লেখকের প্রয়াণ: শহীদুল জহির ও আমাদের কথাশিল্পের ভুবন

অদিতি ফাল্গুনী
Published : 27 March 2008, 08:08 PM
Updated : 27 March 2008, 08:08 PM


গত ২৪ শে মার্চ ২০০৮ তারিখে কথাশিল্পী শহীদুল জহিরের আকস্মিক মৃত্যুর প্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক শোকবিহ্বলতা থেকে আর্টস ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর জন্য একটি লেখা প্রস্তুত করেছিলাম যা ২৫শে মার্চ বিকেলে প্রকাশিত হয়। গত দু'দিনে শহীদুল জহিরের প্রকাশিত কিছু বই হতে উদ্ধৃতি, ক্ষেত্রবিশেষে ছোট-খাট তথ্য সংশোধন ও পরিমার্জনার পর লেখাটি ঈষৎ পরিবর্ধিত আকারে নিবেদিত হলো।

……
শহীদুল জহির (১৯৫৩-২০০৮)
……
এবারো চৈত্র-বৈশাখ- জৈষ্ঠ্যে দক্ষিণ মৈশুন্দি, নারিন্দা, বনগ্রাম, ওয়ারি, র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিট, জোড়পুল, ভূতের গলি কি পদ্মনিধি লেনে গরম পড়লে মহল্লায় মহল্লায় তরমুজ বিক্রি হবে। সবুজ রঙা তরমুজের রক্তলাল কাটা ফালির অবিশ্বাস্য বর্ণিল পৃথিবীর ঘুলঘুলাইয়া কি গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাবে মহল্লার মানুষ। মহল্লার কোনো কোনো তরুণ শেফালী নামের কোনো তরুণীকে দেখে ডাক দেবে: 'এই শেপালী ফুল গাছ!' তখন মহল্লার মেয়ে ঝর্ণা বসাক একদিন সিনেমার দামি নায়িকা শবনম হয়ে যাবে, চান্দা তালাশ ছায়াছবিতে তাকে দেখা যাবে আর হাজি ফুড প্রোডাক্টসের মালিক বৃদ্ধ হাজি আব্দুর রশিদ সাহেবের মৃত্যুশয্যায় যখন ইচ্ছা হবে তরমুজ খাবার কিন্তু তখন তরমুজ খাবার সময় নয় বলে পাঁচবার তরমুজ চাওয়ার পরও তিনি তরমুজ পাবেন না, তিনি তখন সঙ্কটের গভীরতা উপলব্ধি করতে পারেন এবং বড় ছেলেকে একটা তরমুজের ফ্যাক্টরি বসাতে বলেন, হাজি সাহেবের ছেলে মহল্লার দক্ষিণ প্রান্তে পড়ে থাকা এক টুকরো খালি জমি কিনে ফেলে এবং হাজি ফুড কোম্পানির ফ্যাক্টরি তৈরির কাজ শুরু হয়…আর এভাবেই লেখা হয় আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস। মার্কেজের লিফ স্টর্ম বা পাতাঝড় উপন্যাসের কথা আমাদের মনে পড়ে যেতে পারে। মনে পড়ে যেতে পারে কলাম্বিয়ার আরাকাতাকায় ইউনাইটেড ফ্রুটস কোম্পানির শিল্পায়নের ইতিহাস। জহির তবু জহিরই। আমাদের গরম আর আমাদের তরমুজ তার মতো করে কে আর লিখেছেন? আজো মনে আছে ১৯৯৫ সালের এক মে দুপুর। ১৯৯২-এ নন হজক্যান্স লিম্ফোমা ক্যান্সারের চিকিৎসায় আট কোর্স কিমোথেরাপি নেবার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াবশতঃ ১৯৯৫-এ দু'পায়ে দুটো অপারেশনের পর সম্পূর্ণ শয্যাবন্দি অবস্থায় একদিন শুয়ে শুয়ে পড়ছিলাম মারুফ রায়হান সম্পাদিত মাটি সাহিত্য পত্রিকা। সেখানেই প্রথম শহীদুল জহিরকে পাওয়া গেল। তার তরমুজ খাবার ও খাওয়াবার গল্প। যেন আশ্চর্য এক যাদুকর একটি গোটা বাক্যে গোটা গল্প বা একটি জাতির গোটা কুটিরশিল্পের ইতিবৃত্ত লিখবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় দাড়ি বা পূর্ণ যতিচিহ্নবিহীন এবং শুধুমাত্র কমা ও সেলিকোলন নির্ভর আশ্চর্য ধূলিঝড়ের উদ্ভাসে মুছে দিল পাঠক 'আমি'র অসুস্থতা-ক্লান্তি-খিন্নতা! মাত্র একটি বাক্যে মুদ্রিত আঠারো পৃষ্ঠার একটি গোটা গল্প শেষ শব্দে এসেও দাড়ি বা পূর্ণ যতিচিহ্ন দেয় না। গল্পটি শেষ হয় একটি কমাতে। এই গল্পে শুধু তরমুজ নয়, আছে মহল্লার লেদ মেশিন কারখানা, মহল্লায় দিনে দেড়মণ নাটবল্টু, দশমণ পাউরুটি/বিস্কুট/লেবেঞ্চুশ, সাত গ্রোস কাচের গ্লাস বানানোর বিবরণ, আছে হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির কথা, 'শেফালি ফুল গাছ,' ঝর্ণা বসাক ও তার পিতা ননী বসাক, মহল্লার একমাত্র কবি ও অন্তিমে পাবনার পাগলাগারদে প্রেরিত আজিজুল হক, অসুস্থ কিশোরী পুতুল এবং হাজি আব্দুর রশিদ কর্তৃক নিঃসন্তান বিধবা রহিমা বিবির দেড়কাঠা জমি গ্রহণ সহ নানা অনুষঙ্গ। কিšত্ত, গল্পের এসব অনুষঙ্গের চেয়ে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় গল্পের গল্পহীনতা ও অদ্ভুত এক ভাষার ঘূর্ণি। সামান্য উদ্ধৃত করি: 'আমাদের মহল্লা, দক্ষিণ মৈশুন্দির শিল্পায়নের ইতিহাস আমাদের মনে পড়ে; মহল্লায় গরম পড়তে শুরু করলে চৈত্র, বৈশাখ অথবা জ্যৈষ্ঠ মাসে তরমুজওয়ালারা তরমুজ নিয়ে আসে এবং আমরা তরমুজ খেতে শুরু করি, আমরা তখন তরমুজ সম্পর্কে সচেতন হই; আমরা লক্ষ করি যে, এই তরমুজওয়ালারা মহল্লার গলির সংকীর্ণ একটি জায়গায় মাটিতে দেয়ালের পাশ ঘেঁষে, গোল গোল তরমুজের ছোট ছোট ঢিবি বানিয়ে বসে, তারা এই জায়গায় কেন বসে আমরা বুঝতে পারি না, ফলে এই জায়গায় এসে রিকশা, ঠেলাগাড়ি, গরুর গাড়ি, বেবিটেক্সি, কুকুর, বেড়াল, ছাগল এবং মানুষ একটি জট পাকিয়ে ফেলে; দক্ষিণ মৈশুন্দিতে মাছি বেড়ে যায়, আমাদের নাকের উপর সেগুলো এসে বসে, নীল মোটা মাছি এবং কালো সরু মাছি, ফলে আমরা বিরক্ত হই; আমরা তাদেরকে বলি, তুমরা এই মাছির দিনে তরমুজ লয়া আহ ক্যালা!'

