রোজে আউসল্যান্ডার: কবিতাই ছিল যার মাতৃভূমি

junan_nishat
Published : 11 Jan 2016, 01:21 PM
Updated : 11 Jan 2016, 01:21 PM

রোজে আউসল্যান্ডার ইহুদি-জার্মান কবি। দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। মাতৃভূমি হারিয়েছেন বারবার। কিন্তু কবিতাকে হারাননি। কবিতাতেই গড়েছেন আপনভূমির মাতৃচিত্র। ভূ-রাজনীতির তীব্র শিকার হয়েছেন। তাই বলে লেখা ছাড়েননি কখনও। এক অদম্যতায় লেখা চালিয়ে গেছেন মৃত্যু পর্যন্ত।
ইউরোপের দক্ষিণ পূর্বে কার্পাথিয়ান পাহাড়ের কোলে বুকোহিনার চেরনোহিৎস শহরে ১৯০১ সালে ১১ মে তার জন্ম। শহরটি তৎকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরীর অংশ ছিল। আউসল্যান্ডরের মাতৃভাষা জার্মান। তবে ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা জার্মান, ইউক্রেনীয়, রোমানীয় ও পোলিশ ভাষাতেও কথা বলতেন। ফলে রোজে আউসল্যান্ডার শিশুকাল থেকে এসব ভাষা শুনতেন।
রোজের শৈশব সুখেই কাটছিল। কিন্তু শৈশবের এই সুখ রোজের জীবনে স্থায়ী হয়নি। তিনি আশ্রয়চ্যুত হন তার জন্মস্থান থেকে, তার সংস্কৃতি থেকে। একজন মানুষের আশ্রয়, সংস্কৃতি ও মর্যাদা যখন কেড়ে নেয়া হয়, তখন সেটি হয় তাকে হত্যারই নামান্তর। বিশেষ করে তিনি যদি হন সৃষ্টিশীল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে রোজের পরিবারকে পালাতে হয় প্রথমে হিনে, পরে বুদাপেস্টে। কিন্তু রোজের হৃদয়ে মাতৃভূমি কথা বলে অবিরত। তিনি কবিতা লেখেন। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেন কেন আমি লিখি? নিজেই জবাব দেন, তার কারণ সম্ভবত আমি চেরনোহিৎসে পৃথিবীর আলো দেখেছিলাম। এখানকার হাওয়ায় রূপকথা আর মিথ একাকার হয়ে ভাসতো। ওদের শ্বাস নেয়া যেত। এখানকার নিসর্গ অসাধারণ, মানুষগুলোও।
রোজের কাব্য রচনার সবকটি পবের্র প্রকৃতি ও নিসর্গ কবিতায় বুকোহিনা ও চেরনোহিৎস বিরাট জায়গা জুড়ে রয়েছে। বুকোহিনা শিরোনামেই রয়েছে চারটি কবিতা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় চেরনোহিৎস রুশরা দখল করে নিল। যুদ্ধ শেষে অস্ট্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এটি রুমানিয়ার সঙ্গে যুক্ত হলো। স্বভূমে ও সপরিবারে ফিরে এলেন রোজে। চেরনোহিৎস বিশ্ববিদ্যালয়ে রোজে সাহিত্য ও দর্শন পড়তে শুরু করলেন। বয়স ১৫ কি ১৬, দর্শনের প্রতি তার গভীর অনুরাগ জন্মেছিল। বহুদিন পর্যন্ত দার্শনিকরাই তার প্রিয় পাত্র ছিলেন।
১৯২১ সালে রোজের বাবা মারা যান। পরিবারে নেমে এলো আর্থিক দুর্দশা। বুকোহিনার অন্য ইহুহিদের মতো রোজে ও তার বন্ধু ইগনাৎস আমেরিকা চলে গেলেন। নিউইয়র্কে তাদের বিয়ে হলো। সাত বছর পর বিচ্ছেদও। নিউইয়র্কে কখনো পত্রিকায় কখনো ব্যাংকে বা কখনো ব্যবসায়িক কাজে রোজে তার জীবিকা নির্বাহ করেন। মাঝে মধ্যে তিনি ইংরেজি ভাষা শেখানোরও কাজ করেন।
রোজে আবারও ফিরলেন চেরনোহিৎসে। বুকোহিনার যে কবি টি এস এলিয়টের 'দ্যা ওয়েস্টল্যান্ড' জার্মান ভাষায় প্রথম অনুবাদ করেছিলেন তিনি আলফ্রেড মারগুল স্পেরবার। তিনি রোজের কবিতাগুলো নির্বাচন করে এক প্রকাশককে দিলেন। ১৯৩৯ এ প্রকাশিত হলো রোজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, The Rainbow (ইন্দ্রধনু)। তখন পূর্ব ইউরোপে ইহুহিদের অবস্থা ক্রমে দুঃসহ হয়ে উঠলো। অবিলম্বে রোজের বইয়ের সমস্ত কপি নষ্ট করা হলো। জার্মানিতে রোজকে ঘৃণা ও নিগ্রহের মুখোমুখি হতো হলো। তিনি আবারও আমেরিকায় চলে গেলেন। কিন্তু মায়ের অসুস্থতার কারণে রোজে চেরনোহিৎসে ফিরতে বাধ্য হলেন। তিনি কারখানায় কাজ নিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে অর্থাৎ ১৯৪১ এ রোমানিয়া নাৎসি জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত হলো। পরিণামে চেরনোহিৎস নাৎসিদের দখলে এলো। শুরু হলো রোমানিয়ায় ইহুহিদের ওপর নির্যাতন। রোজে ও তার মাকে ঘেটোয় প্রেরণ করা হলো। সেখানে এক বছরেরও বেশি আত্মগোপনে থাকতে হলো। মৃত্যুশিবিরে নিক্ষিপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা পেতে এক সেলার থেকে অন্য সেলারে ঘুরে ঘুরে লুকিয়ে থাকতে হতো তাদের।
রোজে সে সময়ের পরিস্থিতি বর্ণনা করেন এভাবে, 'অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঘেটোর মধ্যে এনে ফেলা হল। রাস্তায় বা অন্য জায়গায় যে কাজ করতে বাধ্য করা হতো তা ছিল ভীষণ কষ্টের। কুৎসিত অমানবিক আচরণ করা হতো। সারাক্ষণ মৃত্যুভয় প্রদর্শন করা হতো। এবং আমরা যখন মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকতাম, আমাদের মধ্যে অনেকে বাস করতো স্বপ্নশব্দপুঞ্জের ভেতর–নিরাশ্রয়তার মধ্যে আমাদের দুঃখের আশ্রয়। লেখা ছিল বাঁচা, টিকে থাকা।'

