মাহমুদ দারবিশের দীর্ঘ কবিতা ‘অবরোধের কালে’

বদরে মুনীর
Published : 15 August 2008, 10:38 AM
Updated : 15 August 2008, 10:38 AM


ঢিল ছুড়তে গিয়ে ইজরাইলি সেনাদের হাতে ধরা পড়েছে প্যালেস্টাইনি বালক

এখানে, এই পাহাড়ের ঢালে, সন্ধ্যা আর সময়ের কামানের সামনে
ভাঙাচোরা ছায়ার বাগান পাশে রেখে,
আমরা তা-ই করি যা বন্দিদের করণীয়,
আর যা করে বেকারেরা;
আশার আবাদ করি।

একটা দেশ প্রস্তুত হচ্ছে প্রত্যূষের জন্য। আমরা এগোচ্ছি সহজ সরলতায়
কেননা নিকট থেকে দেখতে পাচ্ছি বিজয়ের ক্ষণ:
বোমা বর্ষণের আলোয় জ্বলে না আমাদের কোনও রাত্রি,
শত্রুরা সতর্ক; আমাদের জন্য আলো জ্বালে
কারা প্রকোষ্ঠের অন্ধকারে।

এখানে কোথাও কোনও "আমি" নাই।
এখানে আদম স্মরণ করছে তার কাদার কণিকা।

মৃত্যুর কিনার থেকে আদম বলেন:
হারানোর মতো আর কোনও অবশেষ নাই আমার:
আমি মুক্ত; অবকাশের প্রায় কাছাকাছি।
নিজেরই হাতের মুঠে সমাহিত আমার ভবিষ্যৎ।
শীঘ্রই দেখব আমি আমার জীবন,
জন্ম নেবো মুক্ত, আর পিতামাতাহীন,
এবং যেমন আমার নাম, আমি বেছে নেবো মহানীল অক্ষরসমূহ…

তোমরা যারা দরজায় দাঁড়িয়ে আছো, ভেতরে আসো,
আমাদের সাথে পান করো আরবের কফি
তখন বুঝবে তোমরাও মানুষ আমাদেরই মতো
বাড়ির দোরগোড়ায় যারা দাঁড়িয়ে আছো
আমাদের সকাল থেকে বার হয়ে আসো
আমরা নিশ্চিত হবো তোমাদের মতো আমরাও মানুষ।

যখন বিমানগুলো উধাও, সেই শাদা; শাদা পারাবত
উড়ে যায়, আর মুক্ত ডানায় উজ্জ্বলতা নিয়ে ফের ধুয়ে দেয়
বেহেস্তের গাল, মেঘের ওপারে তার অবাধ দখল!
উচুঁতে, আরও উচুঁতে, সেই শাদা, শাদা পারাবত উড়ে যায়।
হায়, যদি আকাশই কেবল সত্য হ'ত! [দু'টি বোমার মাঝ দিয়ে
চলে যাওয়া একজন বললো আমাকে]

সৈন্যদের পেছনে সাইপ্রেস গাছ আর মিনারগুলো
ভেঙে-পড়া থেকে ঠেকাচ্ছে আকাশকে। সেনারা পেচ্ছাপ করে
ইস্পাতের বেষ্টনীর পিছে — ট্যাঙ্কের সর্তক চোখের ছায়ায় —
আর শরতের দিন তার সোনালি ভ্রমণ শেষে
রোববারের ভিড়-ফুরানো গির্জার মতো প্রশস্ত এক সড়কে পৌঁছায়।


ইজরাইলি ট্যাংকের সামনে প্যালেস্টাইনি বালক

[একজন খুনিকে] যাকে হত্যা করছো, তার মুখটা যদি একবার
ভালো করে দেখতে,
মনে করতে পারতে গ্যাস চেম্বারে তোমার মায়ের মুখ
বন্দুকের ন্যায্যতা থেকে তুমি মুক্তি পেতে,
আর বদলে নিতে পারতে তোমার মন:
আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়ার পথ এটা নয়।