কে এই লেখক? চমকে উঠলাম! আমার এতদিনের পাঠ অভিজ্ঞতার সাথে তার লিখনরীতির কেন কোনো মিল নাই? তার কিছুদিন পরই পড়া গেল তদানীন্তন শৈলী-তে 'ধুলোর দিনে ফেরা'। দীর্ঘদিন নকশাল আন্দোলনে আত্মগোপন করে থাকা আব্দুল ওয়াহিদ একুশ বছর পরে সুহাসিনী গ্রামে ফিরে আসে: 'পরবর্তী সময়ে সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, দীর্ঘদিন পূর্বে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া আব্দুল ওয়াহিদের কথা তারা ভুলে গিয়েছিল এবং অবচেতন মনে তারা ধরে নিয়েছিল যে, সে হয়তো ইতিমধ্যে কোথাও কোনোখানে মারা পড়েছে। কিšত্ত একুশ বছর পর ধুলোর গন্ধের ভেতর সে গ্রামে ফিরে আসে এবং এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই ফসলের মাঠের ভেতর তার মৃতদেহ পড়ে থাকে; তখন গ্রামের লোকেরা এই কথা বলে যে, মারা পড়বার জন্যই সে গ্রামে ফিরেছিল। গ্রামের লোকেরা বলে যে, শীতের শুষ্কতার পর ধুলোয় যখন চরাচর আচ্ছন্ন হয়েছিল এবং ফাল্গুনের প্রথম থেকেই আউসের বীজ ফেলার জন্য তারা প্রথম বৃষ্টির অপেক্ষায় ছিল সেই সময় একদিন আব্দুল ওয়াহিদ সুহাসিনীতে ফিরে আসে এবং তোরাপ আলীর সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়।'

মিয়াবাড়ির ছেলে আব্দুল ওয়াহিদ এবং তার বাল্য বন্ধু আবুল হোসেন বাল্যে এবং প্রথম যৌবনে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল এবং চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে তারা একসঙ্গে ঢাকা গিয়েছিল। লেখাপড়া শেষ করে আবুল হোসেন গ্রামে ফিরে আসে কিšত্ত আব্দুল ওয়াহিদ লেখাপড়া ত্যাগ করে গোপন রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। একুশ বছর আগে গ্রাম ছেড়ে যাবার সময় আব্দুল ওয়াহিদ নূরজাহান নাম্নী এক গ্রাম্য কিশোরীকে শালিক পাখির বাচ্চা দিয়ে দুষ্টুমি করে বলেছিল যে এটি একটি ময়না পাখি এবং নূরজাহান যেন তাকে কথা বলা শেখায়। কিশোরী নূরজাহান গ্রামের সবার কথা অগ্রাহ্য করে শালিক পাখিকে দীর্ঘকাল ময়না পাখি ভেবে কথা শেখানোর চেষ্টা করে যায় কিন্তু শালিক পাখি ময়না পাখি হতে পারে না বা কথা বলতে পারে না। আবুল হোসেন গ্রামে ফিরে আসার পর নলকা, সুজাপুর, নলছা, ব্যাঙনাই এবং বাঁশরিয়া গ্রামের মানুষেরা নকশাল নামের একদল মানুষের কথা জানতে পারে যারা গরিবকে কিছু বলে না কিন্তু ধনী কৃষকদের ধরে নিয়ে গিয়ে জবাই করে। গ্রামে এসময় আব্দুল রশিদ প্রামাণিকদের মতো বড় কৃষকরা কেউ কেউ উত্তেজনায় পাগল হয়ে যায় এবং ব্যাঙনাই গ্রামের ইয়াসিন বিশ্বাস ও তার বড় ছেলে জমিরউদ্দিনকে ইছামতি নদীর কিনারায় হত্যা করা হয়; মৃত ইয়াসিন বিশ্বাসের গেঞ্জির সঙ্গে এক টুকরো কাগজ সেঁটে দেয়া ছিল এবং তাতে লেখা ছিল, শ্রেণীশত্র" খতম করা চলবে। তখনো জনশ্র"তি ছিল যে মিয়াবাড়ির গৃহত্যাগী পুত্র আব্দুল ওয়াহিদ এই খতমের দলের মানুষ। একুশ বছর পর আব্দুল ওয়াহিদের ফিরে আসার এক বছরের মাথায় ধানক্ষেতে তার ক্ষতবিক্ষত ও প্রাণহীন দেহের পিঠে গেঞ্জির সঙ্গে এক কাগজের টুকরো সেঁটে দেয়া ছিল এবং তাতে লেখা ছিল, প্রতিশোধ নিয়ে গেলাম। বন্ধুর মৃত্যুতে আবুল হোসেনের কান্নায় গ্রামবাসীর মনে পড়ে যে আব্দুল ওয়াহিদ ফিরে আসার পর আবুল হোসেন তাকে প্রথম যে কথাটি বলেছিল তা' হলো নূরজাহানকে বিয়ে করার সংবাদ জ্ঞাপন। 'গ্রামের লোকেরা জানতে পারে যে, ফিরে আসার পর আবুল হোসেন যেদিন প্রথম আব্দুল ওয়াহিদকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়, একুশ বছর পর শ্যামল ও সুশ্রী ভরা নদীর মতো নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে কথা বলে উঠতে পারার আগেই নূরজাহান কথা বলে, ম্যাবাই ময়নার ছাও কয়া আমাক শালিক দিছিলেন ক্যা?' মৃত্যুর আগে গ্রামে বাস করার এক বছরে আব্দুল ওয়াহিদ একদিন নূরজাহানকে কুয়োতলায় দেখে কাঁদতে। আব্দুল ওয়াহিদ তখন হয়তো তাকে জিজ্ঞেস করে থাকবে, 'কান্দেন ক্যা?' উত্তরে নূরজাহান সম্ভবত বলে, 'সুখ নাই জীবনে।' আব্দুল ওয়াহিদের মৃত্যুর পর নূরজাহান দেখতে পায় গত এক বছরে যে একটি পুরুষ ও একটি ময়না পাখিকে আব্দুল ওয়াহিদ কথা বলা শিখিয়েছে, সেই পুরুষ ময়নাটি মেয়ে ময়নাকে জিজ্ঞাসা করে, 'কান্দেন ক্যা?' পুরুষ ময়নার প্রশ্নে বিব্রত ও হতচকিত নূরজাহান যখন বলতে যায় 'না কান্দি না তো'…তার আগেই মেয়ে ময়নাটি বলে 'সুখ নাই জীবনে।' বিষণœতার এমন হু হু আখ্যান নিশ্চল করে তুলেছিল সকল বোধশক্তি। তারওপর পত্রিকান্তরে পড়া হচ্ছে 'কাঁটা।' পুরনো ঢাকার মহল্লার পাতকুয়ায় সুবোধ চন্দ্র ও তার স্ত্রী স্বপ্নার বারবার পড়ে যাওয়ার গল্প। কারা ঠেলে ফেল দিল সুবোধ চন্দ্র ও স্বপ্নাকে? ১৯৬২, ১৯৭১ এবং ১৯৮৮৮-তে? মহল্লার মানুষ বারবার শিউরে ওঠে। এইবারও যে নতুন ভাড়াটে এসেছে, তার নাম সুবোধ চন্দ্র ও তার স্ত্রীর নাম স্বপ্না। হায় হায়, এবারও কি তাদের হাত দিয়েই সুবোধ চন্দ্র ও স্বপ্নাকে কুয়াতে ঠেলে ফেলা হবে? তারা অমন মন্দ কাজটির পুনরাবৃত্তি আর করতে চায় না। তবু, তাদের হাত দিয়েই কাজটি বারবার সম্পন্ন হতে থাকে: 'ভূতের গলির লোকেরা সময়ের এক জটিল গোলক ধাঁধার ভেতর প্রবেশ করে, কারণ দেখা যায় যে, তারা স্বপ্নার বানানো নিমকপারা খাওয়ার কথা ভুলে যেতে পারে না এবং তাদের এই কথাটি সর্বদা মনে পড়ে যে, সুবোধচন্দ্রকে তারা ক্রমাগতভাবে বলেছিল, ডরায়েন না, কিন্তু সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রী ক্রমাগতভাবে মহল্লার কুয়োর মধ্যে পতিত হয় অথবা তারাই তাদের ফেলে দেয়।'

