রাসলীলা প্রত্যক্ষণ

saymon_zakaria
Published : 8 Nov 2008, 04:54 AM
Updated : 8 Nov 2008, 04:54 AM

[আগামী ১৩ নভেম্বর রাসপূর্ণিমা। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষ্ণ, চৈতন্য ও বৈষ্ণবভক্ত মানুষেরা এই পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে বিভিন্নভাবে রাসলীলা উদযাপন করে থাকেন। রাসলীলা উদযাপনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে এদেশের মণিপুরী জনগোষ্ঠীর। রাসপূর্ণিমাকে শরণে রেখে বৃহত্তর পাঠক-ভক্তদের উদ্দেশ্যে অত্র প্রবন্ধটি মুদ্রণ করা হলো।]


মৈতৈ মণিপুরি রাসলীলার নিপাপালয় পুঙবাদকগণ রাসধারীদের মুখোমুখি।

প্রথম কয়েক বছর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার মাধবপুর গ্রামের জোড়মণ্ডপের মণিপুরি রাস উৎসবে যোগ দিয়ে হয়ে উঠেছিলাম মুগ্ধ আর বিস্মিত দর্শকমাত্র। তবে, সেই বিস্ময় আর মুগ্ধতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা বঙ্গীয় লীলার আনন্দ অনুভব করা প্রথম দর্শনে সত্যি দুষ্কর হয়ে পড়ে। তাই
—————————————————————–
মণিপুরীদের রাসলীলার উৎসবের পোশাক-পরিচ্ছদে, নৃত্যে-গীতে এবং মঞ্চ-অলঙ্করণে যে রাজকীয় গাম্ভীর্য দৃষ্ট হয় তা আমাদের দেশের অন্য কোনো সাংস্কৃতিক পরিবেশনার কোথাও দেখা যায় না। … লোককথায় বলা হয়েছে, আধুনিককালে রাস প্রচলন করেন মণিপুরী রাজা ভাগ্যচন্দ্র আর রাজা ভাগ্যচন্দ্র নিজেও নাকি রাসের পোশাক পরে নেচেছিলেন। অতএব, রাসের জন্ম হয়েছে রাজদরবারে। কিন্তু তাকে গ্রহণ করে নিয়েছেন সাধারণ মণিপুরী জনগণ।
—————————————————————-
কেবলই মুগ্ধতা-বিস্ময়ে বারবার ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি পাশাপাশি অবস্থান নেওয়া তিন তিনটি মণ্ডপের রাসনৃত্য। প্রথমদিকে মণিপুরী পল্লীর তেমন

…….
বিষ্ণুপ্রিয়া রাসলীলার নৃত্যভঙ্গিমা।
……..
কারো সাথে পরিচয়ও ছিল না, এক শুভাশিস সিনহা আর তাদের পরিবারের সদস্য এবং কয়েকজন প্রতিবেশী ভিন্ন। পরবর্তীতে অনেকের সাথে ভাব জমে ওঠে, শুভাশিসদের বাড়ি হয়ে ওঠে নিজের বাড়ি। আর মণিপুরীদের গ্রামগুলো যেন হয়ে যায় নিজের গ্রাম। সেই থেকে রাসের আসল রসাস্বাদন আমার পক্ষে একটুখানি সহজ হয়ে দেখা দেয়। বুঝতে পারি রাসলীলা আসলে মানুষের প্রতীকে পরম পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির চিরন্তন লীলা। অন্যদিকে রাসের নাটকীয় গুণসমূহও আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর এটা ঘটে কয়েক বছর ধরে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে রাসলীলা পর্যবেক্ষণ করার পর। পরবর্তীতে আরো দুই বছর আদমপুর গ্রামে মৈতৈ মণিপুরিদের রাস পর্যবেক্ষণ করে পুরো মণিপুরি জনগোষ্ঠীর রাসলীলার বৈচিত্র্য আরো স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করি। বর্তমান লেখায় বিষ্ণুপ্রিয়া রাসলীলা ও মৈতৈ রাসলীলার বর্ণনা আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হলো।

বিষ্ণুপ্রিয়া রাসলীলা

বৃন্দাবনে কী প্রকারে শিশু ভগবান তার গোষ্ঠলীলা সম্ভব করেছিলেন দেখিনি, কিন্তু ঢের দেখা হলো এ দেশের মণিপুরি শিশুদের গোষ্ঠলীলা। কীভাবে, কেমন করে মণিপুরি শিশুরা গোষ্ঠের জন্য সাজে, নাচে, গান করে এবং অভিনয়ে অংশ নেয়, একবারে তার সবটা দেখা সম্ভব নয়। ফলে মণিপুরিদের রাস উৎসব দেখতে বেশ কয়েকবার মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার আদমপুর, মাধবপুর, ঘোড়ামারা প্রভৃতি গ্রামে যেতে হয়েছে। প্রতিবারই আশ্রয় নিয়েছি লালমোহন সিংহের স্নেহের নিচে। এ যাত্রার একদিন আগেই পৌঁছে গেলাম তাঁর উঠানে, কারণ গোষ্ঠলীলার রাখালদের এবারে আমি একেবারে সকাল থেকেই চোখে চোখে রাখতে চাই। উপরি হিসেবে রাতের উঠানে মণিপুরী ভাষায় নাটকের মহড়া দেখে মনে মনে শুভাশিস সিনহাকে ধন্যবাদ দিই। সে রাতেই এবারের শীতের প্রথম লেপ উঠল গায়ে।

সকালে ধলাই নদীর পাড় ধরে ঘোড়ামারা থেকে হেঁটে রাখালনৃত্যের গোষ্ঠক্ষেত্র মাধবপুর শিববাজার কদমতলায় এসে দেখি কলাগাছের ঘের দিয়ে রাখালনৃত্যের জন্য তিনটি মণ্ডলাকার উঠান তৈরি করে রাখা হয়েছে। প্রতিটি উঠানের কেন্দ্রস্থলে একটি করে কদমগাছ, তাই স্থানটির নাম বলি কদমতলা। আমার সঙ্গী কেউ নেই, আমি একা, হঠাৎ সুমন সিংহের সাথে দেখা। সুমনকে সঙ্গে নিয়ে একজন রাখালের বাড়ি যেতে চাইলাম।

