জয়তু গাগারিন, জয়তু আর্মস্ট্রং

নাদিরা মজুমদার
Published : 16 Feb 2011, 05:32 AM
Updated : 4 Sept 2012, 02:23 PM

নীল আর্মস্ট্রং চলে গেলেন। হৃদপিন্ডে রক্তসরবরাহকারী প্রধান ধমনিতে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়াতে তাঁর সার্জারি করা হয় ২৩শে আগস্ট; এর দু'দিন বাদে, ২৫শে আগস্ট তিনি মারা যান; বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।

চাঁদের বুকে সর্বপ্রথম অবতরণ করে নীল আর্মস্ট্রং মহাশূণ্য অভিযানের ইতিহাসে প্রথম মানব হিসেবে অমরত্ব অর্জন করেন। তাঁর মৃত্যু আবার আমাদের মহাশূণ্য প্রতিযোগিতার নস্টালজিয়াতেও নিয়ে যায়। সঠিক অর্থে পঞ্চাশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে মহাশূণ্য অভিযান যে ঘনত্ব পেতে শুরু করে – তার সঙ্গে জড়িত ছিল পৃথিবীর প্রধান দুই রাজনৈতিক শিবিরের তীব্র প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা। 'প্রতিযোগিতা' ছিল মহাশূণ্য অভিযানের মূল তাড়না।

মহাশূণ্য অভিযানের গল্প বলতে গেলে তাই অনিবার্যভাবেই নীল আর্মস্ট্রং ও ইউরি আলেকসেইভিচ গাগারিনের নাম পাশাপাশি চলে আসতে বাধ্য। ১৯৬১ সালের ১২ই এপ্রিল গাগারিন ভোস্টক-১ নামক মহাকাশযানে চেপে বাইরের বিশ্বের চারদিকটি একবার ঘুরে আসেন। এভাবেই মহাশূণ্য অভিযানে মানুষের সরাসরি জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়, এবং বিশ্বের প্রথম নভোচারীর স্থানটি চিরকালের জন্য দখল করে নেন তিনি। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। দুঃখের বিষয়, ১৯৬৮ সালের ২৭ মার্চ ট্রেনিংরত অবস্থায় বিমান র্দুঘটনায় মারা যান তিনি, মাত্র ৩৪ বছর বয়সে।

১৯৬৯ সালের ২১শে জুলাই আর্মস্ট্রং প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদে অবতরণ করেন। গাগারিন তা দেখে যেতে পারেননি। তখন আর্মস্ট্রংয়ের বয়স ছিল মাত্র ২৯। বয়সের হিসেবে গাগারিনের চেয়ে চার বছরের বড় হলেও, আসলে গাগারিন ও আর্মস্ট্রং যথেষ্ট কম বয়সেই নভোচারীর তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। মানুষবাহী মহাশূণ্য অভিযানের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে একটা পর্ব পর্যন্ত তরুণ বয়সীদের মহাশূণ্য অভিযানে পাঠানো হত।

এ্যপোলো-১১ মহাকাশযানটি নাসা'র এ্যপোলো মিশনের পঞ্চম মানুষবাহী মিশন। এই মহাযানটিতে নীল আর্মস্ট্রং ছাড়াও ছিলেন বায অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স নামের আরও দু'জন নভোচারী। মহাযানটির ছিল সাকুল্যে তিনটে অংশ: তিন নভোচারীর থাকার উপযুক্ত কমান্ড-মডিউল কলম্বিয়া- চাঁদের চারদিকে ঘোরার সময়, কলিন্স ছিলেন এর কমান্ডার। ফিরতি-যাত্রায় মহাযানের কেবলমাত্র এই অংশটিই পৃথিবীতে ফিরে আসে। তাই তাতে ছিল ফিরতি-যাত্রার যন্ত্রপাতি ও স্প্যাশডাউন বা প্যারাস্যুটের সাহায্যে পৃথিবীর জলে অবতরণের ব্যবস্থা; প্রচলনশক্তি, বিদ্যুৎশক্তি ও জল সরবরাহকারী সার্ভিস মডিউল ও চাঁদে অবতরণের জন্য চন্দ্রযান লুনার মডিউল-ঈগল। শেষোক্ত মডিউল দুটোকে ফিরতি পথে মহাশূন্যে ফেলে আসা হয়। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল যে লুনার মডিউলটি অনন্তকাল ধরে চাঁদের চারদিকে ঘুরে বেড়াবে; কিন্তু তা আর হয় না। চাঁদের অভির্কষ-ক্ষেত্র মোটেই সুষম নয় বলে লুনার মডিউলের চান্দ্রিক কক্ষপথ ক্ষয় হতে শুরু করে, এবং শেষতক কয়েকমাস পরে চাঁদের অজানা কোনও অঞ্চলে সেটি ধ্বসে পড়ে। নীল আর্মস্ট্রং ছিলেন এ্যপোলো-১১ মিশনের কমান্ডার। চাঁদের পথে পাড়ি দেওয়ার আগে তিন নভোচারীরই মহাকাশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল।