বাংলাদেশে বৃহত্তম ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি উৎপীড়ন নিয়ে অজস্র প্রচারণা-প্রোপাগাণ্ডামূলক গল্প লেখা হয়েছে এবং আজো হচ্ছে। জহির, এই সমস্যা নিয়ে হরে-দরে গল্প লেখা অন্য লেখকদের থেকে বিষম আলাদা হয়ে, অনবদ্য মুন্সিয়ানায় দেখান যে মহল্লার মানুষ তো ১৯৭১ সালে সুবোধ ও স্বপ্নাকে বাঁচাতেই চেয়েছে! সুবোধ ও স্বপ্না যখন সহজ নামাজ শিক্ষা হতে কলেমা তৈয়বা মুখস্থ করে কিম্বা সুবোধ চন্দ্র যখন মাথায় সাদা টুপি পরে মহল্লায় পাক বাহিনীর প্রথম ধর্ম পরীক্ষায় কলেমা তৈয়বা মুখস্থ বলে পাস করে, তখনো পড়শিরা তাদের সহায় ছিল। কিন্তু, পাক বাহিনী যেদিন সার বেঁধে মহল্লার পুরুষদের লুঙ্গি তুলে ধর্ম পরীক্ষা করছে, তখন সুবোধ চন্দ্রের পাশের লোকটির আপন প্রাণ বাঁচাতে তাকে কুয়োয় ঠেলে ফেলে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে কি? কারণ, সে জানতো যে সুবোধ চন্দ্র ধরা পড়বেই এবং তার ধরা পড়া মানে তাদের সবার ধরা পড়া। অবশ্য এর পরপরই গুলি ও কুয়ায় পড়ে আরো তিন/চারজনের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। বাবরি মসজিদ ভাঙার পরও তারা সুবোধ-স্বপ্নাকে বাঁচাতে চেয়েছে। তবে পারে নি শেষ পর্যন্ত। '…মহল্লার লোকেরা যখন এইসব কথা শোনে, তাদের এক ধরনের দুশ্চিন্তা দেখা দেয় এবং তাদের যখন মনে পড়ে যে, মহল্লায় কলের পানি আসার পরও আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়ির ভেতরের পাতকুয়োটি আগের মতোই রয়ে গেছে, তখন তাদের দুশ্চিন্তা ভয়ে রূপান্তরিত হয় এবং তারা কয়েকজন একদিন আজিজ ব্যাপারিকে বলে, আপনের বাইতে আবার সুবোধচন্দ্র আইলো ভাড়াইট্টা হয়া!

আইলে কি করুম!

এই হালার বৌয়ের নামবি হালায় ছপ্না!

হঁ

অর ছুটো ভাইয়ের নাম জানেন?

না।

পরান।

তাই নিহি!

আপনের কুয়া তো অখনো রয়া গেছে গা, এই হালায় আবার না কুয়ায় পড়ে!

আরে না।'

১৯৯৫ হতে ১৯৯৮ কালের শৈলী-তে তখন কুয়াত-ইল-ইসলাম আছেন। কুয়াত ভাইয়ের গাম্ভীর্যকে অসম্ভব ভয় পেলেও মনে মনে একটা কারণে তার প্রতি প্রসন্ন হয়ে উঠি যে 'ধুলোর দিনে ফেরা'-র পর জহিরের 'চতুর্থ মাত্রা'ও তিনি প্রকাশ করেন। কেন এই গল্পের নায়ক আব্দুল করিম ইচ্ছা করে বারবার কাচের গ্লাস জানালার পাশে রেখে দ্যায় আর পাড়ার বাচ্চারা সেই কাচের গ্লাস ভেঙে কটকটি খাবার লোভে রক্তারক্তি হতে থাকে? গল্পটার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে সরাসরি কুয়াত ভাইকেই জিজ্ঞাসা করি, 'লোকটা এত অদ্ভুত কেন? সে রোজ পুরনো খবরের কাগজ বিক্রি করে আর পুরনো গ্লাস ঘরের দরজার সামনে রেখে দ্যায় এটা জেনে যে বাচ্চারা এসে এটা ভেঙে কটকটি খাবার লোভে রক্তারক্তি হবে?' কুয়াত ভাই খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, 'আরে বাবা–এ্যালিয়েনেশন! একটা মানুষ কতখানি এ্যালিয়েনেটেড হলে সে চায় মহল্লার বাচ্চারা তার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াক, খেলুক, হইচই করুক…এত কিছু বোঝেন–সিম্পল এই ব্যাপারটা বোঝেন না?'

ততদিনে শহীদুল জহির সম্পর্কে নানা কিছু জানতে শুরু করেছি। পেশায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সচিবালয়ে কর্মনিযুক্ত। বয়স প্রায় পঞ্চাশের দিকে হেলে পড়েছে অথচ অবিবাহিত। অবিবাহিত হলেও অকৃতদার আহমদ ছফার মতো আড্ডা বা সামাজিক যোগাযোগে সপ্রাণ নন। বলতে গেলে রীতিমতো কোটরবাসী। তার লেখা নিয়েও চারপাশে নানা কথা। তরুণরা তাকে দেখছি বিশাল উচ্চতায়। একটু সিনিয়ররা বলছেন, 'আরে–মার্কেজ নকল করে! স্ট্যান্টবাজ! প্যাঁচানো সেন্টেন্স! সে একই পুরনো ঢাকার গল্প!' ১৯৯৯-এ বের হলো তার 'ডুমুরখেকো মানুষ'। একে একে পড়লাম 'কাঠুরে ও দাঁড়কাক', 'এই সময়' (পরে যে গল্প অনুসারে আশিক মোস্তফা নির্মাণ করেছেন ফুলকুমার), 'আগারগাঁও কলোনীতে নয়নতারা ফুল কেন নেই' বা 'ডুমুরখেকো মানুষ'। শেষ দুটো গল্পতে বইয়ের বাদবাকি ছ'টি গল্পের মতো অব্যর্থ সফল অবশ্য মনে হয় নি লেখককে। কিন্তু, এই বইয়ের বাকি ছ'টি গল্পই শিহরন জাগানো! 'কাঠুরে ও দাঁড়কাক' গল্পের ভূমিহীন, কাঠুরে নায়ক আকালু ও তার স্ত্রী টেপি সিরাজগঞ্জ শহরের পশ্চিমে বৈকুণ্ঠপুর গ্রামে মিয়াদের সম্পত্তিতে ভিটে তুলে থাকে। 'ভিটেয় তাদের একটি থাকার ঘর এবং একটি রান্না করার চালা, পায়খানা নাই; এ প্রয়োজনে তারা ভিটের পূর্বধারে ঘন বাঁশঝাড় ব্যবহার করে। আকালু ও টেপি দুজনেই কালো এবং দুজনেরই স্বাস্থ্য খারাপ, কিন্তু তাদের দুজনেরই জীবনে তখন যৌবন এবং দুজনে খুব ভাব। আকালুর মনে হয় যে, তার বৌটি মন্দ না, কেবল মাথায় একটু ছিট আছে; একা একা বিড়বিড় করে কথা বলে আর রাতে ঘুমানোর পর দাঁত কটকট করে। এজন্য আকালু নানা রকম তাবিজ যোগাড় করে টেপির শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ঝুলিয়ে দেয়;' এহেন আকালু ও টেপির জীবনে হঠাৎই দাঁড়কাক এক ভয়াবহ অনুষঙ্গ হয়ে হাজির হয়। এক বৃষ্টির দিনে পঞ্চাশ টাকা প্রাপ্য মজুরির কাঠ বিশ টাকায় কাটতে গিয়ে পরিশ্রান্ত আকালু বটের গুঁড়িতে একশ টাকা নোটের দশটি তাড়া দেখে অবাক হয়ে যায়। শহরে আদালত পাড়ায় উকিলের কাছে বুদ্ধি নিতে গেলে উকিল ও উকিলের কাছে আকালুকে নিয়ে যাওয়া দালাল দশটি বাণ্ডিলের আটটি বাণ্ডিল নিয়ে নেয় বুদ্ধি ও দালালির দাম হিসেবে। টেপি এ কথা জেনে মন খারাপ করলে তার সরল স্বামী জানায়: 'এহনও দুই বাণ্ডিল আছে। আকালু বলে, দুই বাণ্ডিলেও অনেক ট্যাহা।'