অবরোধ হচ্ছে এক অপেক্ষার কাল
ঝঞ্ঝায় বিক্ষুদ্ধ, ভাঙা মইয়ের ওপরে অপেক্ষা।

আমরা একা, অনেক নিচের তলানির মতো আমরা একা
রঙধনুদের ভ্রমণের জায়গা এটা নয়।

এই বিস্তীর্ণ প্রান্তর শেষে আমাদের ভাইয়েরা রয়েছে।
চমৎকার ভ্রাতৃগণ। তারা আমাদের ভালবাসে। আমাদের দ্যাখে আর কাঁদে।
তারপর, সংগোপনে বলাবলি করে:
"আহ! যদি এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করতো…" তারা বাক্য সম্পূর্ণ করে না:
"আমাদের ত্যাগ ক'রে যেও না, ছেড়ে যেও না, যেও না।"

আমাদের ক্ষয়ক্ষতি: দিনে দুই থেকে আটজন শহীদ।
আর দশজন আহত।
আর বিশটা বাড়ি ধূলিসাৎ।
আর পঞ্চাশটা জলপাই গাছ…
যুক্ত হয়েছে সেই নির্মিতির ত্রুটির সাথে
যা দেখা দেবে কবিতায়, নাটকে এবং অসমাপ্ত ক্যানভাসে।


লেবাননের বৈরুত উপকণ্ঠে শাতিল ক্যাম্পের দেয়ালে এক প্যালেস্টাইনি শিল্পীর আঁকা ছবি

একজন মহিলা মেঘকে বলেছিল: ঢেকে দাও আমার প্রাণের টুকরাকে,
কেননা আমার বস্ত্র ভিজে গেছে ওর রক্তে।

যদি তুমি বৃষ্টি না হ'লে, বাছা রে আমার,
বৃক্ষ হও,
উর্বরতার তৃপ্তিতে বৃক্ষ হও;
যদি তুমি বৃক্ষ না হলে, সোনামনি,
পাথর হও,
আর্দ্রতায় ঘনীভূত, পাথর হও,
যদি তুমি পাথর না-হ'লে, প্রিয় পুত্র,
চাঁদ হও,
প্রেয়সীর স্বপ্নে তুমি চাঁদ হও।
[এরকমই বলেছিল এক মহিলা তার পুত্রের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়]

ও প্রহরীরা! তোমাদের ক্লান্তি লাগে না,
আমাদের প্রতিদিনের পথে ওঁৎ পেতে থাকতে,
আমাদের ক্ষতে ফোঁটা গোলাপের ভাস্বরতা
তোমাদের ক্লান্ত করে না, ও প্রহরীরা?

এই অবিমিশ্র, নীল অসীমের
সামান্যই যথেষ্ট
সময়ের সব বোঝা হাল্কা করে দিতে,
মাটির সমস্ত ময়লা ধুয়ে মুছে দিতে।

অহমের শৃঙ্গ থেকে নেমে আসা আত্মার দায়িত্ব;
আর রেশমি পায়ে চলা পথে, আমার পাশাপাশি,
হাতে হাত রেখে, দীর্ঘদিনের দুই বন্ধুর মতো —
যারা ভাগ করে খায় পুরাতন রুটি,
আর প্রাচীন গ্লাসের মদ —
এই পথে আমরা হেঁটে যেতে পারি একসাথে
এবং তখনই আমাদের দিন পাবে নব দিকনির্দেশনা:
আমি সেদিন, স্বভাবের বাইরে, একটা উঁচু পাথরকেই
হাঁটু মুড়ে বসার জন্য বেছে নেবো।

আমার খোয়া-বিছানো উঠানে সবুজ হচ্ছে ছায়া,
আর আমার ভেড়ার গায়ে ঘুমে ঢলে পড়ছে নেকড়ে
সে স্বপ্ন দেখে যেমন দেখি আমি, যেমন ফেরেস্তা দেখে —
জীবন এখানে… ওখানে নয়।

অবরুদ্ধতার কালে সময় পরিণত মহাশূন্যে,
যে শূন্য নিবদ্ধ তার অনন্ত সময়ে,
নিষেধাজ্ঞার নিচে স্থান পরিণত কালে
যে কাল হারিয়েছে তার অতীত-ভবিষ্যৎ।