কবিতা লেখার স্বভাব আছে বলে সুমন আমাকে পাত্তা দিয়ে বেশ কিছুদূর উত্তরে হেঁটে ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে যে বাড়িতে নিয়ে গেল, দেখি সেটা এবারকার রাসের কৃষ্ণ প্রসেনজিৎ সিংহের বাড়ি। আমি তো অবাক, সুমনকে বললাম — 'এটা কি একটু বেশি পাওয়া হয়ে গেল না? যেতে চেয়েছিলাম কৃষ্ণের রাখাল বন্ধুদের বাড়ি, আর তুমি স্বয়ং কৃষ্ণের বাড়ি নিয়ে এলে!' সুমন মৃদু হাসল।


রাসধারীদের আবাহনী গীত চলছে।

লক্ষ্মী সিনহার মাংকোলে বা ঘরের বারান্দার রাখাল বা রাখোয়াল সাজানো হচ্ছে প্রশান্ত সিংহকে। আর কৃষ্ণ সাজানো হচ্ছে প্রসেনজিৎ সিংহকে। একে একে তাদের মাথায় দেওয়া হলো ময়ূরের বহুবর্ণ চ‚ড়া, তার নিচে লাল রঙের লেট্রেং, কপনাম, আর মাথার চ‚ড়া থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে জোড়াফুল, জুড়া বা চুল, গলায় ফুলদান বা মালা পরিয়ে পাঙপঙ বেঁধে দেওয়া হচ্ছে দুই বাহুতে; এরপর একে একে থাবেরেত, থবল, ঘুঙুর, খাড়ু, আঙটি আর পিছনদারীতে তাদের রাজকীয় ভঙ্গিমায় সাজানো হচ্ছে। তাদের এই সাজ-উদ্যোগ শুরু হয়েছে আরো আগে থেকে, তাদের হাতের নখে মেহেদির রঙ দেখে বুঝতে পারি। সকালে তাদের পায়ে আলতা দেওয়া হয়েছে, হাতের তালুও সূর্যের মতো গোল করে আলতা রাঙানো।

সাজ শেষ হলে কৃষ্ণ মণ্ডপে যাবার আগে হাতে বাঁশি তুলে নেন। তারপর বাড়ির ভেতর উঠানের উত্তর-পুব কোণের ছোট ভিটা-বাঁধানো তুলসী গাছের কাছে গিয়ে তিনি ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করেন।

গোষ্ঠের জন্য ঢের বেলা হয়েছে। সূর্য প্রায় কপাল অতিক্রম করতে চাইছে। কৃষ্ণের পায়ে তাই অনেক তাড়া, কৃষ্ণ গোষ্ঠের জন্য বাঁশি হাতে মায়ের হাত ধরে হাঁটছে বেশ দ্রুত। সে দ্রুততায় আমাকে দৌড়ে পথ চলতে হয়। তবুও পিচঢালা পথ দিয়ে শিশুকৃষ্ণের খালি পায়ে হেঁটে পোষাল না, সে উঠে বসল রিকশায়। আমি মনে মনে হাসি, 'হালের কৃষ্ণ রিকশায় উঠেছে!' সে হাসির মধ্যে কৃষ্ণ আমাকে ফাঁকি দিয়ে জোড়মণ্ডপে গিয়ে হাজির হয়, আমি পড়ি-মরি করে তার কয়েক মুহূর্ত পরে জোড়মন্দিরে গিয়ে পৌঁছাই।

জোড়মণ্ডপে গিয়ে কৃষ্ণ তার আসনে গিয়ে বসে। পাশে মৃদঙ্গ-করতাল বাদক এবং মা যশোদারূপী দুজন নারী। এর মধ্যে লক্ষ করা যায়, আরেকজন কৃষ্ণ এসে আমাদের কৃষ্ণের পাশে বসে। এবার পূর্ণ হলো জোড়মণ্ডপের দুজন কৃষ্ণ এবং দুজন যশোদা মায়ের আত্মপ্রকাশ। তার আগে থেকেই বাদ্যকর-গাহকেরা বন্দনায় কৃষ্ণকে ডেকে চলছিল আকুল হয়ে — 'এসো হে কানাই এসো। বলি বারে বারে।'

পুরুষবাদ্যকর গাহকদের এমন রাগালাপ বন্দনার আকুতির মাঝখানে মৃদঙ্গ ও করতাল ভিন্ন একটি তান খুঁজে নিলো এই বন্দনার বাকি কথা:

'নন্দেরও নন্দ।
কৃপা করে আইসো যত সঙ্গী সঙ্গে।
তোমায় ছাড়া কেহ নাই।
কাকে ডেকে কাকে পাই
না আসিলে তুমি বিনে কানাই
মরণদশা হয়ে যায়।'

এমন বন্দনাগীতে কোনো কোনো নারী কান্নার আবেগে আসরে ছুটে এসে শিশু কৃষ্ণদ্বয়ের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। আসর থেকে অন্য কেউ এসে তাকে উঠিয়ে ভক্তদের মধ্যে নিয়ে যায়।

এবারে বন্দনাগীত শেষে বাঁশি হাতে দুই-দুইজন করে মোট চারজন সখা এসে কৃষ্ণ ও যশোদার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে শিশুদের ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বাদ্যের সঙ্গে বলতে থাকে — 'চলো গোষ্ঠে। চলো গো কানাই…।'

তাদের কথায় কৃষ্ণদ্বয় বাদ্যের সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেয় — 'আর যাবো না গোষ্ঠে। মাতার কথার বোল বলে। পিতার কথার বোল বলে। বলি আমি গোষ্ঠে আর যাবো না।'

কৃষ্ণের এ কথার সঙ্গে কৃষ্ণকে গোষ্ঠে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডাকতে আসা সখাদের উদ্দেশে এবারে মা যশোদাও গেয়ে ওঠেন — 'তোমরা যাও হে। আর গোপাল দিবো না গোষ্ঠে। গোপাল গেলে গোষ্ঠে কানু যাবে তোদের সাথে। কানু বিনে কি করিমুরে। তোমরা যাও হে। কানু বিনে রইমু কেমনে?'