'আকালুর কথায় টেপির মন-খারাপ দূর হয়, কালো মুখে হাসি ফুটে ওঠে এবং বিকেলবেলায় সে পুনরায় গাছ,

পাখি আর বাতাসের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে।' কিšত্ত, 'রাত হলে তারা খেয়ে শুয়ে পড়ার পর, মুখে গামছা বাঁধা পাঁচজন লোক এসে তাদেরকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রাঙ্গণের আমগাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধে এবং তারপর ঘরের মেঝে খুঁড়ে টাকাগুলো নিয়ে যায়।' সেযাত্রা কোনোমতে উদ্ধার পেয়ে আকালু ও টেপি পরদিন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। চান্দু নাম্নী এক অপরিচিতি রিক্সাঅলা আকালুকে আশ্রয় দেয়। আকালু রিক্সা চালানো শেখে এবং টেপিও ঘরকন্না শুরু করে। এমনি সময় আবার দাঁড়কাকের আগমন ঘটে আকালুর জীবনে। যথারীতি রিক্সার এক সওয়ারির মানিব্যাগ ছিটকে পড়ে সত্তর টাকা পেলে আকালু এবার সেটা নেয় না। বরং নিকটস্থ থানায় গিয়ে উনসত্তর টাকা দিয়ে এক টাকা নিজের ভাড়া হিসেবে রেখে দ্যায়। পুলিশ উল্টো আকালুর নিজস্ব ছয় টাকা সহ মোট সাতাত্তর টাকা হাতিয়ে নেয় এবং আকালুকে পিটায়। কোনোমতে পুলিশের হাত হতে রক্ষা পেয়ে বস্তিতে ফিরে চান্দুর কাছে সব কথা বললে চান্দু তাকে জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে যায়। জ্যোতিষী আকালুর জন্য ষাট টাকা দামের নীলা পাথরের সুপারিশ করলে আকালু চান্দুর কাছ হতে ত্রিশ টাকা ধার নিয়ে নীলা কেনে। তার দুদিন পর পুলিশ বস্তিতে এসে হাজির হয় এবং 'দুদিন আগে সন্ধের পর বিদ্যুৎ চলে গেলে নাজিরাবাজারের জ্যোতিষ ভাস্করের কাচের কেসের ভেতর থেকে রত্নরাজি চুরি করেছে এই অভিযোগে আকালুকে তার ঝুপড়ি থেকে পাকড়াও করে। পুলিশ চান্দুকেও খোঁজে, কিšত্ত সে খবর পেয়ে পালায়।'

পুলিশ আকালুর কোনো কথা না শুনে দু'তিনবার মারপিট করার পর আকালু বোঝে দোষ না করলেও জেলে তাকে যেতেই হবে। কাজেই, চুরি না করলেও চুরির দায় সে স্বীকার করে এবং বলে তাকে চুরির বুদ্ধি দিয়েছে বউ টেপি। পুলিশ তখন আকালু ও টেপি উভয়কেই জেলে পুরলে দুজনে দিনের বেলা জেলের প্রাঙ্গনের লোহার বেড়ার দুপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলে কাটায়। দাঁড়কাক হায় এরপরও আকালুরও পেছন ছাড়ে না! এক দুপুরে জ্বরের ঘোরে জেলখানায় ঘুমিয়ে থাকার সময় একটি দাঁড়কাক আকালুর গায়ে একটি সোনার আংটি ছুঁড়ে ফেলে যায়। আকালু, ঝামেলা এড়াতে, সেলের অন্য বাসিন্দা আবুল হোসেনকে আংটিটি দিয়ে দিলেও ঝামেলা এড়ানো যায় না। কারণ দশ দিন পর এই আংটি পাচার করে বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় আবুলের স্ত্রী ধরা পড়ে এবং জেলারের সামনে আবুলকে ডাকা হলে সে কাঁপতে থাকে এই বলে যে আংটিটি আকালু তাকে দিয়েছে। জেলার আকালুকে ডাকলে আকালু কাকের কথা বলে। জেলার একসময় বিশ্বাস করে এবং চারমাস পর আকালু ও টেপিকে ছেড়ে দেন। জেলার এরপর তাদের মগবাজারের পূর্বপ্রান্তে নয়াটোলায় নিয়ে আসে এবং সেখানে ঝুপড়ি বেঁধে তারা থাকে। কিন্তু, এখানেও অজস্র দাঁড়কাক আসে যাদের বাধ্য হয়ে থাকার জন্য ৬৬৩টি আড়া বেঁধে দেয় আকালু। এলাকার ঝাড়–দারনী নিমফল দাসীকে টেপি একদিন কাকের ডিম ভাজি খাইয়ে এবং কাকের ফেলে দেওয়া একজোড়া সোনার দুল দিলে মহল্লার লোক সোনার দুলের আশায় আকালুর বাড়ি ফেরার পথে তেরো দিন তার উপর কাঁঠালের ভূঁতি ছুড়ে মারে, পাঁচ দিন ছোঁড়ে পচা গোবর। টেপির যাওয়া-আসার পথে কুকুর লেলিয়ে দেয়। শেষমেশ আকালু ও তার স্ত্রীকে টানা ছাব্বিশ দিন ধরে অবরোধ দেবার পর যখন বোঝে যে আকালু ও টেপি হয়তো কাকের ডিম ভাজি খেয়েই বাঁচতে পারবে তখন ত্রিশ দিনের মাথায় আকালুর বাসায় তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। কাকের দল আকালু ও তার স্ত্রীকে ঠোঁটে করে রামপুরার ঝিলের উপর দিয়ে ধলেশ্বরীর কুয়াশার ভেতর উড়ে যায়। কী বলতে চেয়েছেন জহির? আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের নিদারুণ অসহায়ত্ব? এ কি কোনো কালো কৌতুক? উকিল, পুলিশ, জেলের সহবন্দি কি মহল্লার একই বর্গের মানুষ…কেউ তাকে বাঁচতে দেয় না?

'ডুমুরখেকো মানুষ'-এর পর আস্তে আস্তে হাতে এসেছে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প আর মুখের দিকে দেখিজীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার শেষটা কিছুতেই ভোলা যায় না। ১৯৭১ সালে যে রাজাকার নায়কের বড় বোনকে পাকিস্থানীদের হাতে ধরিয়ে দেয়, বড় বোন ধর্ষিত ও খুন হয়, সেই বড় বোনের নামে মেয়ের নামকরণের অনেক পর '৭১-এর কিশোর আর আজকের গৃহস্থ পিতাকে সেই একই রাজাকার উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠায় এসে জিজ্ঞাসা করে, 'মাইয়ার নাম নাকি মোমেনা রাখছ?'
'হ।'
'বইনের নামে মাইয়ার নাম রাখছ?'
'হ।'
'বইনেরে এখনো ভুলতে পারো নাই?'

