আমেরিকান হোমলেস অভাবে নয়, স্বভাবে

নুরুন নাহার লিলিয়ান
Published : 2 April 2017, 10:52 AM
Updated : 2 April 2017, 10:52 AM

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস এঞ্জেলস শহরে যখন নামলাম খুব সকাল। ঘুমের ঘোর কাটেনি। বিশাল শরীরের কালো কালো আমেরিকান মহিলা পুলিশদের দেখে আমি কিছুটা বিস্মিত। সাথে তাদের প্রশিক্ষিত জার্মান শেফার্ড কুকুরগুলো। কুকুরগুলো খুব সচেতন দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমার কাছে কুকুরগুলো আমেরিকান মনে হলেও আমেরিকান মহিলা পুলিশদের মনে হয়েছে আফ্রিকান। ট্রলি নিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বার বার খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। আহা হলিউড। আমার মুভি প্রেমিক মন কতোবার ছুটে গেছে চোখ ধাঁধানো শহর লস এঞ্জেলসের হলিউডে। আনন্দ বিনোদন আভিজাত্য আর চলচ্চিত্রের প্রাণকেন্দ্র হলিউড। বাস্তবে এ আমি কি দেখছি!

না, দিনের হলিউড আর রাতের হলিউড অনেক তফাৎ। যাই হোক, ট্রেনে উঠেই দেখি বিশ্রী সব মেয়ের দল। হাতের নখে নানা রকম নেইল পলিসে আঁকা থাকলেও মনে হচ্ছে গত এক মাসেও গোসল করেনি। ট্রেনে উঠার আগে বেশ কয়েকটা পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল। সেই সাথে নীরব নিস্তব্ধ লস এঞ্জেলসের বাতাসটা যেন আজও গায়ে কাঁটা দেয়। মনে হয়েছিল সত্যি বাস্তবতা থেকে কোন হরর মুভির দৃশ্যে চলে গিয়েছিলাম। বাতাসের শব্দে যেন অন্য রকম সুর। সব কিছুই ঠিকঠাক আমারই মনে নানা শঙ্কা। নতুন জায়গায় গেলে যা হয়। সব কিছুই নিয়ম মতো করে পথে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের সামনে চানাচুর মুড়ি ওয়ালারা যেমন চানাচুর বিক্রি করে তেমন কয়েকজনকে দেখলাম।

তাদের আচরণ আর প্রকাশভঙ্গি খুব একটা ভদ্র ছিল বলে মনে হয়নি। খুব মনোযোগ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ একটা ব্লাক ম্যান এসে বলে গিভ এ ডলার ,আই এম হোমলেস। আমি অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, আই এম টুরিস্ট, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ? সে কাঁপতে কাঁপতে খিঁচ খিঁচ করতে করতে বলল, প্লিজ গিভ মি এ ডলার। আমি জায়গা থেকে সরে দাঁড়ালাম।

ট্রেন চলছিল নিজের নিয়মে। আমি ট্রেনে বিজ্ঞাপনগুলো দেখছিলাম। অনেক জায়গায় লেখা জব দেওয়া হবে। আবার কেউ আত্মহত্যা করতে চাইলে তাকে মানসিক সহযোগিতা এইসব। হঠাৎ দেখলাম খুবই নোংরা গেট আপের এক দল মেয়ে। আমার সামনে বসা দুটো বৃদ্ধ চোখ দিয়ে ভালো করে তাদের দেখে নিচ্ছে। কেউ কেউ খুব মনোযোগ দিয়ে বই কিংবা ম্যাগাজিন পড়ছে। তবে বিচিত্রতা দেখতে দেখতে মনে একটা ভালো লাগাও তৈরি হচ্ছিল। পৃথিবীর পথে পথে কতো রকমের মানুষ! কতো রকমের বিচিত্রতা! জীবনের ধরন কতো আলাদা। হঠাৎ আবার সেই হোমলেসদের কবলে পড়লাম। একটা পিছন থেকে এসে বলে, ডু ইউ নিড এক্সচেঞ্জ? আমি বললাম, সরি, আই ডোন্ট নিড। প্লিজ গো …।

সারাটা পথ অনেক ভালো কিছুও ছিল। সেই সাথে যে বিষয়টা মনে বার বার দাগ কাটছিল তা হল হোমলেসদের কথা। এর মধ্যে আমরা পৌঁছে গেছি হলিউড এলাকায়। আহা! আমার সেই স্বপ্নের হলিউড। টিনসেল টাউনের সেই হলিউড লেখা সাইন। কতো রকমের ভিজিটর। চারিদিকে রমরমা পরিবেশ। সেই সাথে স্ট্রিটগুলো জুড়ে ছিল হোমলেসদের আনাগোনা। দুজন তো প্রায় পা চেপে ধরলো। গিভ মি এ ডলার অর ইভেন সিঙ্গেল এ স্মাইল।

আমি স্মাইল দিলাম। হায়রে ডলার। চাইলেই কি পাওয়া যায়। রেস্তরাঁয় বসে এক স্প্যানিশের সাথে কথা হল। আসলে হোমলেস অনেকটা ইচ্ছাকৃত। ধারণা করা হয় ৮৪০০০ বিভিন্ন ধরনের হোমলেস আছে। কেউ কেউ জুয়া আর মাদকে হারিয়েছে সব। কাজে আর মন বসে না। আবার কেউ কেউ তরুণ যারা অনেক দূর থেকে এসেছে সিনেমার তারকা হতে। কিন্তু বাড়িওয়ালারা সাইন বোর্ডে ঝুলিয়ে দিয়েছে। নো ডগ। নো একটর।