১৯৬৯ সালের জুলাই মাসের ১৬ তারিখে ফ্লোরিডাতে অবস্থিত কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে মানুষবাহী এ্যপোলো-১১ উৎক্ষেপ করা হয় স্যাটার্ন-৫ নামক রকেটের সাহায্যে। সমন্বয় বিধানকারী সর্বজনীন সময় বা ইউটিসি অনুযায়ী দুপুর একটা বত্রিশ মিনিটে উৎক্ষেপন সম্পূর্ণ হয়। উৎক্ষেপণের মিনিট বারো পরে মহাযানটি কক্ষপথে প্রবেশ করে। আরও দেড়ঘন্টা বাদে স্যাটার্ন রকেটের তৃতীয় পর্বটি এ্যপোলো-১১' কে চাঁদের দিকে ঠেলে দেয়। এই পর্বের প্রায় ত্রিশ মিনিট বাদে, রকেটের সর্বশেষ কাজ হয় কমান্ড ও সার্ভিস মডিউলের জোড়া থেকে আলাদা হয়ে খসে যাওয়া, যাতে চন্দ্র-মডিউল ঈগল জোড়া মডিউলের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। এভাবে এ্যপোলোর তিনটি অংশ একত্রিত হয়ে যাওয়ার পরে, সম্মিলিত মহাযানটি চাঁদের বঙ্কিম পথের দিকে ধাবিত হয়। ইত্যবসরে চাঁদে আসতে তিনটি দিন পার হয়ে গেছে। পৃথিবীতে তখন জুলাই মাসের ১৯ তারিখ চলছে; পৃথিবীর ইউটিসি অনুযায়ী বিকেল পাঁচটা একুশ মিনিটে সার্ভিস মডিউলে অবস্থিত প্রচালনশক্তি বা প্রপালশন ইঞ্জিন সক্রিয় হয়ে ওঠে; এ্যপোলোকে চাঁদের কক্ষপথে সহজ প্রবেশ করিয়ে দেয় সে। মহাযানসমেত তিন মহাচারী সেই মুহূর্তে কিন্তু চাঁদের যে অংশটি আমরা কোনওদিনই দেখতে পাই না, সেই অংশে ছিলেন। চাঁদে অবতরণের লাগসই জায়গা বাছতে নভচারীরা কম করে হলেও ত্রিশবার চাঁদের চারদিকে চক্কর দেন। যাহোক, শেষ পর্যন্ত জায়গা একটি পছন্দ হয়, কিন্তু তবু তাদের অন্য জায়গায় অবতরণ করতে হয়।

এবার আর্মস্ট্রং ও অলড্রিনকে কমান্ড-মডিউল কলম্বিয়া ছেড়ে ঈগলে যেতে হবে। কলম্বিয়ার কমান্ডার হিসেবে কলিন্স সরেজমিনে ঈগলকে শেষ পরির্দশন করেন আবারও। কোনও ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন কোথাও নেই; সন্তুষ্ট তিনি। আর্মস্ট্রং ও অলড্রিন চলে আসেন ঈগলে। পৃথিবীতে তখন ২০শে জুলাই চলছে। যথারীতি ঈগল কলম্বিয়া থেকে আলাদা হয়ে যায়, চাঁদমুখি অবরোহণ শুরু হয় ঈগলের। কলম্বিয়াতে কলিন্স একেবারে একা হয়ে পড়েন। ঈগলের অবরোহণকালে আর্মস্ট্রং ও অলড্রিন দেখেন যে অবতরণের জন্য চাঁদে তাঁরা যে জায়গাটিকে চিহ্নিত করেছিলেন, সেটি চার সেকেন্ড আগেই অতিক্রম করে যাচ্ছেন তাঁরা। এর অর্থ, তাঁদের বেশ কয়েক মাইল পশ্চিমে গিয়ে অন্য কোথাও নামতে হবে। অন্য যেখানটায় তাঁরা অবতরণ করেন, অবতরণের পরপরই সেই জায়গাটিকে আর্মস্ট্রং 'প্রশান্তির সাগর' (সী অব ট্রানকুয়িলিটি) নামে অভিহিত করে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণরুমে বার্তা পাঠান। ইউটিসি অনুযায়ী তারিখ ২০শে জুলাই, সময় তখন রাত আটটা আঠারো মিনিট। মহাশূণ্য অভিযানে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। আর্মস্ট্রং ও অলড্রিন কিন্তু তখনও ঈগলের ভেতরে রয়েছেন।