১৯৭১-এর গণহত্যার বিপন্নতা নিয়েও যে নায়ককে মহল্লা ছাড়তে হয় নি, স্বাধীন বাংলাদেশে শেষ পর্যন্ত সে মহল্লা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, ১৯৭১-এ সে তার বোনকে বাঁচাতে পারে নি। আজ দুহিতার সম্ভ্রম ও জীবনও বাঁচানো দুরূহ। বারবার ঝুঁকি নেবার চেয়ে সে বরং উদ্বাস্তু হবে অন্যতর কোনো ভিড়ে। মোমেনা তো নিছকই বোন বা মেয়ে নয়। মোমেনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও সাধারণ গণমানুষের প্রতিরোধ। তেজস্বিনী অগ্রজা মোমেনা তো প্রকাশ্যে পাকিস্তানী আর রাজাকারদের দিকে তেড়ে গেছিল, প্রতিবাদ করেছিল। কিশোর ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে ধর্ষিত ও নিহত হয় সে। সেই মোমেনাকে ভুলে না যাওয়া, মুক্তির যুদ্ধকে রক্ত ধমনীতে প্রজন্মান্তরে বহন করাই প্রবল পাপ হয়ে ওঠে নায়কের। যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের এই অসামান্য কাহিনীতে মূল কাহিনীর মাঝে সমান্তরালে থাকে পাড়ার মেট্রিক পরীক্ষা ফেল জনৈক মুসলিম কিশোরের পাড়ারই এক হিন্দু কিশোরীর পিছু পিছু ঘোরা এবং গোটা বিষয়টিতে কিশোরীর নির্বিকার উদাসীনতার গল্প। কথকের অসামান্য দক্ষতায় জহির এরপর জানান যে তীব্র প্রাণশক্তির বলে ছেলেটি একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে, সেই প্রাণপ্রাচুর্যেই যুদ্ধে যায় সে। এবং আর ফিরে আসে না। কিশোরীর উদাসীনতা ততদিনে যেন ঘুচেছে। যতদিনে ঘুচেছে, ততদিনে এই নবলব্ধ মনোযোগের আর যেন কোনো দরকার থাকে না। মেয়েটি ধীরে ধীরে বয়সী হয়। তার চিরকৌমার্যের কারণ কেউ বোঝে না। প্রতি শনিবার আজো অবশ্য সে শনিপূজা করে: 'আসেন শনি বসেন সাথে/ পসাদ দিব হাতে হাতে!'

জহিরের অনেক গল্পেই অবিবাহিত পুরুষ বা নারীর নিঃসঙ্গ বিপন্নতা আছে। তবে সেই বিপন্নতা যেন তার নিজেরই বেছে নেওয়া। যেন এই বিপন্নতা তার কাছে রীতিমতো সুস্বাদু। একক নারী বা পুরুষের বিপন্নতার কাহিনী আছে তুরস্কের অধুনা আলোচিত লেখক ওরহান পামুকের রচনাতেও। মাই নেম ইজ রেড-এর চিত্রশিল্পী নায়ক খালাতো বোনের প্রেমে পড়ে দীর্ঘকাল অবিবাহিত (যেহেতু খালাতো বোন বিয়ে করেছে অন্যত্র), স্নো-র নায়কও পুরনো শহরে ফিরে এসে অন্যত্র বিবাহিত এবং বর্তমানে বিচ্ছেদপ্রাপ্ত প্রেমিকার খোঁজে হন্য। জহির বিয়ে করেন নি। ওরহান পামুক বিয়ের ন'বছরের মাথায় ডিভোর্সি। এবং পুনরায় বিয়ে আর করেন নি। দাম্পত্য জীবন ও লেখক জীবনের ভেতরকার সংঘাত নিয়ে পামুকের মন্তব্যটিও পর্যবেক্ষণযোগ্য: ' প্রতিদিনের গার্হস্থ্য জীবনের নানা খুঁটিনাটি লেখকের অন্তর্নিহিত কল্পভুবন, তার ভেতরের দৈত্যটাকে মেরে ফেলে।' হায়, এই পৃথিবীতে যে মানুষ বা মানুষী আঁকা, গাওয়া, লেখা বা নাচার ক্ষমতা কি প্রতিভা নিয়ে জন্মেছে, তার চেয়ে অভিশপ্ত আর কে আছে? যেন এই মর্ত্যলোকে সে কোন অভিশপ্ত গান্ধর্ব-গান্ধর্বী কি কিন্নর-কিন্নরী। সংসার জীবনে প্রবেশ করলে সঙ্গী বা সঙ্গীনীর সাথে তেল-নুন-পেঁয়াজের হিসাবের সমস্যাতেও পীড়িত হতে হয়, আবার সম্পূর্ণ একাকিত্ব বরণ করাও যে কী দুরূহ! কেউ কেউ তবু শেষের পথটিই বেছে নেন। মনে পড়ে কথা পত্রিকায় কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে দেওয়া একাকি জীবন প্রসঙ্গে জহিরের বক্তব্য, 'আপনি শরীরে আগুন নিয়া ঘুইরা বেড়াবেন। আর লোকে ভাববে কী জানি কী করতাছে?'

যাহোক, ফিরে আসি জহিরের লেখার ভুবনে। জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা ছাড়া আরো দুটো উপন্যাস লিখেছেন তিনি। সে রাতে পূর্ণিমা ছিল নিয়ে হৈ চৈ যতটা, সেই তুলনায় জহিরের শিল্পিত পরিমিতিবোধ ও রসজ্ঞতা এ উপন্যাসে একটু হলেও যেন মার খেয়েছে! স্থানে স্থানে অশ্লীলতা রীতিমতো পীড়াদায়ক। একটি গ্রাম্য ভূস্বামী পরিবারের সবাইকে এক রাতে হত্যা করার ঘটনার সাথে অনেকে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের মিল পান। জহির নিজে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে বাংলাদেশের একটি হিন্দু পরিবারের আট/দশজন সদস্যকে একরাতে খুন করে ফেলার ঘটনা হতে তিনি এই উপন্যাস লিখতে প্রেরণা পেয়েছেন। সপরিবার হত্যা, নৌকায় বন্দি এক যুবককে (গ্রামীণ ভূস্বামী বৃদ্ধ যখন তরুণ ছিলেন) বাঁচাতে এক গ্রামীণ পতিতার নৌকার দুই চালকের সাথে তিন/চার রাত টানা মৈথুনের পর দুই চালক তথা সম্ভাব্য হত্যাকারী সহ পতিতার মৃত্যুদৃশ্য অবশ্য জহিরের গভীর মানবীয় সংবেদ প্রকাশ করে। উপন্যাসটি সুসম্বন্ধ হয়ে ওঠেনি ভাষার গভীরতা সত্ত্বেও।

'ডুমুর খেকো মানুষ'-এর পাঁচ বছর পর ২০০৪ সালে ডলু নদীর হাওয়ায় জহির নিজেকে উপস্থাপন করেন সম্পূর্ণ অন্যভাবে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা অপরিমিত ব্যবহার করেন তিনি নাম গল্পে। বার্মার আকিয়াব অঞ্চলের মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠির সাথে সংমিশ্রণের ফলে চট্টগ্রামের বাঙালী যে ভিন্ন নৃতত্ত্ব, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক ও জীবনাচরণের অধিকারী তা মূর্ত হয়ে ওঠে মগের মেয়ে এলা চিং এবং বিবাহোত্তর সমর্ত বানুর চরিত্র বর্ণনার মাধ্যমে। এই বইয়ের অন্য দুটো উল্লেখযোগ্য গল্প হলো 'ইন্দুর বিলাই খেলা' এবং 'কোথায় পাবো তারে'। 'ইন্দুর বিলাই খেলা'র শুরুতেই লেখক জানাচ্ছেন ইন্দুর ও বিলাইয়ের সংজ্ঞা।