কুকুরসহ কেউ কিংবা অভিনেতা ভাড়া দেওয়া হয়না। কোথায় যাবে? রাস্তাই তাদের ঠিকানা। আরও যে কতো কারণে। বছর শেষে তাদের পর্যাপ্ত ভাতা আছে। কাজের ক্ষেত্রও যে কম তা কিন্তু নয়। স্বভাব যাদের মদ, জুয়া আর দেওলিয়া হওয়া। তাদের দিকে তাকিয়ে আমেরিকা বিচার করা যায়না। আমেরিকার একেকটা অঙ্গ রাজ্যের নিয়ম আইন কানুন, জীবন মান, মানুষ অনেক অনেক আলাদা। এক হোমলেস সমস্যা দিয়ে কখনও বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ আমেরিকাকে বিচারা করা যায় না। আমেরিকা মানে শুধু নিউইয়র্ক নয়। আমেরিকা মানে শুধু ফ্লোরিডা নয়। আমেরিকা মানে শুধু লস এঞ্জেলস নয়। এক আমেরিকা অনেক অঙ্গ রাজ্যের অনেক আলাদা আলাদা গল্প। একটা গল্প দিয়ে আমেরিকাকে বিচার করা যায় না।

তবে সব কিছুর পরেও হলিউডের ম্যাক্স মিউজিয়াম, হলিউড সাইন, সমুদ্র, পাহাড়, চার্চ, বড় বড় ঐতিহাসিক ব্লিল্ডিং, জমজমাট বিলাস বহুল রেস্তরাঁ সবই ছুঁয়ে গেছে মন। কোন একদিন সময় হলে স্মৃতিচারণ হবে হলিউডের যে স্মৃতিগুলো মনে দোলা দিয়ে গেছে তা নিয়ে।

ইদানিং বিভিন্ন কারণে আমেরিকা বেশ সমালোচিত হচ্ছে। অনেক বাংলাদেশীরাও দেখি নিজের দেশ রেখে ওদের সমস্যা নিয়ে চিন্তিত। এই বাংলদেশিদের আলোচনা সমালোচনার ভিত্তিতে আমি কয়েক ধরনের বাংলাদেশি দেখি। তবে আমার নিজের দৃষ্টিতে বিদেশে দুই ধরনের প্রবাসী বাংলাদেশি বেশি দেখা যায়।

এক.

যারা সারাক্ষণ বিদেশের বদনাম করতে থাকে যেন কেউ বিদেশের প্রতি আগ্রহী না হয়। গাল-গল্প তারা একলাই করবে। অথচ দিব্বি সিটিজেনশিপ নিয়ে বসে আছে। মনে মনে বলে ডিসগাস্টিং বাংলাদেশিরা যেন তাদের জায়গা দখল না করে। নিজের আগামী প্রজন্মকে আমেরিকান হতেই শেখায়। তাই কেউ আর বাংলাদেশী বলে না। প্রাউড টু বি এন আমেরিকান বলে নিজেদের জাহির করে। নিজেদের আমেরিকান দাবি করে গর্ব করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে।

দুই.

আরেক শ্রেণী আছে। যারা বলবে কেন যে মানুষ বিদেশে যায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হতে। দেখা যাবে তাকে একবার সুযোগ দেওয়া হোক সে চতুর্থ শ্রেণির নাগরিক হয়ে হলেও যাবে। এক সময়ে এমন ভাব দেখাবে কেন যে গরীব বাংলাদেশে তাদের জন্ম হয়েছিল। বাংলাদেশে মানুষ ছাড়া আর কি আছে। দূর ওই দেশে ফিরে কে যায়। এই হলো এক শ্রেণীর কিছু প্রবাসী বাংলাদেশির মনোবৃত্তি।

সবাই এক হয়না। এর মধ্যে অনেক ভালো ভালো বাংলাদেশি আছে। যারা নিজের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের মেধা দিয়ে প্রমাণ করছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের মানচিত্র পৃথিবীর কাছে আরও স্পষ্ট হচ্ছে।

আমেরিকায় যতই সমস্যাই থাকুক, আমেরিকা সব দিক থেকে আজও এগিয়ে। সম্পদ কিংবা কুটবুদ্ধি সবই আছে। নিজের দেশের এবং নিজের ব্যক্তিগত মান উন্নয়নের জন্য সব মানুষের পৃথিবী দেখা উচিত। সময়, সুযোগ আর সামর্থ্য থাকলে সবারই দেশ-বিদেশ ঘুরে দেখা উচিত। বিদেশিরা আমাদের ওদের দেশে সুযোগ না দিলে আমরা কি নিজেদের মেধা বা যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারতাম? কিংবা আমাদের দেশে বিনিয়োগ না করলে কি ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হতো? বুঝিনা তবুও কেন জানি আমরা স্ববিরোধী সমালোচনা ছাড়া থাকতে পারি না। বাস্তবতা অনেক কঠিন। একটি অনুন্নত দেশে ভালো থাকা আর উন্নত দেশে খারাপ থাকা কখনও এক নয়। অনেক দিক থেকে আমরা যেমন ভালো নেই। আবার অনেক দিক থেকে আমরা অনেক ভালো আছি।