মা যশোদা কৃষ্ণের সখাদের ফিরিয়ে দিতে চাইছে, প্রিয়পুত্র কৃষ্ণকে নিজের কাছে আগলে রাখার জন্য। কিন্তু সখারা তো ফিরতে আসেনি, তারা কৃষ্ণ ছাড়া গোষ্ঠে যাবে কীভাবে? গোষ্ঠের মূল যে স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ। অতএব কৃষ্ণ বিনা কি গোষ্ঠে যাওয়া যায়? সখারা তাই মা যশোদার মিনতিতে পাল্টা গেয়ে উঠল — 'শোনো বলি এবার। কানাই বিনা কেমনে যাই। গোষ্ঠে যেতে মোরা সবাই। কানাই সঙ্গে নিতে চাই। গোষ্ঠে কানাই বাঁশি বাজায়। আমরা সবাই ধেনু চরাই। কানাই বিনে গোষ্ঠ কেমনে হয়। কানাই বিনে কেমনে মোরা যাই…!'

সখাদের এমন দাবির প্রত্যুত্তরে মা যশোদা এবারে মাতৃত্বের যুক্তি দেখাতে চাইছেন — 'তোরা গোষ্ঠে যাবি যা। যারে সবাই যা। কানুকে আর দেবো না আমি গোষ্ঠে যেতে। মরি মরি বিরহের ভাবনায়। তাই বলি শোনরে সবাই। মায়ের কানু দূরে গেলে। অন্তর কেঁদে মরে। কানুকে তাই দেবো না আর গোষ্ঠে আমি যেতে…।'

এতক্ষণ যশোদা মায়ের সঙ্গে কৃষ্ণসখাদের কথা চলছিল। এবারে কৃষ্ণ কথা বলে উঠল। সখাদের আকুতি আর গোষ্ঠের স্মৃতি এবার তাকে জাগিয়ে দিয়েছে, তাই সে গেয়ে উঠল — 'মাগো মা তোর চরণ ধরি। গোষ্ঠে যাইতে বিদায় দে মা জননী। এই মিনতি করি গোষ্ঠে আমি যাবো মাগো। সত্য আমি যাবো শ্রীদাম ও সুধাম সঙ্গে ধেনু চরাবো।'

কৃষ্ণের এমন কথায় মা যশোদা পরম আকুতিতে কান্নার সুরে গেয়ে ওঠেন — 'বাছা কী কথা শুনাইলে আমারে। বিনা মেঘে বজ্রা ঘাত হয়েছে অন্তরে। কানাইরে কী কথা শুনাইলে আমারে…।

মায়ের এমন কান্না মেশানো কথা ও গানের মধ্যে কৃষ্ণের চোখের জল গড়িয়ে পড়ার কথা। তাই সে সময় মা যশোদা কৃষ্ণকে গোষ্ঠে না যাবার পক্ষে পুরাণ কাহিনী থেকে দৃষ্টান্ত টেনে গাইতে শুরু করেন — 'না কাইন্দো না কাইন্দো বাপও। পূর্বের কথা করগো স্মরণ। পূর্বে তো দশরথও নামে ছিলেনও রাজন। মাতারও বাক্যে পুত্র পাঠায়ে কানন। পুত্র শোকে দশরথও ত্যাজিলও জীবন। রামকে মাতা বনেতে দিয়ে। ওই দশরথও মইলো শোকে। পূর্বের সেই কথা হইলো আমারও মনে।'

তবুও মায়ের পক্ষে কৃষ্ণকে গৃহে আগলে রাখা সম্ভব হয় না। তাই তিনি কৃষ্ণকে মনের মতো করে সাজিয়ে দিতে থাকেন। এক্ষেত্রে একটি বর্ণনাত্মক গীতের ভেতর দিয়ে বাদ্যযন্ত্রী-গায়কগণ আখ্যানকে গোষ্ঠের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান — 'ওই কান্দিয়া কান্দিয়া মা রে ওই বেশর সাজাইল। ওই মস্তকে পরাইল চূড়া গলে বনমালা। ওই হস্তেতে মোহনও বাঁশি ওই চরণে নূপুরও। ওই ললাটেতে পরাই চন্দনও ওই নয়ানে কাজলও। ওই শ্রীচরণে পরাইল ওই সোনারও নূপুরও। ওই রূপ হেরি রূপ দেখি নাচিতে লাগিল। নবীনও কালো কেশে রাঙতা লাগাইল।

এ পর্যায়ে আসর থেকে বেশ কয়েকজন নারী এসে কৃষ্ণের পায়ের কাছে কান্নায় গড়িয়ে পড়ে। তাদের আবেগ তারা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করে কাঁদতে কাঁদতে ভক্তদের আসনে ফিরে যায়। মা যশোদা কৃষ্ণের কথায় এবং তার সখাদের দাবিতে শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণকে গোষ্ঠে যাওয়ার অনুমতি দেন। এ পর্যায়ে গায়কগণ মাতৃস্বরূপা দুই নারীর কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বাদ্য বাদন ছাড়াই টানা টানা গদ্যে রক্ষমন্ত্র পাঠ করেন। উল্লেখ্য, রক্ষমন্ত্রের মধ্যে এক সময় বাদ্যবাদন ও সুর-গীত শুরু হয়। আর লক্ষ করার বিষয় এক্ষেত্রে গীতটি হয়ে ওঠে আখ্যান বর্ণনামূলক। নিচে রক্ষমন্ত্রের সঙ্গে বর্ণনাত্মক গীতটি উদ্ধৃত করা হলো — ছিনু মম বল ভাই কানু বাল কানাই পরিচয়।

…….
পুঙবাদকের বিশেষ বাদনভঙ্গিমা।
…….
এ পর্যায়ে গায়কদের গীতের মধ্যে বাদকগণ তাল প্রয়োগ করেন এবং সে তালের লয় ক্রমাগত বাড়তে থাকে। আর তার মধ্যে কৃষ্ণসহ সকল রাখালের আনন্দনৃত্য শুরু হয়। কেননা, কৃষ্ণকে মা যশোদা গোষ্ঠে যাবার অনুমতি দিয়েছে। রাখালদের আনন্দনৃত্যের মধ্যে মা যশোদা রূপধারিনী সুমধুর স্বরে গেয়ে ওঠেন — অঞ্চলে ধরি ধরি মাও মাও বলিয়ে। প্রাণ রতন বলিয়ে নবীনও শিশু যেন ঘুরে।

এমন গীতি-কথার মধ্যে রাখালনৃত্যকরদের মুখে মা যশোদা-রোহিনী মিষ্টান্ন তুলে দেন। এরপর রাখালগণ কৃষ্ণ-বলরামকে সঙ্গে নিয়ে জোড়মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে পড়েন গোষ্ঠক্ষেত্রের দিকে।