'ইন্দুর: ইন্দুর হচ্ছে ইন্দুর জাতীয় প্রাণী
(বাক্য গঠন: ইন্দুর ভায়া পেয়েছে ভয়!)
বিলাই: বিলাই হচ্ছে বিলাই জাতীয় প্রাণী
(বাক্য গঠন: বিলাই চড়ে জগৎময়।)

…ভূতের গলির খেলোয়াড়গণ:
খেইলে ইন্দুর হয় কারা? আমরা হই; আলতাফ আলি, মোহাম্মদ সেলিম, মোছাঃ খতিজা বেগম, চন্দ্রকান্ত ও পূর্ণলক্ষী বসাক, এবং আরো অনেকে হয়।

কারা বিলাই হয়? বাবুল মিঞা, হুমায়ুন কবির ওরফে হুমু, তার ভাই জাহাঙ্গির হোসেন ওরফে জাহু, আব্দুল জব্বার ওরফে কান কাটা জব্বার, আব্দুল গনি, মওলানা আব্দুল গফুর, শামসুল আলম খান এবং তার ছেলে ইব্রাহিম খান, আব্দুল হাকিম ওরফে হাক্কা, এরা হয়।'

ইন্দুর বিলাই খেলায় ইন্দুরপক্ষে আছে উত্তম পুরুষে নায়কের খেলার সাথি আসলামের ফুপু মোহাম্মদ খতিজা যাকে পাড়ার মায়েরা আড়ালে নষ্ট মেয়ে মানুষ বা 'বীরাঙ্গনা' বলে। 'আমরা এই কথা শুনি এবং আমাদের হাতের কাছের আইডিয়াল লাইব্রেরির আধুনিক বাংলা অভিধান বের করে দেখি: বীরাঙ্গনা=বীরের স্ত্রী লিঙ্গ। আমরা বুঝতে পারি আসলামের ফুপু খতিজা বীরের স্ত্রী লিঙ্গ ছিল, কিšত্ত আমরা বুঝি না মায়েরা এই কথা লুকিয়ে ফিসফিস করে কেন বলে।' ইন্দুর বিলাই খেলার আর এক ইন্দুর পক্ষ হলো বালিকা পূর্ণলক্ষীর বাবা চন্দ্রকান্ত ও মা সত্যলক্ষী বসাক। 'প্রথমে আবুল কালাম আজাদ ভাইয়ের পক্ষ থেকে কান কাটা জব্বার আসে, চন্দ্রকান্ত তাকে চেনে, সে তাকে চেয়ার এনে বারান্দায় বসতে দেয়, তখন সে চন্দ্রকান্তকে বলে, দাদা ভোট দিবার যাইবার চান? চন্দ্রকান্ত চুপ করে তাকিয়ে থাকে, আব্দুল জব্বার তার চোখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় যখন বলে, দাদা যাইবেন সেন্টারে? তখন চন্দ্রকান্ত বলে, ঠিক আছে যামু না! তারপর মিলন ভাইয়ের হয়ে কথা বলার জন্য আসে আব্দুল হাকিম ওরফে হাক্কা এবং তার দলবল, চন্দ্রকান্ত তাকেও চেনে, সে তাকেও খাতির যত্ন করে, তারপর সে যখন বলে, দাদা ভোট দিবার যায়েন কিন্তু, না গেলে কিন্তু গোসা হমু দাদা; তখন সে বলে, আইচ্ছা যামু।' 'কোথায় পাবো তারে' গল্পের কিশোরটি কেন ময়মনসিংহের শেপালি আক্তারের গ্রামে এত ঢাক-ঢোল পিটিয়ে যেয়ে মেয়েটাকে না দেখেই ফিরে আসে? কে জানে এর উত্তর? ডলু নদীর হাওয়ায় আরো আছে 'মহল্লায় বান্দর, আব্দুল হালিমের মা এবং 'আমরা' সহ আরো কয়েকটি নামের গল্প। 'মহল্লায় বান্দর, আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা' তত শক্তিশালী লেখা নয়। কিছুটা অশ্লীলতা আছে বৈকি এ গল্পে।

শহীদুল জহিরের সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ হলো মুখের দিকে দেখি। মধ্যমাকৃতির এ উপন্যাসে বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়, কী করে পর্তুগীজ কোনো কোনো পুরুষ ধর্মপ্রচারে এসে বাঙালী নারী বিয়ে করে মিশে গেছেন আমাদের জনপ্রবাহে…এসব কিছুই আছে। আছে নায়িকা জুলির মা মেরি জয়েস ও তার পিতা রবার্ট ফ্রান্সিসের প্রথম প্রণয় দৃশ্যে মেরি জয়েস চার্চ প্রাঙ্গনে একটি রক্তিম শিমূল ফুল কুড়িয়ে নেবার সময়, রবার্ট ফ্রান্সিস তাকে মুগ্ধ করার জন্য শিমূল ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম 'বোম্বাকস্ সীবালিন' জানালে মেরি জয়েস মুগ্ধ হন। বিয়ের বহু পরে রবার্ট ফ্রান্সিস যখন অসুস্থ, মেরি জয়েস স্বামীকে শিমূল ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম জিজ্ঞাসা করায় রবার্ট উত্তর জানাতে ব্যর্থ হন। মেরি কেঁদে ফেলেন স্বামীর এ বিস্মরণে। জুলি কিছুতেই বুঝে পায় না তুচ্ছ শিমূল ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম নিয়ে মার এ অধীরতা কেন। জুলির ভাই যোসেফ ইউজিন বিজি প্রেসের জব সেকশনে সহকর্মী শাকিলা বানুর কাছ হতে প্রতিদিন দুপুর বেলা টিফিনের ভাগ নিতে নিতে একদিন নাখালপাড়ায় ছেলেদের হাতে মার খায়। যোসেফ এরপর লণ্ডনের উত্তরে মিড কান্ট্রি শহর বার্মিংহামে গিয়ে বসতি গাড়লেও গায়ের রঙের কারণে তার পক্ষে সেখানে যোসেফ ইউজিন হওয়া দুরূহ হয়ে ওঠে। শ্বেতাঙ্গ তরুণরা তাকে 'পাকি' বলে গাল দেয় এবং একদিন পথে দুর্বৃত্তের ছুরিতে তার পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায়। একটি বাঙালী খ্রিষ্টান পরিবারের ক্ষয়ের কাহিনীর পাশাপাশি পুরনো ঢাকার ভূতের গলির চানমিঞা এবং চানমিঞার মা খৈমন ও বাবা মৃত ময়না মিঞা, ফখরুল আলম লেদু, মামুনুল হাই ওরফে মামুন, মামুনের মা মিসেস জোবেদা রহমান, নুরানি বিলকিস উপমা, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার আসমানতারা হুরে জান্নাত এবং তার মা ডলি আক্তার, মেরি জয়েসের পর্তুগিজ ঠাকুর্দা আলবার্ট চার্লস ডিসুজা এবং মেরি জয়েসের ঠাকুর্মা কুমারী বিদ্যুন্মালা দাসী, বিদ্যুন্মালার বাবা বিধুভূষণ দাস, মা জগত্তারিনী দাস, বড়বোন লাবণ্যপ্রভা দাস সহ অনেকেই এ আখ্যানের চরিত্র। পুরনো ঢাকার ইংরেজি স্কুলের শিক্ষক মেরি জয়েসের মেয়ে জুলির প্রেমে পড়ে শৈশবে স্কুলের সহপাঠী লেদু, মামুন ও চানমিঞা। কপালে শেষমেশ শিকে ছেঁড়ে ঠোঙা বিক্রেতা বিধবা খৈমনের পুত্র চানমিঞার। শৈশবে মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও দরিদ্র বিধবা মায়ের সন্তান হিসেবে স্কুলে নিত্য গঞ্জনায় অস্থির হয়ে স্কুল ছাড়ে চানমিঞা। 'টিচারের মেয়ে' জুলিকে মুগ্ধ করতে বড় হয়ে গাড়ির মেকানিক ও ড্রাইভার চানমিঞা একটি দামি গাড়ি চুরি করে জুলিকে চড়ানোর আশায় যদিও জুলি তাকে ভর্ৎসনা করে এই বলে যে কী করে সে ভাবল যে জুলি চুরি করা গাড়িতে মনের সুখে চড়বে? ঢাকার এক দামি হোটেলে ভারত, পাকিস্থান, শ্রীলঙ্কা ও আরবের জনা পাঁচেক বহুজাতিক ব্যবসায়ীর গাড়ি চুরির ফন্দিতে যখন চান মিঞা ব্যস্ত, সেসময় হোটেলের লবিতে এই পাঁচ ব্যবসায়ীর আলাপ দারুণ চাতুর্যে তুলে এনে দেখিয়ে দিচ্ছেন বহুজাতিক ব্যবসায়ীদের আগ্রাসন: 'তারা, অন্বন্তরি টুনাবতেœ, ঘাসির বিন আহরাম, এণ্ড্রু এল বাউটপ, গাণ্ডিব বহতা এবং কোকিল চন্দ, এক ভাষায় কথা বলে।
: এই দেশের লোকেরা বলে যে, দে হ্যাভ দা চিপেস্ট লেবার ইন দা ওয়ার্ল্ড!
: প্রোবাবলি, নো প্রবলেম, উই উইল ইউজ দেম, এণ্ড উই উইল মেক মানি।
: দে আর দা চিপেস্ট, ইয়েস, উই উইল গিভ দেম ওয়র্ক, এণ্ড দে উইল সিং টু আস!
: দেয়ার উইমেন উইল!
তখন টেলিভিশনে গাণ্ডিব বহতার 'মুরগি তোমার আণ্ডার খোঁজে' প্রোগ্রামের কথা তাদের মনে করে, তারা গাণ্ডিবকে ধরে, আমাদেরকে বল কী করতাছো।
: আমরা বিজ্ঞাপন এজেন্সিকে ট্যাকা দিয়া দিছি, তারা করতাছে, কেউ কিছু বলতে পারতেছে না–আমরা সুন্দরীদের খুঁজে বের করব!
: এণ্ড উই উইল পিক সাম অফ দেম, এণ্ড বিল্ড এ লিটিল ডল হাউজ অন…মে বি সামহোয়ার!
গাণ্ডিব বলে, অন দা পান্থাকুঞ্জা…উই উইল টেক লিজ অফ ইট ফ্রম মিস্টার কোকা।

