পাকিস্তানিরা ইতিহাসের মুখোমুখি হতে ভয় পায় কেন?

মোহাম্মদ সেলিম
Published : 24 Dec 2010, 08:41 AM
Updated : 24 Dec 2010, 08:41 AM

বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পর্কে পাকিস্তানের পাঠ্যপুস্তুকে বিকৃত ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে। এতে বিস্মিত হয়েছি বললে ঠিক বলা হবে না। কারণ হিংসা, সাম্প্রদায়িকতা থেকে যে রাষ্ট্রের জন্ম সেখানে বিকৃতি, বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্র জায়গা করে নেবে এটাই স্বাভাবিক।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্যক্তিজীবনে ধার্মিক না হলেও, ধর্মকেই বেছে নিয়েছিলেন রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া সত্বেও কেবল ধর্মকে জাতীয়তার প্রধান নিয়ামক বলে গ্রহণ করলেন।

'লড়কে লেঙ্গে' পাকিস্তানের তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে উপস্থাপন করলেন তথ্যকথিত দ্বিজাতি তত্ত্ব। এই তত্ত্বের অসারতা প্রমাণিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে। জিন্নাহ তাঁর তত্ত্বে ভারতের হিন্দু-মুসলমান দুটি পৃথক জাতি প্রমাণের' লক্ষ্যে কিছু কৃত্রিম, ঠুনকো বিষয় সামনে নিয়ে আসেন।

যেমন মুসলমানরা সালাম জানায়, মৃতদেহ কবর দেয়, দাঁড়ি রাখে। পানি, আব্বা, আম্মা বলে ইত্যাদি, আর হিন্দু সম্প্রদায় নমস্কার করে। মৃতদেহ দাহ করে, টিকি রাখে, জল, বাবা, মা বলে ইত্যাদি। এগুলো যে খুব যুক্তিগ্রাহ্য, তা কিন্তু নয়। কিন্তু ধর্মীয় আবেগ, উত্তেজনা যুক্তিবোধ নির্বাসন দিয়েছিল সেদিন। কবীর চৌধুরী লিখেছেন যে, 'আসলে হিন্দু ও মুসলমান দুটি জাতি নয়, এক তাৎপর্যপূর্ণ অর্থে দুটি জাতি হল শোষক আর শোষিত। লড়াইটা হওয়া উচিত ছিল শোষিত হিন্দু-মুসলিম মিলিত জনগোষ্ঠী দ্বারা ইংরেজ শাসক ও হিন্দু-মুসলিম শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। কিন্তু তা হয়নি।'

অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা ব্যাখ্যা করা হয়েছে সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি-তত্ত্বের আলোকে। এর ফল পাকিস্তানের জন্য শুভ হয়নি। ১৯৪৭-১৯৭১ পাকিস্তানের ইতিহাস-বিভেদ, অনৈক্য আর শোষণের ইতিহাস। জিন্নাহ পাকিস্তান অর্জনের জন্য হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচার করেছেন, আর পাকিস্তান লাভের পর ঘৃণা-বিদ্বেষ গিয়ে পড়ল বাঙালির ওপর। অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাঙালি মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল আর মুসলিম লীগও গঠিত হয়েছিল ঢাকার মাটিতে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি শোষণ-নিপীড়নের শিকার হল পশ্চিমাদের হাতে।

যে কোনো ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন-সংগ্রাম দেখেছে হিন্দুদের প্ররোচনা আর ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবে। হিন্দু তথা ভারতের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর মুসলমান শাসকদের শৌর্য-বীর্যের গর্বিত উত্তরাধিকার হিসেবে গড়ে উঠেছে পাকিস্তানের ইতিহাস তত্ত্ব।

দুর্ভাগ্যজনক হল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পরেও পাকিস্তানের ইতিহাসতত্ত্বে পরিবর্তন আসেনি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে কী বর্বর গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আর ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ জানতে পারেনি। এত বছর পরেও পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশ সম্পর্কে বিকৃত ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে।

নবম ও দশম শ্রেণির পাকিস্তান স্টাডিজ গ্রন্থে লেখা হয়েছে, 'ওই সময়ে (১৯৭১ সালে) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের একটি বড় অংশ ছিলেন হিন্দু। তাঁরা এমন সব সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন, যা বাঙালিদের মনে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছিল।'

পাকিস্তান সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতির কারণে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তদের একটা বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধের অনেক পূর্বেই ভারতে চলে যায়। বিশেষভাবে বিভিন্ন সময়ের দাঙ্গা আর পাক ভারত যুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হিন্দু শিক্ষকগণ দেশত্যাগে বাধ্য হন। মূল সমস্যা হল, পাকিস্তানিরা ইতিহাসের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। তথাকথিত হিন্দু লেখকদের সাহিত্য বাঙালিদের পর্যন্ত শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, বৈষম্য আর যে কোনো উপায়ে বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা বিদ্বেষ-বঞ্চনার জন্ম দিয়েছে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকে দায়ী করে পাকিস্তানি পাঠ্যপুস্তকে লেখা হয়েছে, "পূর্ব পাকিস্তানে তখন ছিল প্রায় এক কোটি হিন্দুর বাস। তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য তাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিল ভারত। হিন্দুদের অর্থনৈতিক অবস্থান মজবুত করতে ভারতই চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে। অনেক হিন্দু ভারতের পক্ষে গুপ্তচরের কাজ করেছে।''

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে 'গৃহযুদ্ধ' ও'বিচ্ছিন্নতাবাদী' আন্দোলন হিসেবে প্রচার চালায়। আর মুক্তিযোদ্ধারা ছিল 'দুষ্কৃতিকারী' বা ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার জন্য হুঁশিয়ার করে দেয়। ইয়াহিয়া মুক্তিযুদ্ধকে পাক-ভারত ইস্যুতে পরিণত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কারণ পশ্চিমা গণমাধ্যমে পাকবাহিনীর গণহত্যা, নির্যাতনের লোমহর্ষক কাহিনি সভ্য দুনিয়ায় তাদের মুখোশ খুলে দেয়।

পাকিস্তান পাঠ্যপুস্তকে ভারত ব্যতীত রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকেও দায়ী করা হয় তথ্যকথিত 'ষড়যন্ত্রের' জন্য। লেখা হয়েছে, 'রাশিয়া ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে; কেননা পাকিস্তান তাদের ভূমিতে যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে দিয়েছিল। আবার যুক্তরাষ্ট্রও চাইছিল, পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হোক। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের আগ্রাসনে প্রকাশ্যে সমর্থন দেয় রাশিয়া।'

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মুসলিম বিশ্ব পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। যুক্তরাষ্ট্র তার নাগরিকদের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দেয় পাকিস্তানকে। চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির একাধিক প্রস্তাব উত্থাপন করে পাকিস্তানের পক্ষে। রাশিয়ার ভেটোর কারণে মার্কিন উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।

পাকিস্তানিরা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য সমস্ত দায় চাপিয়ে দিচ্ছে অন্যদের ওপর। গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের দায় কে নেবে? পাকবাহিনী কীভাবে এই কলঙ্ক থেকে মুক্ত হবে? পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান। দুই দেশ পরস্পরকে স্বীকৃতি দিয়েছে ১৯৭৪ সালে। দুর্ভাগ্যজনক হল, এত বছরেও পাকিস্তানিরা ইতিহাসের পাঠ গ্রহণে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এখনও মিথ্যাচার আর বিকৃতির বেড়াজালে বন্দি। স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মনে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এই বিকৃত মানসিকতা থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসতে হবে।