গোষ্ঠলীলার জন্যে শিববাজার কদমতলার মাঠ আগে থেকে প্রস্তুত ছিল। তিনটি জোড়মণ্ডলের তিনজন কৃষ্ণ ও তিন দল রাখাল আলাদাভাবে ছুটে গিয়ে কদমতলার তিনটি গোষ্ঠক্ষেত্রে গোষ্ঠলীলার নৃত্য শুরু করেন।

তাদের নাচের মধ্যে গোষ্ঠক্ষেত্রে নারদ ঋষির আবির্ভাব ঘটে। তার এক হাতে থাকে পীতলের ঘটি ও জল, অন্য হাতে জপমালা, মুখে থাকে পাটের দাঁড়ি-গোঁফ, গায়ে হরিনামের উত্তরীয়, কাঁধে ভিক্ষার ঝোলা, মাথায় চূড়া এবং গলায় মালা। তিনি মনশিক্ষা গান পরিবেশন করেন। আর তার মনশিক্ষার গান শেষ হতেই রাখালনৃত্যের মধ্যে তরবারি হাতে কালো পোশাকে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে গোষ্ঠক্ষেত্রে আসেন কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্ত। শুরু হয় কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্তের সঙ্গে কৃষ্ণ-বলরামের অস্ত্রযুদ্ধ। অস্ত্রযুদ্ধে কৃষ্ণ ও বলরামের হাতে থাকে তীর-ধনুক আর কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্তের হাতে থাকে তরবারি। মৃদঙ্গ ও ঝাঝ বাদ্যের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ অস্ত্রযুদ্ধ চলতে থাকে। বাদ্যের তালে তালে কৃষ্ণ ও বলরামের সঙ্গে কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্তের বাহুযুদ্ধ চলতে থাকে। বাহুযুদ্ধেও কৃষ্ণ-বলরামের কাছে কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্ত পরাস্ত হন। এভাবেই কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্ত কৃষ্ণ-বলরামকে হত্যা করতে এসে শেষপর্যন্ত পরাস্ত হয়ে তাদের চরণে প্রণাম করেন। গোষ্ঠক্ষেত্রে কৃষ্ণ-বলরামকে প্রণাম করে কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্ত চলে যেতেই রাখালদের গতিশীল আনন্দ নৃত্য শুরু হয়। তার মধ্যে এবার আসে দইওয়ালা। তিনি এসে রাখালদেরকে দধি-দুগ্ধ খাইয়ে যান। এর পর পরই গোষ্ঠলীলার পূর্ণাঙ্গ রাখালনৃত্য চলতে থাকে।

রাখালনৃত্যের মধ্যে দেখা যায়, রাখালগণ প্রথমে বাম ও ডান পায়ে তাল ঠুকে ঠুকে কদমগাছকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে নৃত্য পরিবেশন করতে থাকেন। এ ধরনের নৃত্যে পায়ে পায়ে তাল ঠোকার সাথে রাখালদেরকে কোমর থেকে দেহের উপরের অংশ দুই দিকে বাঁকাতে দেখা যায়। এমনভাবে বেশ কিছুক্ষণ নৃত্য করার পর রাখালগণ ভিন্ন প্রকৃতির আরেকটি নৃত্যের সূচনা করেন।

এবার রাখালগণ তাদের এক হাত উন্মুক্ত রেখে অপর হাতটি পরস্পরের কাঁধে স্থাপন করে সার বেঁধে এঁকে বেঁকে ঘুরে নৃত্য পরিবেশন করেন। এই নৃত্যের মধ্যে মৃদঙ্গের তালের সঙ্গে দেহ তুলে রাখালদেরকে লম্ফ দিতে দেখা যায়।

এ ধরনের রাখালনৃত্যের মধ্যে গোষ্ঠক্ষেত্রে উপস্থিত অনেক ভক্ত মুঠো মুঠো বাতাসা ছুঁড়ে দিয়ে রাখালদের দিকে মুখ করে জোড় হাতে চোখ বন্ধ করে মনে মনে মনষ্কামনা করেন। সাধারণত কম বয়সী নারী ও কিশোরীদেরকেই গোষ্ঠলীলায় বাতাসা ছুঁড়ে দিয়ে মনষ্কামনা করতে দেখা যায়।

কিশোরীদের সেই মনষ্কামনার মধ্যে পাশাপাশি তিনটি কদমতলায় নিরবচ্ছিন্নভাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাখালনৃত্য চলে। নৃত্যের বিচিত্র বিচিত্র ভঙ্গিমা এবং একই সঙ্গে গোষ্ঠলীলায় সখাগণ সঙ্গে কৃষ্ণ যে প্রকারের লীলায় মগ্ন হয়েছিলেন পুরাণ কাহিনীতে — তা-ই আজও মণিপুরি সমাজে যথারীতি মেনে পালিত হতে দেখে পুরাণ এবং বাস্তবের মধ্যে বিভেদ হারিয়ে ফেলি। আসলে, রসাস্বাদন করি পুরাণকথার বাস্তব দৃশ্যরূপ। কেননা, রাখালনৃত্যের মধ্যেই দেখি কৃষ্ণ-বলরাম কর্তৃক তৃণাবর্ত নিধন এবং নারদ ঋষি ও দইওয়ালা সঙ্গে কৃষ্ণ-বলরামের নাট্যাভিনয়।

রাখালনৃত্যে সন্ধ্যা হয়ে এলে গোষ্ঠক্ষেত্রে মা যশোদা-রোহিনীর প্রদীপ আরতি শুরু হয় রাখালদেরকে বাড়ি ফিরিয়ে নেবার জন্যে। আর এ আরতিতেই গোষ্ঠলীলায় রাখালনৃত্য শেষ হয়। ঠিক সন্ধ্যায় মা যশোদারূপী একজন নারী একটি কাশার থালায় প্রদীপ জ্বেলে আরতি করতে আসেন গান গাইতে গাইতে:

'আরতি করে তো নোনদো রানী
ও যে ভানুকও মুখও চায়া
আনন্দে গোপালো মুখ হেরি
আরতি করে তো যশোদা রুহিনী।'

এই গানে মা যশোদার আরতিতে খুশিবাক্য লেগে থাকে, তাতে কৃষ্ণ ও তার যত সখা আরতির আলোয় সন্ধ্যায় মায়ের ঘরে ফিরে যায় নৃত্যের ভঙ্গিমাগুলোকে আস্তে আস্তে দেহের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে। সন্ধ্যা এ রকমই, সেই তো দিবা আর রাত্রিকে জোড়া লাগায়। রাখাল বালকেরা ছুটে যায় শিবমন্দিরে। তারা সাত বার শিবমন্দির প্রদক্ষিণ করে গোষ্ঠের পূর্ণাঙ্গ আয়োজন সমাপ্ত করে।