তখন এণ্ড্রু এল বাউটপের মনে হয় যে, এই দেশে গভার্নেন্স একটা সমস্যা, গুড গভার্নেন্সের বড় অভাব, সে বলে যে, এইটা নিয়া কি কিছু করা যায় না?
: যাবে না কেন? আমরা বলতে পারি যে, তোমরা নেজামত চালাও, আমাদের দেওয়ানিটা দিয়া দেও, আমরা চালাই, টাটা আসতেছে, ধাবি গ্র"প আসতেছে, ভাই এইটা ফ্রি মার্কেট ইকোনমি!'

'মুরগী তোমার আণ্ডার খোঁজে' নামের আওতায় হালফিলের টিভি চ্যানেলে বহুজাতিক কোম্পানি স্পন্সরড্ অনুষ্ঠান, গুড গভার্নেন্স ইস্যু কি মিস্টার কোকা বা টাটা গ্রুপের বাংলাদেশ আসা…সমকালীন বাংলাদেশের কিম্ভুত কিমাকার চালচিত্র এভাবেই আঁকেন জহির।

পাশাপাশি, পুরনো ঢাকার অলিগলি ও চট্টগ্রামের সমুদ্রপথের ভুগোল মুখের দিকে দেখিতে আনতে চাইলেও একটু যেন তাড়া আছে জহিরের সমগ্র বইটিতে। পর্তুগীজদের মিশনারি ধর্ম প্রচারের সময় হতে আজকের সময় পর্যন্ত এই লম্বা যাত্রাটা একটু যেন সুস্থিরতার সাথে আঁকা যেত। খুব দ্রুত ঘটছে সমস্ত ঘটনা। আছে যৌনতা সংক্রান্ত কিছু পার্ভার্সনও।

১৯৫৪ সালে জন্ম শহীদুল জহিরের। প্রথম গ্রন্থ পারাপার প্রকাশিত হয় জুন ১৯৮৫ সালে।

তখনো শহীদুল হক নামে লেখেন তিনি। শহীদুল জহির নামে তাঁর দ্বিতীয় আত্মপ্রকাশ ১৯৮৭ সালে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রকাশের সাথে। ২৩শে মার্চ ২০০৮-এর সকালে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎই সকালে শুনতে পেলাম সেই দুঃসংবাদ। শহীদুল জহিরকে একবারই সামনা সামনি দেখেছিলাম। ২০০১-এর সার্ক রাইটারস্ কনফারেন্স উদযাপিত হয়েছিল ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরিতে। দেখলাম এক দারুণ ঝকঝকে ও পরিচ্ছন্ন চেহারার ভদ্রলোক। খুব ইতস্তত ভঙ্গিতে আর ভয়ে ভয়ে তাঁর সামনে গিয়ে পরিচয় দিতে তিনি নিজে থেকে বললেন আমার গল্প তিনি পড়েছেন এবং আমার গল্প তার ভাল লাগে। লেখক জীবনের গোটা সময়টা সমকালীনদের গালি খেয়ে অভ্যস্ত আমি তাঁর এ আচরণে অবাক হয়ে যাই। এতদিন শুনেছিলাম তিনি অসামাজিক ও অমিশুক। উল্টো তিনি আমি, শাহনাজ মুন্নী, নাসরীন জাহান সহ সবার সাথেই এত সহজভাবে মেশেন যে বিস্ময়কর। তবে, শহীদুল জহির নামটার সাথেই এত দূরস্থিত ভয় ও শ্রদ্ধাবোধ মিশে ছিল যে সেদিন যেন চট করে তার আন্তরিকতার সমান উত্তর করতে পারি নি। ২০০৬-এর বইমেলা থেকে মুখের দিকে দেখি কিনে ফিরবার পর আমার বড়বোন কৃষ্ণা ভীষণ অবাক হয়ে বললো, 'আরে শহীদুল স্যার দেখি! উনি তো আমাদের বস!' আমার কৌতূহল পায় কে! দিদি একটু হেসে বললো, 'আনম্যারেড তো–আর ভীষণ নীতিনিষ্ঠ মানুষ–তাই সবাই ওনাকে একটু ভয় পায়! মানে একটু খিটখিট মেজাজের। কড়া কথা বলে। খুব কাজ করে। তবে, আমার সাথে খুব ভদ্র ব্যবহার করে।'

