সংখ্যাবহুল মৃত্যু ও আমাদের পচে যাওয়া মানসিকতা

কাফি রশিদ
Published : 25 Nov 2012, 08:09 AM
Updated : 25 Nov 2012, 08:09 AM

গত চব্বিশ ঘন্টায় দুটি দূর্ঘটনায় মৃতের "সংখ্যা" ১৫০ ছাড়ালো। একটি হলো চট্টগ্রামে নির্মাণাধীন একটি ফ্লাইওভারের অংশবিশেষ ভেঙে যাওয়া – মৃতের "সংখ্যা" প্রায় ৪০, বেশিরভাগই ফ্লাইওভারের নিচে বসা কাঁচা বাজারের বিক্রেতা ও পথচারী। অন্যটি হলো আশুলিয়ায় একটি গার্মেন্টস ভবনে আগুন লাগা – মৃতের "সংখ্যা" প্রায় ১১০, যারা মারা গিয়েছে তারা প্রায় সবাই-ই পাঁচ হাজারী বেতনের গার্মেন্টস কর্মী।

এমন "সংখ্যা-বহুল" মৃতের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয়। প্রতি ঈদের ছুটিতেই তারা মারা যাচ্ছে পানিতে ডুবে, সড়কে থেঁতলে, একশ-দুইশ-তিনশজন করে। আরো একশ-দুইশ-তিনশ জন করে মারা যাচ্ছে বদ্ধ গার্মেন্টস ভবনে আগুনে পুড়ে। মাঝে মাঝে যখন কেউই মারা যাচ্ছে না, তখন অল্প কয়েকজন, মাত্র ৫০-৬০ জন বাচ্চা খেলতে গিয়ে সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে মৃতের পরিসংখ্যান টিকিয়ে রাখতে। এই পরিসংখ্যান আমাদের অনেক কাজে আসে, ইস্কুলে যখন বাঙলা-ইংরেজিতে সড়ক দূর্ঘটনা নিয়ে রচনা লিখি, সংবাদপত্রে যখন দূর্ঘটনা-উৎসব-দিবসে বিশেষ সংখ্যা বেরোয়, বড়ো বড়ো ব্যক্তিরা যখন টিভি'র টক-শো তে আসেন, তখন এইসব পরিসংখ্যান আমাদের কাজে লাগে, আমরা এগুলো মুখস্ত করে রাখি। যে যতো পরিসংখ্যান লিখতে পারবে, সে ততো নাম্বার পাবে; যে যতো বেশি পরসিংখ্যান বলতে পারবে, সে দেশ সম্পর্কে ততো বেশি সচেতন; যে পত্রিকা এসব পরিসংখ্যান নিয়ে বছরে একবার চার-রঙা-সচিত্র-প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারবে, সে পত্রিকা ততো বেশি হিট।

রাতের খাবার খেয়েই শুনলাম চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভার ভেঙে প্রায় বিশজন মারা গিয়েছে, মৃতের সংখ্যা চল্লিশ-পঞ্চাশ ছাড়িয়ে যাবে। ভেবেছিলাম এরা সব নির্মাণশ্রমিক। আরেকটু খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আসলে সম্পূর্ন ফ্লাইওভার না, ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ভেঙে এর নিচে বসা কাঁচা বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতা ও সাধারণ পথচারীর উপর পরেছে। গার্ডারগুলো কত বড়ো হতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা ছিলো, এইতো কিছুদিন আগেই একটি ভেঙে পরে পরিসংখ্যান বাড়ানোর চেষ্টা করেছিলো। ১৫০ মিটার লম্বা কংক্রিট নির্মিত গার্ডারগুলোর ওজন কতো হতে পারে সেটা সম্ভবত নির্মাণকারী সংস্থার কর্মকর্তারাও জানেন না। এর চার ভাগের একভাগও যদি ভেঙে পরে, তাহলেও বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এত বড়ো বড়ো গার্ডারগুলো কীভাবে ভেঙে পরলো? সেগুলো কোনরকম সাপোর্ট ছাড়াই পিলারের উপর বসানো ছিলো। ভারী গার্ডারগুলো এমনি এমনি পরে যাওয়ার কথা না, যদি না সেখানে কাজ চলতে থাকে। ধরে নেয়া যায় তিনটি গার্ডের শেষ প্রান্তে তখনো কাজ চলছিলো। তাহলে সেগুলোর নিচে কাঁচা বাজার বসে কেমন করে? তার নিচ দিয়ে পথচারী পারাপার হয় কেমন করে? আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, নির্মাণ সংক্রান্ত কোন আইন যদি থাকে, তাহলে সেখানে স্পষ্ট করে লিখা আছে নির্মানাধীন কোন স্থাপনার নিচে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান তো দূরে থাক, সেখান দিয়ে চলাফেরাও করা যাবে না। অবশ্যই সেখানে সিকিউরিটি গার্ড সহ বাউন্ডারীর ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রশ্ন হলো সেই ফ্লাইওভারের নিচে বাউন্ডারী কোথায়? সেখানকার দায়িত্বে নিয়োজিত সিকিউরিটি গার্ড কোথায়? স্থানীয় প্রশাসন সেখানে কাঁচা বাজার বসার অনুমতি কী করে দিলো? বিনা-অনুমতিতে বসে থাকলে তাদের উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি ক্যানো? কারণটা মোটামুটি আন্দাজ করা যায়, যে প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণের সাথে যুক্ত সেটি সরকার দলীয় এক নেতা'র, তার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এই ধরনের বৃহৎ স্থাপনা নির্মাণের। দূর্নিতির জন্য টেন্ডারে অংশ নিয়ে স্থাপনার দায়িত্ব নেয়া হয়েছে, দূর্নীতি তো থাকবেই। সম্ভবত টাকা বাঁচাতেই তারা বাউন্ডারি-সিকিউরিটি গার্ডের ব্যবস্থা করেনি। স্থানীয় প্রশাসনেরই বা কী দায়িত্ব বাজার উচ্ছেদের? এই বিপর্যয়ের দায়ভার শুধু তাদেরই না, এর দায়ভার ভিকটিমদের উপরেও বর্তায়। তাদের দোষ সচেতনতার অভাব। এইতো কিছুদিন আগে একটি গার্ডার ভেঙে পরলো, তারপরেও ক্যানো সেখানে বসে-দাড়িয়ে-শুয়ে থাকতে হবে?