এরপর রাত্রি ১২টার দিকে মাধবপুর গ্রামে পাশাপাশি অবস্থানের তিনটি জোড়মণ্ডপে প্রায় একসঙ্গে মণিপুরীদের রাসলীলার মূলপর্বের সূচনা হয়। সূচনাতেই থাকে প্রতিটি মণ্ডপের প্রবেশপথ ঘেঁষে বাদ্যকর ও গায়েন-দোহারদের সম্মিলিত বাদ্যের ঐকতান। তারপর থাকে সম্মিলিত কণ্ঠে একটি রাগিনী বা রাগাশ্রিত ভক্তিমূলক গান। যার ঠিক পর পরই শুরু হয় রাসলীলার প্রথম অঙ্ক। প্রথমে থাকে আগমনী। আর এই আগমনীতে একটি কিশোরী নাচের পোশাকে সেজে এসে মণ্ডপ প্রণাম করে নৃত্য শুরু করে। আমার পাশে বসা প্রবীণ ও অভিজ্ঞ মণিপুরী ভাগিন্দ্র সিংহ বললেন, 'এই মেয়েটি শ্রীরাধার দূতি বৃন্দা।' বৃন্দা ততক্ষণে তার দুই হাতে নৃত্যের বহুবিধ ভঙ্গিমা করে চলেছে। তার সে হস্ত-নৃত্যের ভঙ্গিমার মধ্যে রাসলীলার গায়েনবৃন্দ আগমনীর সুরে একটি গান গাইতে থাকেন:

'জয় বৃন্দাবন চিন্তামণিধাম। সাজি আইলা বৃন্দাদেবী অতি মনোহর। প্রবোধ দিয়া কই হে বৃন্দা শুন বৃক্ষলতা। জাগি রহ আজু কৃষ্ণ আসিবেন হেথা। কাল বিকাল তোরা না কর বিচার। গোবিন্দ সেবার লাগি প্রকাশ সম্ভার। বৃন্দাদেবী আইলা জ্বালায়ে দেউতি। রতন প্রদীপ লইয়া জ্বালায়ে মোমের বাতি।'

বৃন্দার এমত আগমনী নৃত্য-গীতির মধ্যে মণ্ডপ ঘরে বসা ভক্তেরা তাদের সঙ্গে আনা মিঠাই ছুড়ে মারে মণ্ডপ কেন্দ্রের নৃত্য-কিশোরীর দিকে। কেউ ছুটে গিয়ে সে মিঠাই কুড়িয়ে নিতে থাকে। আর একজন ভক্ত নারী আকুল কান্নায় মণ্ডপে প্রবেশ করে মাটিতে লুটিয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করে। অন্য একজন এসে কিছুক্ষণ পর তাকে টেনে তুলে নিয়ে যায়। এরমধ্যে বৃন্দার আগমনী গীতি-নৃত্য শেষ হয়। এবারে শুরু হয় বৃন্দার প্রদীপ আরতি।

প্রদীপ আরতিতে বৃন্দা দূতির হাতে ধরা প্রদীপের আলোতে চমৎকার এক ঢেউ খেলে যায়। বৃন্দা সে আলোকের ঢেউ খেলানো নৃত্যে ঘুরতে থাকে মণ্ডপ মধ্যবর্তী ছোট একটি গাছকে কেন্দ্র করে। বৃন্দার হাতে প্রদীপের পাত্র হিসেবে কাশার থালা ব্যবহৃত হয়েছে। থালার উপরে প্রদীপ হিসেবে বিভিন্ন বর্ণের মোমবাতি এবং কাদার উপর লোবানকাঠির মতো বাঁশের কাঠি সংযুক্ত করে তাতে আগুন লাগিয়ে প্রদীপ বানানো হয়েছে। বৃন্দার ধেই ধেই মাত্রার নৃত্যের মধ্যে প্রদীপের শিখাগুলোও স্বমহিমায় নৃত্যরত হয়ে ওঠে গায়েনদের গানের সঙ্গে:

'আমি কৃষ্ণের প্রেমে কাঙালিনী। বৃন্দাবনে বৃন্দা দুর্ভাগিনী। এ সুখনিশীথে যমুনা পুলিনে। শ্রীরাসমণ্ডলে আমি যুগল চরণ সেবা করিব। যুগল রূপ নেহারিব জীবন সফল করিব। জনমে জনমে জীবনে মরণ। তনুমনপ্রাণ সপিলু চরণ। অন্তে দিও নাথ ঐ রাঙাচরণ। এ দাসিনী ভিক্ষা মাগি শ্রীচরণ।'

এমত গান শেষে প্রদীপের থালা রেখে বৃন্দা এবারে আবার কিছুক্ষণ তার মুক্ত হাতের নৃত্য করে নেয়। এরপর বাম হাতে একটি কাচের স্বচ্ছ গ্লাস তুলে নেয়। গ্লাসের মধ্যে গোলাপী রঙের পানিতে সুগন্ধি দৃশ্যমান। মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেল বৃন্দার ডান হাতে একটি পাতা-বাহারের পাতা সমেত ডাল এবং বৃন্দা সেই ডালটিকে নৃত্যের মাঝে সুগন্ধি ছেটানোর কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। মণ্ডপের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে সে অপরূপ নৃত্যের ভঙ্গিমায় সুগন্ধি ছেটাতে থাকে পাতাবাহারের বিচিত্রবর্ণের পাতাসমেত শাখা দিয়ে। যেন বৃন্দা এস্থলে অপরূপ এক সুগন্ধিকরী। এরপর সুগন্ধি রেখে বৃন্দার ফুলসংগ্রহ পর্ব। বৃন্দা ফুলের থালা হাতে এবারে যেন নৃত্যের মাঝে ফুলসংগ্রহে বের হয়েছে, সে মণ্ডপের কেন্দ্রে রাখা ফুলগাছ হতে কয়েকটি কাগজের ফুল সংগ্রহ করে। শুধু তা-ই নয়, এবারে বৃন্দা মালা গাঁথবে। তার আগে বৃন্দা ফুলের থালা হাতে কিছুক্ষণ আনন্দনৃত্য করে নেয়। এক্ষণে সে মণ্ডপ জুড়ে কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে এই নৃত্য করে নিয়ে এক স্থানে একটুখানি বসে অভিনয়ের মাধ্যমে সত্যি সত্যি মালা গাঁথে। বৃন্দার এমন মালা গাথার মধ্যে গায়েনরা গান গেয়ে চলেন: 'তুলি ফুল নানা জাতি। চাম্পা ফুল তুলি আনি। গাথব মালা সারাবেলা।'