আরও ছয়ঘন্টা বাদে, ইউটিসি সময়মতে, ২১শে জুলাইয়ের অতিপ্রত্যুষে, দু'টা ছাপ্পান্ন মিনিটে, নীল আর্মস্ট্রং ঈগলের দরজাটি খুলে ফেলেন। খুব সাবধানে, ধীরে ধীরে ছোট্ট মইটি বসিয়ে নেমে আসেন চাঁদের জমির খুব কাছে। তারপর একেবারে চাঁদের জমিতেই। সৃষ্টি হয় ইতিহাস, যুক্তরাষ্টের তথা পৃথিবীর প্রথম মানুষ চাঁদের মাটিতে পা রেখেছেন! রূপকথার চাঁদ মানুষের স্পর্শের মধ্যে চলে এল। ভারি অবিশ্বাস্য ঘটনা নয় কি? অবিশ্বাস্যই বটে! তাই অনেকদিন পর্যন্ত বিতর্ক, আলোচনা, ফিল্মের মাধ্যমে নাসার 'ধোঁকাবাজি' প্রমাণের প্রয়াসও অব্যাহত থাকে। হয়ত মাঝেমধ্যে এখনও এই প্রয়াসের ছিঁটেফোঁটার সাক্ষাৎ মিললেও মিলতে পারে।

নিঃসন্দেহ যে এই সাফল্য যুক্তরাষ্ট্রকে মহাশূণ্য প্রতিযোগিতাকে প্রথম সারিতে নিয়ে আসে। রুশ বা আদতে সোভিয়েত গাগারিনের প্রথম বহির্বিশ্ব পরিভ্রমণ যে আত্মশ্লাঘার সৃষ্টি করেছিল – আর্মস্ট্রংয়ের চাঁদের বুকের প্রথম ছাপটি তার অনেকখানিই মসৃণ করে দেয়। এ্যপোলো-১১ মিশনের উৎক্ষেপের দিনতিনেক আগে, ১৩ই জুলাই সোভিয়েতরা চাঁদের বিভিন্ন এলাকার মাটি খুঁড়ে সংগ্রহ করার ও পৃথিবীতে নিয়ে আসার জন্য পাঠায় লুনা-১৫' কে। সেইমতো লুনা-১৫ কিন্তু ঈগলের আগেই চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে। লুনা-১৫ ও এ্যপোলো-১১, এই সমাšতরাল মিশন মহাশূণ্য প্রতিযোগিতার চরম পরিণতিকেই প্রতীকায়িত করছে। তবে বৃহত্তর মঙ্গলের স্বার্থে – র্অথাৎ ঈগলের সঙ্গে সম্ভাব্য সংর্ঘষ এড়ানোর জন্য সোভিয়েতরা লুনা-১৫ য়ের ফ্লাইট প্ল্যান যুক্তরাষ্ট্রকে আগাম জানিয়ে দেয়। আরেকভাবে তাই একে সোভিয়েত-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগের প্রথম পদক্ষেপ বলেও চিহ্নিত করা যায়। সোভিয়েতদের কপাল মন্দ ছিল। চাঁদে অবতরণের সময় যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে লুনার শেষপর্যন্ত আর চাঁদে অবতরণ করা হয় না, ওটি বিধ্বস্স্ত হয়ে চাঁদের জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। লুনার এই অদৃষ্টটি ইংল্যান্ডের জাঁদরেল ব্যাঙ্ক মানমন্দিরের রেডিও-টেলিস্কোপটি রের্কড করেছিল। ২০০৯ সালে এ্যপোলো-১১' র ৪০তম বার্ষিকীর সময় তা প্রকাশ করা হয়।

চাঁদের বুকে বায অলড্রিন ছিলেন দ্বিতীয় মানুষ। তাঁরা সর্বসাকুল্যে প্রায় সাড়ে একুশ ঘন্টা চাঁদে অবস্থান করেন, এবং প্রায় আড়াই ঘন্টা কাটে ঈগলের বাইরে মুক্ত চাঁদের জমিতে। এরপর দুই চাঁদ-বিজয়ী ঈগলে চেপে ফিরে আসেন কলিন্সের কমান্ড-মডিউল কলম্বিয়াতে, সঙ্গে থাকে ২২ কিলোগ্রামেরও বেশি পরিমাণ দুষ্প্রাপ্য মাটি, পাথর ইত্যাদির সংগ্রহ। অবশেষে কলিন্সের ১৫ ঘন্টা স্থায়ী সোলো পরিভ্রমণের অবসান ঘটে। র্দীঘ আটটি দিন পৃথিবী থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থানের পর তিন নভোচারী ২৪ জুলাই নিরাপদে ফিরে আসেন পৃথিবীতে। এই দুই চাঁদভ্রমণকারীর পর যুক্তরাষ্ট্রের আরও ২২ জন নভোচারী চাঁদ ভ্রমণে গিয়েছিলেন।

