কর্মরত। অনেক ব্যস্ত সময়ের মাঝেও জীবন থেকে পাওয়া কিছু বোধ আর অনুভূতি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাকে ছুঁয়ে দিয়েছে। নিজস্ব ভঙ্গিতে প্রকাশ করেছেন তাঁর একান্ত মনের অভিব্যক্তি। ছোট ছোট বিভিন্ন লেখা দিয়ে খুব সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে তাঁর বইটি। প্রতিটি লেখা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় সাবলীল ভাবে লেখা হয়েছে। প্রথম কবিতা "তার আগে একবার" এর কিছু কিছু লাইন প্রতিটি প্রেমিক হৃদয়ের চিরন্তন আকুলতা কে স্পর্শ করে যাবে।

"তার আগে একবার তুমি আমি অতৃপ্তি পূর্ণ করতে চাই ভেঙ্গে পুরনো জীবন, যে ভূমে বুনেছিলাম যমজ শস্য"- এই কবিতার মাঝ খানের আরও কিছু লাইন পাঠককে নস্টালজিক করবে।

"কেন যে মনে হয় মধ্য দুপুরে তুমি সেই স্মৃতিফলকের চূড়া ভাঙতে চাইছো, মনে হয় রাত গভীর হলে বুক থেকে ঝেড়ে ফেলো পুষ্পপ্রাসাদের কথোপকথন"। এই কবিতার পরে আছে খোলা দরজা, তারপরে আছে প্রেম, বিরহ আর পাওয়া না পাওয়ার এক ভিন্ন আত্মকথন। রাধাকৃষ্ণ নারী চরিত্র রাধার বয়ানের মধ্য দিয়ে এক তরুণ-তরুণীর ফেলে আসা প্রেম যা ৩৪ বছর পরও ফুরায় না।

নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর জীবন ফুরিয়ে গেলেও সেই প্রেম যেন আজও এক আছে। খুব সুন্দর সুন্দর শব্দ আর অনুভূতির মধ্য দিয়ে রাধা তার ভালবাসা প্রকাশ করেছেন কৃষ্ণের প্রতি। সেই আত্মকথন পড়লে হয়তো পাঠকের মনের অজান্তে ফেলে আসা প্রেম আর গভীর অনুভূতি গুলো আবারও ছুঁয়ে যাবে।

১২ টি পর্বে খুব এলোমেলো অনুভূতি গুছানো শব্দের মালা গেথেছে।
এরপর আছে কবিতা নির্জন দহন। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই একটা নির্জন মন সাতার কাটে অচেনা সমুদ্রে। নির্জনতার সাথে কবির যে গভীর মিতালী সেটাই প্রকাশ পেয়েছে। এর পর এই তো জীবন, স্বপ্ন সহ বেশ কয়েকটি কবিতা পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে।

এরপর সামাজিক নানা সমস্যা নিয়ে কিছু লেখা যেমন নারীর ক্ষমতা, নারীর কষ্ট, সামাজ চোখের দৈন্যতা, আর মুক্তিযুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার ডা. বাবা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধার অনেক স্মৃতি আর সেই সময়ে গোটা পরিবারকে ঘিরে যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আর জীবন যুদ্ধ তা স্মৃতিচারণ হয়েছে বইয়ের অনেকটা লেখা জুড়ে। যা এই প্রজন্মের কাছে অনেক অজানা তথ্য এবং অধ্যায় কে তুলে ধরবে।

এই বইয়ের সব শেষে যে কবিতাটি আছে তা হল ২০১৭। যেখানে তিনি ব্যক্ত করেছেন স্বপ্ন আর আশা আকাঙ্ক্ষার রহস্যময় খেলা- "হাসি-কান্না মিলে মিশে ফুরিয়ে গেল ২০১৬, ২০১৭ ভোরের আলো নিয়ে আসবে নতুন বছরের আগমনী বার্তা আমার জন্য কী আনবে আনন্দময় জীবন না কি সেই অনাহুত বিষণ্ণতা।"

নানা স্বাদের লেখার এক অপূর্ব সমাহার বই পাঁচফোড়ন। মশলার মতোই নানা রকম অনুভূতির প্রকাশ মুক্ত ছন্দে পাঠক হৃদয়ে সুরভি ছড়িয়ে দিবে।

শ্রদ্ধেয় এই লেখককে খুব কাছ থেকে আমি ছয় মাস দেখেছি। নীরব সমুদ্রের মতো অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানের ভান্ডার। সদা হাস্যোজ্জ্বল পরিপাটি আর কবিতার মতো নান্দনিক তাঁর নিভৃত জীবন। লেখকের জীবনে তাঁর চারপাশের মানুষ আর প্রকৃতি অনেক প্রভাব ফেলে। লেখক মাহমুদা লাভলীর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। তার প্রিয় কর্মস্থল চট্টগ্রাম বিসিএসআই আর গবেষণাগারের অসাধারণ মনোরম পরিবেশে হাঁটতে গিয়ে যেকোন সাধারণ মানুষ প্রকৃতি কিংবা পশু পাখির প্রেমে পড়বে। মনের অজান্তে দুই লাইন কবিতা আপন মনে জন্ম নিবে।

মানুষ কখনও পরিপূর্ণ হয় না। কিছু মানুষের মানবিক বোধ আর হৃদয়ের সৌন্দর্য সেই পূর্ণতাকেই ছুঁয়ে যায়। একজন লেখক বা কবিকে নম্রতা এবং শুদ্ধতা কে অলংকার করতে হয়না। সাথে প্রতিবাদী এবং প্রয়োজনে সাহসীও হতে হয়।

লেখক মাহমুদা লাভলীর কঠিন সুন্দর ব্যক্তিত্ব শুধু একজন মানুষকে ব্যাখ্যা করে না। তার একটি সুন্দর মনকেও প্রকাশ করে। তাঁর লেখনীতে সেই নিজস্বতা অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিকশিত হয়েছে। লেখকের জন্য অনেক শুভ কামনা রইলো।

বইয়ের নাম: পাঁচফোড়ন

মুল্য: ১৫০ টাকা

প্রকাশনা : এ্যালবাম প্রকাশনা

প্রকাশক : মঞ্জু রহমান

পাওয়া যাবে: চিটাগাং বিসিএস আই আর লাইব্রেরী, অনলাইন শপ অথবা লেখকের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করে।