এইগানের সঙ্গে মালা গাঁথবার পর বৃন্দা যখন তার হাতে একটি বর্ণিল আসন তুলে নেয় তখন গায়েনরা গেয়ে ওঠে একটি সহজ সুর: 'শ্রীরাসমণ্ডলী শোভা অপূর্ব হইলরে। গন্ধে আমোদিত হইল নানা জাতি ফুলরে। সুখে বৃন্দা সজ্জা করে বনমালা।'

বৃন্দা আসন নিয়ে নৃত্যাভিনয় করে করে এক পর্যায়ে মণ্ডপের একস্থানে আসনটি পেতে দেয় এবং আসনে সুগন্ধি ছিটিয়ে নিজে প্রস্থান করে। রাসের প্রথম অঙ্ক বৃন্দার নৃত্যাভিনয় এখানেই শেষ।

এবারে মণ্ডপে বালকরূপী এক কৃষ্ণের আগমন ঘটে। শুরু হয় দ্বিতীয় অঙ্ক। দ্বিতীয় অঙ্কের শুরুতে দেখা যায় কৃষ্ণ আসন করে ঘুমিয়ে আছে। তার একহাতের মুঠোর মধ্যে জরি দিয়ে সজ্জিত একটি বাঁশি। সাজ-সজ্জার দিক দিয়ে আমাদের কৃষ্ণও পিছিয়ে নেই। তার মাথায় ময়ূরের বহুবর্ণ চূড়া, চূড়ার নিচের দিকে লাল রঙের লেট্রেং, কপনাম, শুধু তা-ই নয় মাথার চূড়া থেকে আরো নেমে এসেছে জোড়াফুল, জুড়া বা চুল, গলায় ফুলদান বা মালা। কৃষ্ণের দুই বাহুতে পাঙপঙ বাঁধা; এছাড়া তার আরো আভরণে থাবেরেত, থবল, ঘুঙুর, খাড়ু, আঙটি আর পিছনদারীর রাজকীয় ভঙ্গিমা সব আছে ঠিক ঠিক। ঠিক যেন এই কৃষ্ণ এই কলিতে প্রকৃতপক্ষে সেই সে দ্বাপর থেকেই উঠে এসেছে।

কৃষ্ণের আর ঘুমিয়ে থাকা হয় না সে বাঁশরি হাতে চিন্তা করে: 'যাইতাম কি-না যাইতাম।' তারপর সে উঠে দাঁড়ায় এবং বাঁশরি হাতে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করে। সাথে সাথে গায়েনদের কণ্ঠের গানও বদলে যায়: 'উঠিতে কিশোরী বসিতে কিশোরী। কিশোরী নয়নতারা। কিশোরী ভজন কিশোরী সাধন। কিশোরী গলার মালা।'

এমন গানের কথার মধ্যে আপনার মনের কথার অনুসন্ধান পেয়ে কৃষ্ণ এবারে নেচে ওঠে। তার নাচের মধ্যে মৃদঙ্গ-করতালে নব আনন্দ জাগে। একসময় কৃষ্ণ তার নৃত্য সাঙ্গ করে বৃন্দার রেখে যাওয়া আসন অধিকার করে। এভাবে কৃষ্ণ আসনে আসীন হলে রাসের দ্বিতীয় অঙ্কের সমাপ্তি হয়।

রাসের তৃতীয় অঙ্ক থাকে রাধা ও তার সখিদের দখলে। আগের অঙ্কে কৃষ্ণ আসনে আসীন হলে সখিগণ দল বেঁধে রাধাকে নিয়ে গীতি-নৃত্যে মণ্ডপে প্রবেশ করে। এটা এক মনোরম দৃশ্য। গায়েনদের সঙ্গে এই অঙ্কে যেন-বা নৃত্যরতা প্রতিটি সখির কণ্ঠেই সুরের গান গীত হতে থাকে। বলা হয়ে থাকে এটি হচ্ছে: 'রাধা ও তার সখিদের আগমন গীত।' এই গীতের মধ্যে অসংখ্য সখির সঙ্গে রাধার নৃত্য-গীত চলতে থাকে দীর্ঘক্ষণ। রাসলীলার পঞ্চাঙ্কের মধ্যে সময় ও রসের হিসেবে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং আকর্ষণীয় অঙ্ক হচ্ছে এই রাধা ও তার সখিদের আগমন অঙ্ক। এই অঙ্কে সখিদের এক একটি দল আলাদা আলাদাভাবে এবং শেষ পর্যায়ে একসঙ্গে রাধাকে ঘিরে ধরে নৃত্য-গীত করতে থাকে। রাধাকে ঘিরে তাদের মুখে একাধিক গান গীত হয়। রাধাকে নিয়ে সখিদের মণ্ডপে আগমনের নৃত্যানন্দ দিয়ে রাসের তৃতীয় অঙ্কের সমাপ্তি হয়।

এবারে চতুর্থ অঙ্কে মণ্ডপে আগত সখিগণ রাধাকে কৃষ্ণের সঙ্গে তার সাক্ষাতের কথা বোঝায়। রাধিকা তখন কৃষ্ণের কথায় ব্যাকুলতা প্রকাশ করে এবং সখিদের সঙ্গে কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে নৃত্যে সম্মুখযাত্রার সূচনা করেন। এই সম্মুখযাত্রায় রাধা কৃষ্ণবিরহে ব্যাকুল হয়ে দ্রুতপদে যাত্রা শুরু করতে চায়। সখিদের সঙ্গে রাধাকে ব্যাকুলতা পরিহার করে পথে ধীরে চলতে হয়। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ তাকে আর কৃষ্ণব্যাকুল হয়ে পথ চলতে হয়নি। সখিদের সঙ্গে রাধার ধীরে ধীরে পথ চলতে চলতে দলীয় নৃত্যে রাসের চতুর্থ অঙ্ক সমাপ্ত হয়।