চাঁদের এত কাছে গিয়েও কলিন্স চাঁদে নামতে পারেননি। সুদূর মহাশূণ্যে প্রায় ১৫ ঘন্টা ছিলেন একেবারেই নিঃসঙ্গ; তাছাড়া প্রতিটি ৪৮ মিনিট স্থায়ী কক্ষপথীয় ভ্রমণের সময় পৃথিবীর সঙ্গে রেডিও-সংযোগবিহীন থাকতে হয়েছে তাঁকে। আত্মজীবনীতে কলিন্স লিখেছেন যে, একাকীত্ববোধ করেননি তিনি; বরং "সচেতনতা, পূর্বজ্ঞান, আস্থাশীলতা, সন্তুষ্টিবোধ ও প্রায় জয়োল্লাসের অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রাখে। "এই ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগটি তিনজনকে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। আমার ভূমিকা বাকি দুই সঙ্গীর মতোই ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য।''

মইয়ের শেষ ধাপটিতে পা রেখে আর্মস্ট্রং প্রথমে "লেম (লুনার মডিউল) ছাড়তে যাচ্ছি এবারে", বলেই ঘুরে দাঁড়ান ও বাঁ পা'টি চাঁদের জমিতে রাখেন; জমির ধূলার বর্ণনা দেন "অতি মসৃণ-কণা, প্রায় পাউডারের মতো," তারপরই উচ্চারণ করেন বিখ্যাত সেই শব্দগুলো "(এক) মানুষের ছোট্ট এই পদক্ষেপ, মানবজাতির জন্য সুবিশাল এক লাফ।'' এই শব্দকয়টির রচনাকারী ছিলেন স্বয়ং আর্মস্ট্রং। এর পরপরই অলড্রিন যোগ দেন আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গে, বলেন "চমকপ্রদ নিরালয়।'' তবে তিনি বাক্যে "এক মানুষ" বা ইংরেজিতে "(এ) ম্যান" বলেননি; পৃথিবীতে রের্কডকৃত রেকর্ডে তার কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি। এমনকি স্বয়ং আর্মস্ট্রংও বিশ্বাস করতে চাননি যে "(এ) ম্যান" বলেননি তিনি। বাক্য থেকে "(এ বা এক)" য়ের বিচ্যুতির কারণে একজনের বদলে পুরো মানবজাতিকে বোঝাবে। আর্মস্ট্রং নিশ্চয়ই নিজের সেই ছোট্ট পদক্ষেপের কথাই বলেছিলেন! অনেকদিন পর্যন্ত "এক"য়ের এই অনাকাস্খিত ভাষাগত বিভ্রাট বা অসঙ্গতি মেনে নিতে আর্মস্ট্রংয়ের বেশ অসুবিধে হয়। তবে শেষপর্যন্ত বলেন যে, ইতিহাস তাঁর এই অক্ষর-বিচ্যুতিকে ক্ষমাসুন্দর চোখে মেনে নেবে নিশ্চয়ই। বা খুব সম্ভবত তাঁর কন্ঠনালীর ভেতরে প্রয়োজনীয় অক্ষরটি থেকে গিয়েছিল। কারণ, আমরা জানি যে এ্যপোলো-১১ য়ের উৎক্ষেপণকালে আর্মস্ট্রংয়ের হার্টবিটের উর্ধ্বহার মিনিট প্রতি ১১০ বিট হয়েছিল; ঈগল থেকে মই বেয়ে চাঁদে নামার সময়ও হার্টবিট কি 'বিশ্বাসঘাতকতা' করেনি! তবে অন্তত ভালো খবর ছিল যে নভোচারীদের কেউই, মহাশূন্যে ওজনহীনতার কারণে, স্পেস সিকনেসের শিকার হননি।