মাস ছয়েক পর দিদি একদিন অফিস থেকে এসে বললো, 'জানিস, শহীদুল স্যার নিজে থেকে ডেকে আজ জিজ্ঞেস করলেন যে আমি তোর বড় বোন কিনা। তুই যদিও আমাদের পারিবারিক পদবি ব্যবহার করিস না, কিন্তু প্রথম আলোর 'ছুটির দিনে'তে তোর একটা ইন্টারভিউ দেখে তোর সারনেম উনি দুই বছর ধরে মনে রেখেছেন। এবং আজকে জিজ্ঞাসা করলেন।' শুনে আমি আরো তাজ্জব! কিšত্ত, যে আমি আড্ডা দিতে সারা শহর ঘুরে বেড়াই, রিক্সা-সিএনজির পয়সা খরচ করে আজিজে গিয়ে নানা মানুষের অপরূপ সব গালি-গালাজ খেয়ে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরি, সেই আমি শহীদুল জহির আমার বোনের বস জেনেও দেখা করতে দ্বিধা করি। আমার আর যাওয়া হয় না। ইতোমধ্যে কথা পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর নব্বইয়ের গল্প নিয়ে প্রশ্ন তোলায় জহির আমাকে নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছেন। বলেছেন আমার অভিজ্ঞতার জগৎটি বেশ বড়। খুব মসৃন না, তা কিছু তেড়াবেঁকা। আমার একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন আছে যা মার্ক্সীয় দর্শন এবং আমার গল্পগুলো তাই বলে শ্লোগান হয় নি। আমি আমার গল্পকে গল্প করতে সক্ষম। কিন্তু, তারপরও আমার কুণ্ঠা লাগে। আমার বোন মাঝেমাঝেই তাদের জহির স্যারের কথা বললেও আমার যাওয়া হয় না। মাত্র দশ দিন আগে আমার বোন হাসিমুখে আমাকে জানালো, 'শহীদুল স্যার তো প্ল্যানিং কমিশন থেকে সচিবালয়ে বদলি হয়েছেন। গতকাল একটা মিটিংয়ে ওনার নিজের সহকারীর সামনে উনি আমাকে বললেন ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে আমি কাজ করবো কিনা। এখন ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট সামনে বসা। আমি কী করে বলি যে আমি সেটা করবো? তাই চুপ থাকলাম! তুই কিন্তু ইচ্ছা করলে যেতে পারতি একদিন!' আমার খুব কুণ্ঠা লাগে। অত বড় লেখকের সামনে গিয়ে আমি কী বলবো? কী করবো? তেইশ তারিখ সকালে আমার বড়বোন হঠাৎই একটা মোবাইলের পর হন্তদন্ত হয়ে বললো, 'শহীদুল স্যার নাকি স্ট্রোক করে ল্যাব এইডে কোমায়!' তার পরপরই ফোনের পর ফোন। বাংলা একাডেমীতে ওনার শবদেহ আসছে নাকি? এই সেদিন না…২০০১ সালের জানুয়ারি মাসে…ওনাকে দেখলাম? খুব সম্ভবতঃ একটা পেস্ট কালারের ফুলহাতা শার্ট পরা ছিলেন। আজ যাব, কাল যাব করতে করতে আর গেলামই না! এই পোড়া দেশে অনেক মূর্খ লেখক বাংলা একাডেমী পায়। একুশে পদক পায়। শহীদুল জহিরের সেই হিসাবে পদক-পুরস্কার প্রাপ্তির তালিকা ছিল একেবারেই শূন্য। অর্থমূল্যে সাদামাটা আলাওল পুরস্কার আর আজকের কাগজ সাহিত্য পুরস্কার ছাড়া কিছুই পান নি তিনি। কিšত্ত, বাংলা ছোটগল্পের ধারা তিনি বদলে দিয়েছেন। আমাদের তরুণদের শিখিয়েছেন ভাষার নতুন নতুন সিনট্যাক্স নিয়ে খেলা। তাঁর ছোটগল্প নিয়ে এপর্যন্ত সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। বিভিন্ন একাডেমি বা প্রতিষ্ঠানে যে বয়স ফুরনো পণ্ডিতরা বসে থাকেন শিরোপা প্রদানের কর্তৃত্ব নিয়ে, ভাষার ক্ষেত্রে আভাঁ-গার্দ শৈলীর প্রবর্তক জহিরকে তারা বুঝবেন না…কারণ জহির এবং জহিরের মতো হাতে গোনা বিরল কিছু লেখক যারা সংগ্রাম করছেন বাংলা কথাশিল্পে ভাষা ও বিষয়বস্তুর খোলনলচে বদলে ফেলার, গড়পড়তা পাঠক ও বৃদ্ধ প্রাজ্ঞরা সেই সংগ্রাম বুঝবেন না এটাই স্বাভাবিক! নিরীক্ষাবাদী, দুর্বোধ্যতার তকমা নিয়ে মৃত্যু হবে হয়তো তাদের। কারণ, যে ভাষায় জহির লিখেছেন, সেটা বয়স ফুরনো পণ্ডিতদের চেয়ে অন্ততঃ একশো বছর এগিয়ে থাকা ভাষা। একশো বছর পেছনের ভাষা যারা লিখছেন, জনরুচির পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান তাদেরই গুরুত্ব দেবে…এটা নিয়ে মন খারাপ করাও বোকামি। জহির সেভাবে হয়তো লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে ছিলেন না। তবে, লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে থেকেও প্রথাগত লেখা আর দৈনিকে লিখেও অপ্রথাগত লেখা…বাজারে দাঁড়িয়েও ধ্রুপদী নৃত্য যে নাচে আর মন্দিরে দাঁড়িয়েও বাজারি নৃত্য কেউ পরিবেশন করতে পারে…শিল্প শেষপর্যন্ত সাধকের দুরূহ আঙ্গিক…জহির জীবন দিয়ে বুঝিয়ে গেছেন বড় কাগজের মিনি প্যাক সাহিত্য বা গড়রুচির লেখা কি লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সো-কলড দাদাগিরি নয়…লেখকের অন্তিম কাজ নিজের মতো করে, নিজের স্বরভঙ্গি নিয়ে লিখে চলা! বড় ও ছোট…উভয়ের মৌলবাদই সমান ক্ষতিকর। হীরক রাজার দেশের বৈজ্ঞানিকের মতো লেখকের রক্তভেদী সেই আর্তনাদ, 'আমি একা!' বছরের পর বছর অমিয়ভূষণের মতো লেখককে প্রকাশ না করার জন্য আনন্দবাজার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সুবিমল মিশ্র যেমন বলেছিলেন, 'এরা কি অমিয়ভূষণকে ছাপাবার যোগ্যতা রাখে?' ঠিক একইভাবে বলা যায় আমাদের দেশের একাডেমিসহ বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কি শহীদুল জহিরকে পুরস্কৃত করার যোগ্যতা রাখে? নতুন ভাষা ও নতুন সাহিত্য, নতুন শিল্প ও নব প্রাণস্পন্দন যিনি বা যারা সৃষ্টি করবেন, ভ্যান গগ ও জীবনানন্দ দাশের মতো সমকালের কাঁটার মুকুটই হোক তাদের শ্রেষ্ঠ বিভূষণ! লেখকও কখনো কখনো দোটানায় পড়েন। নৈতিকতার দ্বন্দ্ব। লোভ ও নির্লোভের দ্বন্দ্ব। জীবনানন্দ দাশকেও আক্ষেপ করে ডায়েরিতে লিখতে হয় প্রতিটি 'কুকুর-বিড়ালকে কুর্নিশ করা'র আত্ম-গ্লানির কথা। তবে, শেষপর্যন্ত সত্যিকারের লেখক বা কবির নির্লোভ, রাগী চারিত্র্যই প্রতিষ্ঠা পায় লোভের উপর। তলস্তয়ের ফাদার সিয়ের্গির মতো। সেনাবাহিনীর বড় চাকুরি হতে যাজকবৃত্তি…সব প্রলোভন ছেড়ে ফাদার সিয়ের্গি যেদিন পথের ঝাড়ুদার হলেন…সিয়ের্গি জেনেছিলেন সেদিনই তিনি প্রকৃত সন্ত হতে পেরেছেন!

ঐ তো চৈত্রদিনে সুহাসিনী গ্রামে ধুলার ঝড় উঠছে। ডলু নদীর হাওয়া আমাদের নিঃশ্বাসে। বাংলা গল্পের অজেয় নায়ক আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন চিরদিনের মতো…।

ঢাকা, ২৩-২৮/০৩/০৮