এবারে আসে পূর্ণাঙ্গ রাসলীলার শেষ অঙ্ক মানে পঞ্চম অঙ্ক। এই অঙ্কের শুরুতেই রাধা যখন সখিসঙ্গে কৃষ্ণের সামনে এসে দাঁড়ায় তখন কৃষ্ণ তাকে প্রশ্ন করে: 'কোন কারণে আইছো বৃন্দাবনে। গভীর-নিঘোর রাতে।' উত্তরে রাধারাণী লজ্জা পেয়ে যায়। আর সখিগণ রাধার হয়ে কৃষ্ণের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চায়। কৃষ্ণ তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে প্রসন্ন বদনে এবারে রাধার দিকে দৃষ্টি দেয়। রাধারাণী সে দৃষ্টিতে আনন্দিত হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে তারা তখন যুগল মূরতিতে প্রকাশ পায়। আর এমন যুগল মূরতিতে রাধা-কৃষ্ণ নিজেরা দু'জনে যেমন আনন্দিত হয়, তেমনি আনন্দিত হয় মিলন সংঘটনের সঙ্গী সখিগণ। তারা আনন্দ নৃত্যে রাধা-কৃষ্ণকে ঘিরে ধরে সম্মিলিতভাবে গীত করে: 'জয় যুগল কিশোরী। আরতি করি গাওত ব্রজনারী। এই সেন যুগল আরতি করত। জয় যুগল কিশোরী।'

এই আনন্দ গীতি-নৃত্যের মধ্যে রাধা-কৃষ্ণ যুগল মূর্তি ধারণ করে। আর আসরের শত শত ভক্ত এসে তাদের পায়ে প্রণাম দিয়ে যেতে থাকে। ততক্ষণে সারারাত্রি সকালের আকাশ পানে তাকিয়ে আলোকে নিজেকে হারাতে শুরু করে এবং সমাপ্ত হয় একটি রাতের পূর্ণাঙ্গ বিষ্ণুপ্রিয়া রাসলীলা।

মৈতৈ রাসলীলা

একই দিন একই রাতে মাধবপুরের কাছেই অবস্থিত আদমপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত হয় মৈতৈ রাসলীলা। মৈতৈদের আদমপুর গ্রামে গিয়ে পরিচয় হয় থোঙাম সঞ্জীবের সঙ্গে। তার বাড়িতে গিয়ে দেখি — সুমাঙে বা উঠানে তখন গোপ ভোজনের প্রস্তুতি চলছে। সারা সুমাঙে সার ধরে পেতে দেওয়া হয়েছে লা (কলার পাতা)। তারপর লা'র উপর একে একে সাজিয়ে দেওয়া হলো চাক (ভাত), সিনজু, আমেটপা, নঙঠঙ, খামেন বাজা (বেগুন ভাজা), সাগুলাই (মাসকালাই), মটর থোঙবা, মাঙগম ক্ষীর (পায়েস) ইত্যাদি। এভাবে ভোজনপাত্র লা সাজানো হলে ঘর থেকে লাই লেঙনাঙকপা বা গোপালের মূর্তি বের করে আনা হয়। এরপর হাইরুক পেইসা (ফুল-পয়সা), ইসিঙ তেঙগৎ (পানি পাত্রে পানি) এনে গোপাল মূর্তিকে একটি কাপড়ের উপর রেখে আরতি দেওয়া হয়। এ সময় শ্রীকৃষ্ণের আরতি গান পরিবেশন করা হয়। গোপ ভোজনের আগে আরতিতে বাজানো হয় বাদ্যযন্ত্র মাঙগঙ (বড় করতাল), কাঙসি (কাসা) ও পুঙ (মৃদঙ্গ)। এইসব বাদ্য বাদন ও আরতি গান পরিবেশনের জন্যে নিমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে চিঙথাম নাতেক শিল্পীম্প্রদায়কে।

……..
মৈতৈ রাসলীলার নৃত্যভঙ্গিমা।
……..
দলের ইসাইসাকপা বা মূলগায়ক নাতেক-এর নাম অনুযায়ী এই শিল্পী সম্প্রদায়ের নাম। এই দলের অন্যান্য সদস্যরা হলেন — দোহার (দ্বিতীয় গায়ক) শৈবম সামদেন, খমবাঙতম (তৃতীয় গায়ক) ঙওবি বা নৌবি, পুঙজেইবা (মৃদঙ্গবাদক) চন্দ্রমোহন। এই শিল্পীস¤প্রদায়ের বাদ্য বাদনের মধ্যে আইগা (ঠাকুর) ফুল, জল, আগরবাতি দিয়ে গোপাল বা কৃষ্ণপূজা করেন। পুরো এই পর্বটির নাম আরতি। আরতির সমাপ্তি ঘটে প্রার্থনার ভেতর দিয়ে। এবার বিভিন্ন গ্রাম ও পাড়া আগত রাখালরা লাতে সাজানো ভোজন সামগ্রী ভোজন করেন। তাদের সঙ্গে এই ভোজনপর্বে গ্রামের শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও রাখালদের অভিভাবকেরা অংশ নেন। গোপ ভোজনের পুরো দায়ভার বহন করেন গৃহস্বামী থোঙাম ব্রজগোপাল। তিনিই এবার গোপ বালকের ভূমিকায় নৃত্য করেন।

গোপ ভোজন শেষে গৃহস্বামী থোঙাম ব্রজগোপালকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বাড়ির মেয়েরা। তারা তাকে বিচিত্র পোশাকে ও সাজে গোপ বালক কৃষ্ণরূপে সাজাতে থাকেন। প্রথমে তাকে ফাইজম বা ধূতি পরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর দুই কাঁধ থেকে বর্ণিল খাওউন নামিয়ে দিয়ে কোণাকুণি করে ধূতির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়। শুধু এখানেই শেষ নয়, গোপ বালকের সাজে একে একে তাকে মাঙডা, ঢরা, চূড়া, কোপনাম, লৌট্রেং, পামবমজায়, খুতনাপ, চেগিলেই, চেলেই, নপুর, নাচোম ইত্যাদি পরিয়ে দেওয়া হয়। এই সাজে যখন তিনি পুরোপুরি গোপ বালক হয়ে ওঠেন তখন তার হাতে তুলে দেওয়া বাঁশের বর্ণিল বাঁশরি। আর এভাবে তিনি পূর্ণাঙ্গরূপে গোপ বালক হয়ে উঠলে সাংসারিক জীবনের স্ত্রী এসে তার পা মুছিয়ে দেন। এরপর তিনি বাড়ির ভেতরের উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা তুলসীগাছকে প্রণাম করে ও ভক্তি জানিয়ে গোষ্ঠক্ষেত্রে রাখালনৃত্য পরিবেশনের জন্যে নয়াপত্তন (সমাঙ লৈকাই) থেকে আদমপুর (মনিঙ লৈকাই)-এর মদনমোহন আখড়া বাড়ির পথে রওনা দেন।