মহাশূণ্যে, পৃথিবীর চারদিকে ঘোরার সময়ে গাগারিন কী বলেছিলেন, জানা যায়নি। তবে মহাশূণ্য থেকে ফিরে আসার পর তিনি তাঁর অনুভূতির কথা বলেন এভাবে, "পৃথিবীর পরিবেশের সঙ্গে তুলনা করলে বলতেই হয় যে ওজনহীনতার অনুভূতিটি একেবারেই একটি অপরিচিত অভিজ্ঞতা। মনে হয় যেন ফিতায় বাঁধা হয়ে আভূমিক অবস্থানে রয়েছ তুমি। অনুভব করো- যেনবা তুমি ঝুলন্ত অবস্থায় ভেসে আছ।'' সে সময়ে সোভিয়েত প্রধান ছিলেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ। ক্রুশ্চেভের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় গাগারিন তাঁকে বলেন যে, পৃথিবীর চারদিকে পরিভ্রমণকালে তিনি দিমিত্রি শসতাকোভিচের সুর দেওয়া বিখ্যাত গানটির প্রথম দুই লাইন "মাতৃভূমি শুনছে, মাতৃভূমি জানছে/আকাশের কোথায় ছেলে তার উড়ছে" শিষ দিয়ে গেয়েছিলেন। (শসতাকোভিচ ইউরোপীয় র্মাগসঙ্গীতের প্রথম সারির রচনাকারী ছিলেন। এই বাক্যগুলো লিখেছিলেন ইয়েভগেনি দোলমাতভ্স্কি)।

তবে গাগারিনকে নিয়েও সামান্য বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ বলেন যে পরিভ্রমণকালে গাগারিন নাকি মন্তব্য করেন "এই উপরে কোথাও ইশ্বরকে দেখছি না।'' কিন্তু তাঁর ফ্লাইট রেকর্ডে এ ধরনের কোনও মন্তব্য রের্কডকৃত নেই। হতে পারে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের লক্ষ্যে কেউ গাগারিনের নাম করে কথাগুলো বলেছেন। কারণ, শিশু বয়সেই গাগারিন খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন, এবং মহাশূণ্য পরিভ্রমণের আগে তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যার অভিসিঞ্চন করা হয়। গাগারিন পরিবার বড়দিন, ঈস্টার (রুশ অর্থোডক্স অনুযায়ী) ইত্যাদি র্ধমীয় উৎসবও সবসময় পালন করতেন।

রাজনৈতিকভাবে দুই তাঁবুতে বিভক্ত পৃথিবীতে, ঠান্ডাযুদ্ধের ভরা মৌসুম চলছে তখন। ইউরি গাগারিন মিগ-১৫' য়ের ট্রেনিংকালে ১৯৬৮ সালের মার্চমাসে র্দুঘটনায় নিহত হন। পাশ্চাত্যজগত দুর্ঘটনাটিকে বরং সোভিয়েত পলিটব্যুরোর অপকাজ বলে প্রচার করে। এই অপবাদের অবসান ঘটে যখন রুশ ফেডারেশন দুর্ঘটনায় গাগারিনের মৃত্যুসংক্রান্ত র্আকাইভকৃত দলিল প্রকাশ করে।

বহির্বিশ্ব ঘুরে আসার পরে গাগারিন রাতারাতি স্বদেশে ও বিদেশে সেলিব্রিটিতে পরিণত হন। সারাদেশে ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিভ্রমণে যান তিনি; সঙ্গে থাকে সুন্দর নির্মল গাগারিনীয় হাসি – যে হাসিটি ঠান্ডাযুদ্ধের শীতলতায় নিয়ে আসে উষ্ণতার আরামদায়ক স্পর্শ। মানুষের মন জয় করতে ছিলেন কুশলী, সুদক্ষ; আর তাঁর প্রধান মূলধন ছিল হাসি। তাই তাঁর মাত্র মাত্র এক মিটার সাতান্ন সেন্টিমিটার উচ্চতা কোনও অন্তরায় হয়নি। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে যখন ভ্রমণ করছিলেন, তাঁকে এক নজর দেখার জন্য জনতার ঢল বৃষ্টির মধ্যেও অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়ির হুড তুলে দেওয়া তো দূরের কথা, কাউকে তিনি তাঁর মাথার ওপর ছাতা খুলে ধরতেও দেননি। তাঁর কথাই ছিল যে এত এত লোক যদি তাঁকে স্বাগত জানাতে, বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তবে তিনিই-বা কেন সামান্য একটু ভিজতে পারবেন না? খোলাগাড়িতে, সম্পূর্ণ পথটিতে দাঁড়িয়ে থেকে গাগারিন অজস্র মানুষের উদ্দীপিত অভিনন্দন গ্রহণ করেন।

