আমার আইভী চাচি

শেখ রেহানা
Published : 23 August 2010, 01:46 PM
Updated : 23 August 2010, 01:46 PM

২১ আগস্ট আমাদের কাছে আরও একটি ভয়াবহ দিন। বিকালে আওয়ামী লীগের জনসভা শেষে বিক্ষোভ মিছিল শুরুর আগে হঠাৎ করে গ্রেনেড হামলা এবং গুলিবর্ষণ করা হয়। ঘাতকদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, শেখ হাসিনাকে হত্যা করা।

১৫ আগস্টের শোক বুকে নিয়ে আমরা দেশের মানুষের ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছি। তারপর আবার এই আঘাত কেন? কেন এই রক্তাক্ত সংঘর্ষময় হামলা? আইভী রহমানসহ ২৪ জনকে প্রাণ দিতে হল। অসংখ্য আহত হয়েছে। কেউ কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন সারাজীবনের জন্য। শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে বেঁচে আছেন এখনও অনেকে।

এই হামলার যারা পরিকল্পনা করেছে তারা বাংলার মানুষের শত্রু। তারা শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারেনি। তারা আবার একটি ১৫ আগস্ট ঘটাতে চেয়েছিল। তাদের মধ্যে মানবতার প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ পর্যন্ত নেই। রাজনীতিকে তারা অস্ত্র ও শক্তি দ্বারা দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে। কেননা রাজনীতির মূল্যবোধ তাদের কাছে প্রতিহিংসাপরায়ণতা হিসেবে বিবেচিত।

২১ আগস্ট আমার কাছে এক অভিশপ্ত দিন। ১৫ আগস্ট সবাইকে হারিয়ে আমরা দুবোন বেঁচে আছি। সেদিন যদি আমার হাসু আপার কিছু হয়ে যেত আমি সে শোক কেমন করে সামলাতাম, ভাবতে আজও দিশাহারা হয়ে যাই।

কিন্তু তারপরও আমার প্রিয় আইভী চাচিকে হারিয়েছি। দেখতেও সুন্দর ছিলেন, মনটাও সুন্দর ছিল। আবার রুচিবোধেও ছিলেন উন্নত। কে কী বলল বা ভাবল এসব নিয়ে ভাবতেন না। নিজে যেটা ভালো মনে করতেন, সেটাই করতেন গভীর আগ্রহের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে ছিল তাঁর পারিবারিক সম্পর্ক। আব্বা তাদের বিয়ের উকিল বাবা ছিলেন। মায়ের খুব স্নেহের পাত্রী ছিলেন তিনি। মায়ের কাছে শুনেছি, খুব ছোটবেলায় আমাকে তাঁর কাছ থেকে কেউ সরাতে পারত না। আমি তাঁকে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতাম। এমনই ছিল তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক।

তাঁর তিন ছেলেমেয়ে, পাপন, তানিয়া ও ময়নার সঙ্গে আমিও ছিলাম সন্তানের মতো। আমাকে কখনও আলাদা করে ভাবতেন না। আমি তাদের কাছে এখনও বড় বোন। ভালো কিছু চোখে পড়লে চাচি আমার জন্য কিনতে ভুল করতেন না। এমনকি তাঁর সম্পত্তি থেকেও আমাকে ভাগ দিতে চেয়েছেন। এমন ভালোবাসার মানুষ কেউ কখনও পায়? আমি তো পেয়েছিলাম, এটাই আমার কাছে বড় গর্বের বিষয়।

নেতা হিসেবে জিল্লুর কাকা ও আইভী চাচি তাদের ব্যবহার, সহমর্মিতা ও কর্মকাণ্ডের জন্য নেতাকর্মীদের কাছে শ্রদ্ধা ও সম্মান পেয়েছেন, এটাই হল বড় কথা। আজ যখন বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে যাই, আমার সেই প্রিয় আইভী চাচিকে দেখি না। সব কিছু মনে হয় ঠিকঠাক আছে, সব ফুল আছে। শুধু আমার আইভী লতা নেই। এ দুঃখ আমাকে কষ্ট দেয়। তিনি বেঁচে থাকলে আজ বঙ্গভবনে একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতেন যেখানে সবাই গিয়ে সবার সঙ্গে মিলতে পারত, সমৃদ্ধ হত।