১৯৪৪-এর মার্চে সোভিয়েত সৈন্য ঘেটো থেকে কর্মক্ষম ইহুদিদের পাঠিয়ে দিলো রাশিয়ায়। উদ্দেশ্য ছিল এদের দিয়ে কাজ করানো। ইন্দ্রধনুর ইহুদি প্রকাশকেরও ঠিকানা হলো সাইবেরিয়া।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ষাট হাজার ইহুদির মধ্যে নাৎসি নিধনের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া ৫/৬ হাজারের একজন ছিলেন রোজে। যারা প্রাণে বেঁচে ফিরলেন তারা একটি সাহিত্যগোষ্ঠী গঠন করলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন রোজে, পাউল স্যালান, ইমানুয়েল হায়িন গ্লাস প্রমুখ।
এরপর বুকোহিনা ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত হলো । আর রোজে ১৯৪৬-এ নিউইয়র্ক পাড়ি দিলেন। পরের বছর তার মায়ের মৃত্যু ঘটলো। মায়ের মৃত্যুশোকে তিনি এতোই কাতর হয়ে পড়লেন, বেশকিছু সময় তিনি কাজে অক্ষম হয়ে পড়লেন।
নির্যাতিত, নির্বাসিত হয়ে এবং আদি মাতৃভূমি হারিয়ে রোজে আমেরিকায় বসবাস শুরু করেন। আমেরিকা তখন তার কাছে দ্বিতীয় দেশ। ১৯৪৬-৫৬ অবধি রোজে সেক্রেটারি এবং তারপর বিদেশী ভাষায় করেসপনডেন্ট হয়ে কাজ করতেন। সে সময়ে কবিতায় তার পরদেশবাসী হওয়ার অস্বস্তি টের পাওয়া যায়।
আমরা এলাম বাড়ি
গোলাপদের ছাড়া
ওরা রয়ে গেল বিদেশে
আমাদের বাগান পড়ে আছে
কবরখানায় চাপা।
কত কিছুর কত বদল হয়েছে
আমরা হয়েছি বালি পরদেশী চোখে