অজস্র পদক ও টাইটেলসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সম্মান "হিরো অব দি সোভিয়েত ইউনিয়ন"ও তিনি অর্জন করেন। ছিলেন নিয়তিনির্দিষ্ট সয়ুজ-১' মিশনের কমান্ডার ভ­াদিমির কোমারভের ব্যাকআপ ক্রু। ১৯৬৭ সালের এপ্রিলমাসে পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের সময়ে সয়ুজ-১ মিশনের প্যারাস্যুটটি খোলে না। ফলে, তা বিধ্বস্ত হয়; কোমারভও নিহত হন। মহাশূণ্য-উড্ডয়ন ইতিহাসে এটিই ছিল প্রথম ইন-ফ্লাইট প্রাণনাশক র্দুঘটনা। ঠান্ডাযুদ্ধকে ভিত্তি করে যত আবেগ-উত্তেজনাই বিরাজ করুক না কেন – নাসার মহাশূণ্য প্রকল্প মহাশূণ্যে ঘুরে আসা প্রথম মানুষটিকে ও প্রথম ইন-ফ্লাইট নিহত কোমারভকে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি ও সম্মান দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না।

নীল আর্মস্ট্রংয়ের চন্দ্রাবতরণ গাগারিন ও কোমারভ দেখে যেতে পারেননি। তবে আর্মস্ট্রং ও অলড্রিন চাঁদে যে সব জিনিসপত্র রেখে আসেন, সেইসঙ্গে ছিল একটি স্মারক ব্যাগও – তার ভেতরে রয়েছে গাগারিন ও কোমারভের নিজস্ব কিছু পদক। একইভাবে, তীব্র মহাশূণ্য প্রতিযোগিতার দিনগুলোতে মহাশূণ্য অভিযানে নিবেদিত যে নভোচারীরা – যুক্তরাষ্ট্রের ও সোভিয়েত ইউনিয়নের – প্রাণ হারান, তাঁদের স্মরণে এলুমিনিয়ামের পাতে তাঁদের নামাঙ্কিত একটি ফলক এ্যপোলো-১৫' য়ের দুই নভোচারী, ডেভিড স্কট ও জেমস আরউইন, চাঁদের হ্যাডলি রিল নামক এলাকায় পুঁতে আসেন ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট। ফলকটির নাম "ফলেন এ্যষ্ট্রোনট।'' ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নিহত ১৪ জন নভোচারী ফলকটিতে রয়েছেন; গাগারিন ও কোমারভ ছাড়া আরও চারজন সোভিয়েত নভোচারী এবং যুক্তরাষ্ট্রের আটজন ফলকটিতে রয়েছেন। তালিকাতে আরও চারটি নাম, অসাবধানতাবশত, বাদ পড়ে যায়। তবে তা সংশোধন করা হয় কেনেডি স্পেস সেন্টারে (ফ্লোরিডায়) বিদ্যমান স্পেস মিরর মেমোরিয়ালে।

১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে স্পুতনিক-১' নামক পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে মহাশূণ্য প্রতিযোগিতার তীব্রতা ঘন হতে শুরু করে। তাই আর্মস্ট্রং ও অলড্রিনের চাঁদের জমিতে হেঁটে বেড়ানোর ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যুগান্তকারীত্বের সূচনা করে। এ্যপোলো-১১ মিশন যুক্তরাষ্ট্রকে মহাশূণ্য-প্রতিযোগিতার প্রথম স্থানে নিয়ে এলেও, তিন মিশন ক্রু দেশের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি "প্রেসিডেনশিয়াল মেডাল অব ফ্রিডম" র্অজন করেন ২০০৯ সালে। বয়সে এ্যপোলো-১১ মিশনের তিন ক্রু-ই প্রায় সমবয়সী, জন্মসাল ১৯৩০। চাঁদে ভ্রমণ করে এসেছেন, এমন জীবিত বারোজন বর্ষিয়ান নভোচারীর মধ্যে অলড্রিনই বয়োজ্যেষ্ঠ। নীল আর্মস্ট্রং দিনকয় আগে চলে গেলেন। মাইকেল কলিন্স ২৪ জন নভোচারীরই একজন, যিনি চাঁদের অতি কাছ গেলেও, চাঁদে নামেননি।

বলা হয় যে, চাঁদ থেকে ফিরে আসার পর আর্মস্ট্রং "হাই প্রোফাইলে"র জীবন এড়াতে প্রয়াসী হন, এবং সবধরনের বড় বড় চাকরির প্রস্তাব অনায়াসে অগ্রাহ্য করে চলে যান ওহাইয়োর সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর চাকরি নিয়ে, কিন্তু আসলে কি "লো প্রোফাইলে"র জীবন অর্জন করতে পেরেছিলেন তিনি? মোটেই না। জীবনের বিভিন্ন সময়, কখনও ছিলেন নানা কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টরের সদস্য, প্রতিরক্ষাবিষয়ক গবেষক, কখনও-বা নাসার ডাকেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। আসলে চাঁদে প্রথম পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই আর্মস্ট্রংয়ের জীবন স্থায়ীভাবে হাই প্রোফাইলের ফ্রেমে চিরকালের জন্য বাধা পড়ে যায়। স্পেস ফাউন্ডেশন সার্ভের জরিপ থেকে দেখা যায় যে ২০১০ সালেও আর্মস্ট্রং ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় 'স্পেস হিরো।' হবেন না কেন? নেদারল্যান্ডসের হেগে অনুষ্ঠিত সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি সামিটে, আশি বছর বয়সে আর্মস্ট্রং ঘোষণা করেন যে তাঁকে যদি মঙ্গল মিশনের কমান্ডার হতে বলা হয় তো রাজি আছেন তিনি।