কত কথা মনে পড়ে যায়। একবার তাঁর সঙ্গে বাজি ধরে আমি জিতে চাই। শর্ত অনুযায়ী তিনি আমাকে ও রাসেলকে চায়নিজ খাওয়ালেন। এদিকে দেরি করে ঘরে ফেরাতে মা আমাদের খোঁজ করলেন। আইভী চাচিকে আমাদের আগে ঘরে ঢুকতে দেখে মা আমাদের আর বকাঝকা করলেন না।

আর একবার একটি অনুষ্ঠানে আমরা দুজন বসে আছি। হঠাৎ কী কথায় চাচি খুব হাসতে থাকলেন। হাসি যেন থামতেই চায় না আমাদের আব্বা মঞ্চে বসে আমাদের দেখে ফেলেন। অনুষ্ঠান শেষে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, ''তোমরা দুজনে কী নিয়ে এত হাসাহাসি করলে?"

সামান্য কথাতেই চাচি খুব হাসতে পারতেন। খুব সৌখিন ও আমুদে মানুষ ছিলেন বলেই এটা সম্ভব ছিল।

২০০৪ সালের ৮ আগস্ট মায়ের জন্মবার্ষিকীর দিনে তিনি আমাকে খুব আদর করে বললেন, "কী রে, তুই এবার এসে আমার খোঁজ নিলি না। দেখবি আমি খুব শিঘ্রি মরে যাব, তখন তুই সবচেয়ে বেশি কাঁদবি!"

এ কথা তিনি কেন আমায় সেদিন বলেছিলেন, আমি জানি না। ১৫ আগস্ট শোক দিবসের মিলাদের পরও তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে।

মনে পড়ে ১৯৭৪ সালে মস্কোতে যখন আব্বার সঙ্গে তাঁর চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম, তখনও তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। জিল্লুর কাকার চিকিৎসার জন্য তিনি সঙ্গে গিয়েছিলেন। ডাক্তাররা যখন তাঁরও চেকআপ করে গলার টনসিলের অপারেশন করে দেয় তিনি খুব ভয় পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ''কী ব্যথা করে!''

অথচ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তাঁর দুই পা ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হয়ে যায়। তিনি উঠে বসেছেন, কথাও বলেছেন। একটু ব্যথা পেলে খুব  কষ্ট পেতেন। অথচ সেদিন তিনি এত বড় আঘাত কী করে সহ্য করলেন! নিজের সেই রক্তাক্ত শরীর দেখে কী মনে হয়েছিল তাঁর তখন!

জানি না। জানাও যাবে না। তিনি তো আর নেই। শুধু তাঁর সেই সজীব মুখখানা তেমনি ছিল। মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে ২৪ আগস্ট তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আগস্ট মাস এলেই আমাদের শোকটার সঙ্গে জিল্লুর কাকার শোক উপলব্ধি করতে পারি। পাপন, তানিয়া ও ময়নাকে বড়বোন হিসেবে সান্তনা দিতে হয় আমাকেই। ওদের কষ্টের সঙ্গে নিজের সব হারানোর বেদনাও আজ আমি একাত্ম করে নিয়েছি।

আইভী চাচি আমার বন্ধু ছিলেন, সহমর্মী ছিলেন। তাঁর কাছে সব কথা বলা যেত। সব দুঃখ শোনাতে পারতাম। আমার এই প্রিয় মানুষটির প্রতি জানাই আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। মধুর চেয়েও মধুরতম হয়ে থাকবে তাঁর স্মৃতি। দুঃখ ও দুঃসময়ে তিনি ছিলেন আমার কাছে মায়ের মতন।

এ কথা যতদিন বাঁচব নিশ্চয়ই মনে থাকবে আমার।