মৃত্তিকা গুণের পাঁচটি কবিতা

mrittika_goon
Published : 16 Feb 2016, 01:28 PM
Updated : 16 Feb 2016, 01:28 PM

নাম

যদি তোমার নাম না লিখি আর, কি হবে?

লক্ষ, কোটি শব্দের ভীড়ে হারিয়ে যায়
তোমার ভালোবাসার ডাক।
ঘন হয়ে ওঠা অজানা আবেগের
মেঘগুলো যদি ভেসে যায়?
ভেসে ভেসে জমা হয় পাহাড় চূড়ায়
তারপর ঝড়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে।
তবু আমি তাতে না ভেজাই হাত

তবে কি হবে!

উৎকন্ঠিত রাত না জেগে
যদি সারাদিন ঘুমাই আবেশে।
ভোরের সূর্যের মত অবহেলা করে
একপাশে রাখি তোমাকে।
বিরামহীন বিশ্রামে কাটাই প্রহর?
যদি না-ই দেই জমাট প্রতীক্ষার
কোন সদুত্তর তবে?

তোমার চোখের নরম ছায়ায় যদি না পাতি হৃদয়,
অভিলাসী দুঃখ বুকে নিয়ে,
বিরহী নিশির ডাকে সব ছেড়ে যেতে চাই।
ক্লান্ত পায়ে, একা হেঁটে যেতে চাই –

তবে?
কার কি হবে?

রক্তিম প্রসূন

তখন আশ্রয় পায় দিকহীন আমার যৌবন
অধরা যখন তুমি,
রক্তিম প্রসূন ঠিকরে শুভ্রতা ছড়াও বাতাসে।
শিমুল তুলোর মত ভেসে এসে তোমার হাসির ছন্দ
ছেয়ে ফেলে আমার আকাশ।

শ্বেত চন্দনের মত সুগন্ধ ছড়াও বাতাসে।
অথচ আমার হাতে চর্চিত গোলাপ বাগান।

আগুন স্পর্শ করে কেঁপে উঠি
চারদিকে মহুয়ার ঢল।
মাতাল এমন করো নেচে ওঠে আমার যৌবন।

শব যাত্রী

ব্যস্ততা শেষ করে সবাই মারা যায়।
কেউ আর কাউকে চেনে না।

তবু সদ্যফোঁটা মৃত মুখ হয়ে ওঠে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।

মরহুমের ছেলে মেয়েরা মুগ্ধ হয় জেনে
মৃত মানুষটারও একটা জীবন ছিলো ।
হাতের কড়া গুনে বলার মত কিছু ভালো কাজ ছিলো।
চড়ুইপাখির মত হারিয়ে যাওয়া আবার চকিতে দৃশ্যমান হয়ে
ওঠা কিছু ব্যক্তিগত চাওয়া ছিলো।
দেশের উন্নতি নিয়ে করা কিছু সুচিন্তিত মতামতও
লেখা ছিলো গোপন ডায়রিটাতে।
আরও ছিলো বুকের পাঁজরে লুকিয়ে রাখা
রেবু খালাকে নিয়ে লেখা কবিতার লাইন. . .।

জীবিত অবস্থায় কেউ কোন খোঁজই নিতে যায়নি যেসবের।
দোষারোপ আর প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারার অপবাদ মাথায় নিয়ে
সরাসরি তাকাতে পারেনি যে স্ত্রী সন্তানের চোখে।

চিনতে না পারার অপরাধে আজ তারাও নুয়ে পরে কিছুটা।

মৃত দেহের কোন শক্তি নেই, রহস্য নেই, অভিযাগ নেই
তাকে চেনার চেষ্টা না করাই ভাল।

ইতিহাসের মানুষ

বিরামহীন পথে একটি গাছের নীচে
বসে কুড়িয়েছি ফুলের গন্ধ।
সেখানে কোনো মানুষ যায়নি।

কোনো জনপদের ঐতিহাসিক গল্প ছিলো না সে গাছের রেখায়।
যদিও জীর্ণ বাকলে বাকলে হাজারও ক্ষতের আভাস।
বলীরেখা এঁকেছে সময় তাতে।
শতায়ু বুড়ো সাক্ষীর কপালের মতই
গভীর জটিল মায়া এই রেখার।
এর টানে বিবাদিনী আমি, গৃহহীন আজ।

কালের ইতিবৃত্তে নিজেকে শুদ্ধ প্রমাণে যতদূর
পালিয়েছি – ফের এসে দাঁড়িয়েছি নরকের দরজায়।
মানুষ বর রক্তাক্ত, প্রাচীন।
ভাগ্যতাড়িত মন তার।
মৃত্যু -আতঙ্কে ভীত হৃদয়।
পৃথিবী জড়িত চিরকাল।
শুধু যে গাছের নীচে কুড়িয়েছি ফুলের গন্ধ।
পবিত্রতা রক্ষা হয়েছে তার।

সেখানে কোনো মানুষ যায়নি।

কল্পনায় পাওয়া গাছটি আমি বাস্তবে পাইনি।
যে গাছের তলে গন্ধ কুড়িয়ে শুদ্ধ হওয়া যায়।
মানবজন্ম বহন করে নিয়ে যায় দুঃসহ বিষাক্ত রক্তের ধারা।
গাছের কোনো পাপ নেই; নীরবে সাক্ষ্য হওয়া ছাড়া।

যাপিত জীবন

বোকা মেয়ে, তুই জীবনটা গোছাতে পারলি না!
পারলাম না। চেষ্টা করেছি।

সত্যি সত্যি সত্যি
তিন সত্যি।

খুব নিষ্ঠার সাথেই চেষ্টা করেছি।
ভালো মেয়ে হয়ে চেষ্টা করেছি।
সৎ থেকে, ধৈর্য ধরে, ভালোবেসে. . .।
যা খাইনা তাও রান্না করেছি। অসুখে সেবা করেছি।
সলজ্জ হেসেছি অর্থহীন, নিম্নগামী রসিকতায়।
মতপার্থক্য সত্ত্বেও উচ্চগ্রামে উঠাইনি কণ্ঠ ।
অন্যের মাকে মা ডেকেছি; বাবাকে বাবা।
নিস্তনী বোনের গর্বে গর্বিত হয়েছি।
মধু মাখিয়ে মাখিয়ে থামিয়েছি পারিবারিক খেদ।
কত রাত বিনিদ্র জেগেছি।
কত বেলা না খেয়ে থেকেছি।
সৌন্দর্যের পারদ নামতে দেইনি নিচের কাঁটায়।
শতকরা বেশিরভাগের যাপিত জীবনের প্রতিরূপ হতে চেষ্টা চালিয়েছি।
মাটি স্পর্শ করে, আকাশ স্পর্শ করে, কতদিন লিখিনি কবিতা
তোমাদের তুষ্টিলাভের আশায়।
কত কতবার ভেঙেছি স্বরূপ আমার।

সত্যি সত্যি সত্যি
তিন সত্যি।

এতো করেও জীবন গোছাতে পারিনি!