গাগারিনের মতো আর্মস্ট্রংও রাতারাতি সেলিব্রিটিতে পরিণত হন। ৪৫-দিনের র্দীর্ঘ বিশ্বপরিক্রমায় বের হন তিনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন; যুদ্ধ তখনও চলছে। বিশ্বপরিক্রমার অংশ হিসেবে ভিয়েতনামে যুদ্ধরত সৈন্যদের জন্য আয়োজিত বব হোপের অনুষ্ঠানেও অংশ নেন। ১৯৭০ সালের মে মাসে ভালেন্তিনা তেরেশকোভার আমন্ত্রণে আর্মস্ট্রং তেরোতম আন্তর্জাতিক মহাশূণ্য গবেষণা কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন। পোল্যান্ড থেকে প্রথমে আসেন 'লেনিনগ্রাদে' (সেন্ট পিটার্সবার্গ), প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান মস্কোতে। এখানেই প্রথম পশ্চিমা হিসেবে আর্মস্ট্রংকে সুপারসনিক তুপোলেভ টিইউ-১৪৪ (তুপোলভ ছিল পৃথিবীর দ্বিতীয় সুপারসনিক পরিবহণ বিমান; কনকর্ড ছিল প্রখম) দেখানো হয়। তিনি ইউরি গাগারিন কসমোনটিক ট্রেনিং সেন্টারও দেখেন।

তবে এই ভ্রমণকালে সবচেয়ে বড় 'সারপ্রাইজ' হিসেবে আর্মস্ট্রং আবিষ্কার করেন যে প্রথম বেসামরিক মানুষ হিসেবে মহাশূণ্য পরিক্রমণের কৃতিত্ব তাঁর নয় – আসল কৃতিত্বের গরিমা তাঁরই আমন্ত্রণকারী ভালেন্তিনা তেরেশকোভার, পেশায় যিনি বস্ত্রশিল্প শ্রমিক ও সখের প্যারাস্যুটিষ্ট। ১৯৬৩ সালের জুন মাসের ১৬ তারিখে তেরেশকোভা ভোস্টক ৬' য়ে মহাশূণ্য ঘুরে আসেন। ফলে, প্রথম বেসামরিক ও প্রথম মহিলা নভোচারীর স্থানটি তিনি দখল করে নেন। আর্মস্ট্রংয়ের জন্য বাড়তি আরেকটি চমক ছিল যে, তিনি যখন তেরেশকোভার অতিথি, সেই মুহূর্তে তেরেশকোভার স্বামী আন্দ্রিয়ান নিকোলায়েভ সয়ুজ-৯ মিশনে মহাশূণ্য পরিভ্রমণে ব্যস্ত। (খবরটি তাঁর জানা ছিল না)।

২০১১ সালে, গাগারিনের মহাশূণ্য পরিক্রমণের অর্ধশতবর্ষে, বিশ্ববাসী স্বতস্ফুর্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রকাশে মোটেই কার্পণ্য করেনি। আন্তর্জাতিক মহাশূণ্য কেন্দ্র থেকে "প্রথম কক্ষপথ"( ফার্স্ট অরবিট) নামক একটি ফিল্ম তোলা হয়, সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় আদি ফ্লাইট অডিও-র ফুটেজ ও গাগারিনের পরিক্রমণ রুট। এমনকি সে সময় আন্তর্জাতিক মহাশূণ্য কেন্দ্রে অবস্থানরত রুশ, আমেরিকান ও ইতালির নভোচারীরাও বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে "শুভ ইউরির রাত" নামে বিশেষ ভিডিও-বার্তা প্রেরণ করেন। সুইজারল্যান্ডের এক ঘড়ি প্রস্তুতকারীও (বার্নার্ড লিডারার) সীমিত সংখ্যক ঘড়ি তৈরি করে গাগারিনের অর্ধশতবর্ষকে অমর করে রাখেন। সয়ুজ টিএমএ-২১ য়ের উৎক্ষেপণও (২০১১ সালের ৪ঠা এপ্রিল) অর্ধশতবর্ষের প্রতি নিবেদন করা হয়। রুশরা ২০০১ সালে গাগারিনের স্মরণে গাগারিন রুবল ইস্যু করে।