অথবা

আমি রাজা নো-ম্যান
আমার নো-ম্যান ল্যান্ডস বয়ে বেড়ায়
আমার ব্যাগে।

কিংবা

আমার ঘুমপাড়ানি গান মৃত
আমি ভাড়াটের ভাড়াটে
নরকে।

দেশান্তরে থেকে থেকে তিনি অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন। ভূমিহীনতা তাকে কষ্ট দিচ্ছিলো ভীষণ। এ অস্থিরতা থেকে মুক্তি পেতে ১৯৫৭ সালের মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করেন। ভ্রমণ করেন ফ্রান্স, ইতালি, গ্রীস, স্পেন, নরওয়ে, অস্টিয়া, সুইজারল্যান্ড।
১৯৬৫ সালে ভিয়েনায় রোজের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ Blind Summer(অন্ধগ্রীস্ম) প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি বলেন,
যাযাবর পাখি পায় না দক্ষিণ খুঁজে
এ এক অন্ধগ্রীষ্ম পৃথিবীতে।
উল্লেখ্য, প্রথম ও দ্বিতীয় বইয়ে কালগত ব্যবধান পুরো ২৫ বছর। অন্ধগ্রীষ্ম একটি তাৎপর্যপূর্ণ গ্রন্থ। কারণ এতে রয়েছে যুদ্ধপরবর্তী যুগ, নির্বাসনের অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন, ভ্রমণস্মৃতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো রোজে ফিরে আসেন জার্মানিতে। তার প্রিয় হাইনরিশ হাইনের শহর ডুসেলডর্ফে। এখানে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো পাউল সেলানের সান্নিধ্য পান। এর আগে ঘেটোতে তাদের সাক্ষাত ঘটে।
জার্মানিতে রোজের এই ফিরে আসা ছিল মাতৃভাষাতেও ফিরে আসা। জার্মান কবিতায় ফিরে আসা। ১৯৬৫ থেকে কয়েক বছর একটি বোর্ডিং হাউজে থাকার পর ইহুদি সম্প্রদায়ের নেলি সাখস হাউজে এলেন ১৯৭০-এ। এখানে তিনি সব সময়ের জন্য থাকতে না চাইলেও এক দুর্ঘটনার জন্য থেকে যেতে বাধ্য হন। এই হাউজই ছিল তার শেষ আস্তানা। এখানেই তিনি অজস্র কবিতা লেখেন। ফলে প্রতি বছরই প্রকাশিত হতে থাকলো তার বই। কখনো কখনো একের অধিক বই তিনি প্রকাশ করেন।
রোজের কবিতা সরল, অকৃত্রিম, অকপট। সরলতা তার কবিতার মূল সুর। অন্তমিল যতিচিহ্ন প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে তার কবিতায় বহুল ব্যাখ্যার সম্ভাবনা তৈরি হয়। জার্মান ভাষাভাষী কবিতায় এ ধরনের রচনারীতির প্রবর্তন অনেকখানি তারই অবদান। তার কবিতার এ বাঁক বদল ঘটে ৫০'র দশকে। তখন থেকে রোজের কবিতা থেকে ছান্দসিক ভাব লুপ্ত হয়, তিনি প্রচলিত শব্দ ব্যবহার ছেড়ে ঋজু ও সংক্ষিপ্ত শৈলীকথনকে বেছে নেন। ১৯৭০ থেকে ৮০'র দশকে তিনি সবচেয়ে বেশি লেখালেখির কাজ করেন। জীবদ্দশায় তার প্রায় ২৪শ কবিতা প্রকাশিত হয়। লেখেন প্রায় তিন হাজারের মতো কবিতা।
হেলমুট ব্রাউনের সম্পাদনায় আট ভলিউমে তার সাহিত্য সমগ্র প্রকাশিত হয়। এসব সমগ্রে কবিতার পাশাপাশি তার গদ্য ও চিঠিগুলোও স্থান পায়। রোজের কবিতা ইংরেজীসহ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়। তিনি ইংরেজীতেও কাব্যচর্চা করেন এবং জার্মান ভাষায় ইংরেজী কবিতা অনুবাদ করেন।
একজন কবির জীবন যতই ক্ষত-বিক্ষত, নিষ্ঠুর ও লাঞ্ছনার আক্রমণে বিধ্বস্ত হোক তার ভেতর ভাষা নিরন্তর প্রবহমান। কারণ ভাষা এক অমোঘ উত্তরাধিকার। রোজে আউসল্যান্ডার বার বার মাতৃভূমি হারিয়েছেন। ব্যক্তি জীবন ধ্বস্ত হয়েছে বাস্তবতার নিপীড়নে। আশ্রয়চ্যুত থেকেছেন বছরের পর বছর। যখন যেখানে গেছেন থেকেছেন ঘরহীন। সামগ্রিক এক উন্মূল জীবন ছিল তার। কিন্তু তার যে লিরিক্যাল ভাষা তা তাকে ছেড়ে যায়নি কখনোই। লেখালেখি বন্ধ করেননি শত প্রতিকূলতাতেও। ১৯৮১ সালে তার কাব্যগ্রন্থ My Breath is called Now এবং পরের বছরMy Venice Does Not Sink এবং সর্বশেষ ১৯৮৭ সালে I am still Playing প্রকাশিত হল। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৮৮ সালে ৩রা জানুয়ারি রোজে আউসল্যান্ডার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তত বেশি