গার্মেন্টসে আগুন লাগার ঘটনা আমরা অনেক দেখেছি, শুনেছি। সড়ক দূর্ঘটনা কিংবা লঞ্চডুবিতে আমাদের টনক যতটুকু নড়ে, চার-অংকের বেতনধারীদের তিন-অংকের মৃত্যু সংখ্যায় আমাদের টনক ততটুকুও নড়ে না। কারণ তারা যে গার্মেন্টস কর্মী! আমাদের মনোভাব এমন যে, আমরা যেসব বড়ো বড়ো ব্র্যান্ডের জামা-কাপড় পড়ি, ইয়েলো, ক্যাটস-আই, এক্সট্যসি, লা রিভি, সেগুলো তো আকাশ থেকে আসে, আর গার্মেন্টস কর্মীরা যা বানায় তা তারা নিজেরা পড়ে। গার্মেন্টস কর্মী সম্পর্কে আমাদের মনোভাবের কথা না-ই বা বললাম। গার্মেন্টস ভবনে আগুন লাগলে যে ব্যাপারটা ঘটে তা মোটামুটি একইরকমের। আতঙ্কে সবাই দৌড়াদৌড়ি করে ছোট্ট দরজা দিয়ে বের হওয়ার, যখন কেউ পরে যায় তাকে মাড়িয়েই বের হওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে। অনেকবার দ্যাখা গেছে আগুন না লাগলেও গুজবের কারণে কয়েকজন মারা পরছে পদদলিত হয়ে। ভবনগুলোও অতিরিক্ত মাত্রায় সুরক্ষিত, য্যানো একেকটি ভবন একেকটি দুর্ধর্ষ খুনিদের জেলখানা। সারাদিন চেষ্টা করেও এসব ভবনের জানালা ভাঙা সম্ভব না। প্রতিটা জানালা আবার কাঁচ দিয়ে আটকানো। অল্প একটু আগুন লাগলেও বিশুদ্ধ বায়ু-স্বল্পতায় মারা যাওয়া সম্ভব।

আমি জানিনা দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের উত্তর দেয়ার মতোন কিছু আছে কিনা, তবে ধারণা করছি তারা এমন উত্তর দিবে য্যানো আমরা দ্বিধায় পরে যাবো আসলেই এসব অতি সাধারণ ঘটনা। ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে গেলে এমন সংখ্যাবহুল মৃত্যুর ঘটনা ঘটতেই পারে, তিন অংকের পরিসংখ্যান গার্মেন্টস ভবন থেকে আমরা পেতেই পারি! আমরা সবসময় এমন ঘটনার পর চুপচাপ বসে থাকবো, কারণ যে ভবনটা পুড়লো সেটা কোন ধর্মীয় উপাসনালয় না, যে স্থাপনাটা ভেঙে পরলো সেটা উগ্রপন্থীদের ভেঙে ফেলা কোন স্থাপনা না, যে মানুষগুলো মারা গ্যালো তারা বাংলাদেশি; আমেরিকান কিংবা ফিলিস্তিনি কিংবা বার্মিজ না। এখানে আমাদের কোন ধর্মানুভূতি-মানবতা দ্যাখানোর কোন সুযোগ নাই। কোন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল প্রতিবাদ করবেনা এতগুলো মানুষ একটি ভবনে পুড়ে মরে যাওয়ায়, কোন রাজনৈতিক দল প্রতিবাদ করবেনা ভেঙে পরা স্থাপনাটার পেছনের দূর্নীতির জন্য, কোন মানবতাবাদী সংস্থা সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কোন উদ্যোগ নিবে না। এগুলোতে নিছক দূর্ঘটনা, এখানে কোন ইস্যু নাই।