জীবনের প্রতিটা নতুন দিনে, প্রতিটা ক্ষণে শহীদের আত্মা
আমাকে ঘিরে ঘোরে, আমাকে জিজ্ঞাসা করে:
কোথায় ছিলে তুমি? আমাকে দেয়া তোমার প্রতিটা শব্দ
তুমি ফিরিয়ে নাও অভিধানে,
আর বাচাল ঘ্যানঘ্যান থেকে নিদ্রিতদের দাও উদ্ধার।

শহীদ আমাকে আলোকিত করে: ওই প্রান্তরের ওপারে আমি তাকাইনি,
অমরত্বের শুদ্ধতার জন্য,
কেননা এই পৃথিবীর ফিগ আর পাইন গাছের ছায়ায় আমি ভালোবাসি
জীবনকে

কিন্তু আমি সেখানে পৌঁছুতে পারি না,
এবং তখনও, আমি চাই, আমার সর্বস্ব দিয়ে,
নীলিমায় প্রবাহিত রক্তের ধারায় আমি জীবনকে ছুঁতে চাই।

শহীদ সতর্ক করে আমাকে: ওদের একটানা কান্নায় বিশ্বাস করো না।
আমার বাবাকে বিশ্বাস করো, যখন সে আমার ছবির দিকে তাকিয়ে কাঁদে…
কেমন করে আমরা কাজ করতাম, বাছাধন, কেমন করে তুমি আমাকে
টপকে যেতে —
আমি আগে, আমি আগে, আমিই প্রথম!

শহীদ আমাকে ঘিরে রাখে: আমার আবাস
আর আমার অশোভন আসবাব, সবই বদলে ফেলেছি,
বিছানায় রেখেছি একটা চপল হরিণ,
আর দুঃখ দমনের জন্য আঙুলে রেখেছি চাঁদের অর্ধেক।

এই অবরোধ চলবে, যতক্ষণ না আমরা অনুগত হই,
আমাদের মেনে নিতে হবে সেই দাসত্ব, যা ক্ষতি করবে না, পূর্ণ স্বাধীনতায়!

প্রতিরোধ মানে কারও হৃদয়ের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা,
অণ্ডকোষের স্বাস্থ্য এবং তোমার নাছোড়বান্দা অসুখ:
আশার অসুখ।

আর কোথায় অবশিষ্ট সকাল রয়েছে, আমার বাইরে আমি হেঁটে যাই,
আর কোথায় রাত্রির অবশিষ্ট আছে, আমার ভেতরে শুনি পদধ্বনি।

তাকে অভিনন্দন, যে আমার সাথে মনোযোগ দেবে আলোর মাতলামিতে,
প্রজাপতির মাতাল আলোয়,
এই সুড়ঙ্গের অন্ধকারে।

অভিনন্দন তাকে —
পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ঘনীভূত রাতে,
যে ভাগ করে নেবে আমার গেলাশ।
অভিনন্দন আমার প্রেতাত্মাকে।

আমার বন্ধুরা সর্বদা আমার জন্য বিদায় ভোজের প্রস্তুতি নিচ্ছে,
ওক গাছের ছায়ায় একটা শান্ত কবর,
পাথরের একটা সমাধিফলক
এবং আমি বরাবরই অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানে তাদের কামনা করি:
তাহলে মরেছে কে… কে?

লেখালেখি একটা কুত্তার বাচ্চা, যা শুধু শূন্যতাকে কামড়ায়
লেখালেখি এমন জখম করে, রক্তের দাগটাও থাকে না।

আমাদের কফির পেয়ালা। নীলচে ছায়ায় পাখি, সবুজ বৃক্ষাদি,
একটা হরিণের মতো সূর্য নেচে বেড়ায় এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়ালে
আমাদের জন্য আকাশের যা কিছু রয়েছে, তা কেবল
মেঘের ভেতর জলের অনিঃশেষ আকৃতি।
আর অপসৃত স্মৃতিদের টুকরা-টাকরা বলে দিচ্ছে
এই সকাল শক্তিময়, দীপ্তিমান;
এবং আমরা অতিথি, অনন্তকালের।

Under Siege কবিতা থেকে অনূদিত

অনুবাদ: বদরে মুনীর