কে পারে
তত বেশি বলতে
যেমন সে চায়

কে চায় তত বেশি
যেমন সে ভাবে

কে ভাবে ততখানি
যেমন সে বাঁচে

কে বাঁচে তত নিশ্চয়
যেমন সে মরে

কুয়ো

ভস্মীভূত উঠোনের মধ্যে
দাঁড়িয়ে আছে এখনও কুয়োটি
অশ্রুতে ভর্তি

কে ফেলেছিল এদের

কে পান করবে
তার তেষ্টার শেষ অবধি

আমার শ্বাস

আমার গভীর স্বপ্নরাশির ভেতরে
কাঁদে পৃথিবী
রক্ত

নক্ষত্রেরা মৃুদু হাসে
আমার চোখে
যখন মানুষ আসে
বহুরঙা প্রশ্নমালা নিয়ে
আমি উত্তর দিই
তোমরা যাও সোক্রাতেসের কাছে

অতীত
আমাকে রুদ্ধ করেছে
আমি পেয়েছি
উত্তরাধিকার ভবিষ্যতের

আমার শ্বাসের নাম
এখন

নখচাঁদ অবধি

নখচাঁদ অবধি
আমি তোমার কথা ভাবি
যখন রাত্রি আমাকে নেয়

ওরা তোমাকে কবর দিয়েছে
আগুনে

আমি ধরে আছি তোমার ভস্মের ভাবনা
রক্তপাত্রে
যা অবিশ্রাম হৃদয়ের দিকে ছোটায়
তোমার নাম

কী সুন্দর
ফুটতে পারে ভস্ম
রক্তে

(লেখায় ব্যবহৃত কবিতাংশ এবং উপরের কবিতাগুলো মূল জার্মান থেকে অনুবাদ করেছেন একলা দোসর।