মহাশূণ্য প্রতিযোগিতার দুই প্রধান নায়ক ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। মোটামুটি ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল র্পর্যন্ত স্থায়ী প্রচন্ড প্রতিযোগিতার 'স্বর্ণযুগে' দুই দেশই বহির্বিশ্বের রহস্য উদঘাটনে অসংখ্য কৃত্রিম উপগ্রহ ও মনুষ্যবাহী অভিযান পরিচালনা করে। মহাশূণ্য অভিযানের প্রথম মাইলফলকটি বোধকরি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালে, রুশরা যখন আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্র মিসাইলের কৌশল করায়ত্ত করে। মহাযান উৎক্ষেপণে মিসাইলজাতীয় রকেট না হলেই নয়। তারপর থেকেই, মিশন প্রকল্পভেদে, রুশদের স্পুৎনিক, লুনা, ভোস্তক, ভোসখদ, ভেনেরা, সালিউৎ মিশন জন্ম নেয়। যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেয় এক্সপ্লোরার, প্রজেক্ট স্কোর, ভ্যানর্গাড, ডিসকাভার, টেলষ্টার, জেমিনি, এ্যপোলো, মেরাইনার ইত্যাদি মিশন। এই মিশনগুলোর প্রতিটিই এক একটি মাইলফলক স্থাপনের কাজ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে, চাঁদে মানুষের অবতরণের মধ্য দিয়ে যে র্শীর্ষত্ব অর্জিত হয় – রুশদের পক্ষে ঘটে ১৯৭১ সালে, যখন সালিউৎ-১ প্রথম মহাশূণ্য কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। র্বতমানের আন্তর্জাতিক মহাশূণ্য কেন্দ্র সালিউৎ-১'য়েরই ঐতিহ্য বহন করছে। প্রতিযোগিতার তীব্রতার হ্রাস ও সামঞ্জস্যপূর্ণ মানসিকতার পরিচয় বিশ্ববাসী অনুভব করে ১৯৭৫ সালে। এই বছরের জুলাই মাসের ১৫ তারিখে এ্যপোলো-সয়ুজ টেষ্ট প্রজেক্টের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যৌথ মিশনের নতুন এক যুগের সূচনা করে। এ্যপোলো-সয়ুজ দূর মহাশূণ্যে সংযুক্ত হয়; মিশনের নভোচারীরা সম্মিলিতভাবে ও এককভাবে প্রচুর বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পর্যালোচনা পরিচালনা করেন। এরপর থেকে মহাশূণ্য-প্রতিযোগিতা ক্রমশ বিলীন হয়ে যায়।

এই মিলেনিয়ামে চীন, ভারত, জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশ নিজস্ব মহাশূণ্য-মিশন শুরু করেছে। ১৯৭০ সালে প্রথম মহাযান (শেনযৌও) উৎক্ষেপণের পর র্দীঘদিন চুপচাপ থেকে চীন দ্রুত তার মহাশূণ্য-প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে ব্যস্ত। মহাশূণ্যে মহাযানের সংযুক্তি, লিউ ইয়াং নামের প্রথম নভোচারিনী প্রেরণ ইত্যাদি চীন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। ২০২০ সালের মধ্যে চীন নিজস্ব মহাশূণ্য-কেন্দ্র স্থাপনে আগ্রহী। তবে চীনা মহাশূণ্য-প্রকল্প পৃথকভাবে আলোচনার দাবি রাখে।

যে কোনও দেশই মহাশূণ্যভিত্তিক অনেক কিছুই করতে পারে, করবেও। তবে মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে, গাগারিন ও আর্মস্ট্রংয়ের স্থান কেউ কোনওদিন দখল করে নিতে পারবে না। তাঁদের কৃতিত্ব কেবলমাত্র এই নয় যে তাঁরা ছিলেন প্রথম মানুষ- একজন বহির্বিশ্ব পরিক্রমণে, দ্বিতীয়জন চাঁদের বুকে প্রথম পা রেখে; তাঁদের কৃতিত্বের মাহাত্ম্য, আর্মস্ট্রংয়ের ভাষায় বলতে হয় : ''জানি অনেক কঠিন ও জটিল প্রশ্ন এখনও রয়ে গেছে, তবে ১৯৬১ সালে যখন এ্যপোলো প্রকল্প গৃহীত হয় – সেই সময়কার অনেক জটিলতার তুলনায় এখন জটিলতা ততটা হবে না। বরং মানুষবাহী মঙ্গল মিশন চন্দ্রমিশনের তুলনায় সহজতরই হবে।''

নাদিরা মজুমদার: বিশ্লেষক, লেখক, সাংবাদিক।