নয়াপত্তন থেকে আদমপুরের পথটি বেশি দীর্ঘ না হলেও ছেলে থোঙাম সঞ্জীব মোটরসাইকেলে করে গোপ বালকরূপী বাবা ব্রজগোপালকে এগিয়ে দেন। গ্রাম পেরিয়ে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে আকাবাঁকা পথে মোটরসাইকেলে গোপ বালকের গোষ্ঠলীলার পথযাত্রাকে পদযাত্রা মনে না হলেও মদনমোহন আখড়া বাড়িতে তাকে গোষ্ঠলীলাই করতে দেখা যায়।

দুপুর তিনটার দিকে মদনমোহন আখড়া বাড়িতে রাখাল নৃত্যের আয়োজন শুরু হয়। এসময় নৃত্যস্থানের বাইরে দক্ষিণ পাশে নন্দ মহারাজের ভূমিকায় আমুথই শর্মা নামের এক বয়ষ্ক চেয়ারে বসে থাকেন। তার পাশে রাজার দোহারি সেজে ব্রজধন দাঁড়িয়ে। নৃত্য শুরুর আগে দুইজন নারী মা হিসেবে দু'জন রাখালকে নিয়ে মঞ্চে আসেন। আসেন রাম নামের একজন সাধু। এসময় উপস্থিত ভক্তরা চিৎকার দিয়ে বলেন 'হরি বোল হরি বোল।' শুধু তাই নয়, ভক্তরা মঞ্চে এসে তাঁকে প্রণাম করে তার পায়ের কাছে প্রণামি হিসেবে টাকা রেখে যান।

মুনির ভূমিকায় পাটের আঁশ দিয়ে মুখে দাঁড়ি-গোঁফ ও মাথায় লম্বাচুলের জটা লাগিয়ে ধূতি পরে হরি নামের উত্তরী গায়ে পেঁচিয়ে মঞ্চে আসেন জয়চন্দ্র শর্মা। হাস্যরসাত্মক অভিনয়ে বালবাসুরের ভূমিকায় হামোম অজিত দর্শকদের হাসিয়ে মারেন। এতসব ঘটনার পর শুরু হয় রাখালনৃত্যের মূল পর্ব।

শুরুতে বাদকদলে বসা পুরুষ গায়কদের একজন উচ্চকণ্ঠে টেনে বাংলা ও মৈতৈ ভাষার মিশেলে বলেন, 'হেনকালে যশোমতি নন্দরাণী বাসল্য প্রেমেতে লনি হাতকরি গুরি গুরি দাকয়ে সগন।' তাঁর বর্ণনার পর মা যশোদার ভূমিকা গ্রহণকারী একজন নারী গেয়ে ওঠেন গান:

'আও গোপাল আও মায়ের কুলে। কোথা লইল নীলমণি। মায়ের হইল চিন্তামণি। সরলনী দিব মুখে। আইসো আইসো গোপাল। ধনী লনী লইয়া যাও হে। গোপাল তোমার নীলমণি। মায়ের কি হিয়া জানে মায়ে হইয়ে চিন্তামণি। গুনি গুনি হৃদয় মাঝে; অন্তরে দাহন করে। হেনকালে নারদ গোসাই ব্রহ্মপুর হইতে হস্তেতে দশুর হাতে করি। মুখে হরি নাম সকুতন করি আইল নন্দের ভুবনে।'

মায়ের এই গীতের মধ্যে কৃষ্ণ বলেন: হাই মুণি গোসাইঝি দরহি গাভি লাদ মারে গা।

এ সময় নারদ ঋষির আবির্ভাব ঘটে। তিনি এসে সুরে সুরে আসরে ঘুরে মণিগীত পরিবেশন করেন: হরি বল হরি বল হরি হরি বল রে বল। গধু হন তানা মতি রুহিনী নন্দ।

নারদ ঋষির এই গানের মধ্যে কৃষ্ণ চরিত্র তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন: হা হা পিতা মহারাজ প্রাণ রক্ষা করে। গধু হন তানা মতি যশোদা নন্দন নন্দন। (জয় জয় যশোদা নন্দকী)।

এ পর্যায়ে গায়ক রাসধারী গোষ্ঠলীলার আখ্যান বর্ণনা করেন। তার এ বর্ণনার প্রথম অংশ গদ্যের আশ্রয়ে করা হলেও দ্বিতীয় অংশে গীত পরিবেশন করতে দেখা যায়।

কথা ও গানের মধ্যে সিদাম-সুধাম মা যশোদা-রোহিনীর কাছ থেকে কৃষ্ণকে ভিক্ষা নিয়ে গোষ্ঠে চলে যায়। এক্ষেত্রে রাখাল দল বৃত্তাকারে মন্দির প্রদক্ষিণ করে এসে গোষ্ঠে যাবার পথকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। আর রাখাল গোষ্ঠক্ষেত্র মনে করে আগের স্থানে ফিরে এসে বৃত্তাকারে যখন নৃত্য করতে থাকে তখন ভক্ত সঙ্গে ঢোল-করতাল-মন্দিরা বাজিয়ে ত্রিশূল হাতে মহাদেব এসে কৃষ্ণ-বলরামকে চিনতে পেরে ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করে চলে যান।

এরপর গোষ্ঠক্ষেত্রে আবির্ভূত হন কংসের যোদ্ধা তৃণাবর্ত। শুরু হয় তার তাণ্ডব এবং কৃষ্ণের সঙ্গে তার মরণপণ যুদ্ধ। একসময় যুদ্ধে তৃণাবর্ত পরাস্ত হন।

এ পর্যায়ে দধি-দুগ্ধ-ঘৃত-মধু নিয়ে এক ভক্তের আগমন ঘটে। তিনি এসে সকল রাখালকে সঙ্গের দধি-দুগ্ধ পান করাতেই রাখালদের নৃত্য নতুন গতি খুঁজে পায়। তাদের নাচ এবার আরও অধিক গতিময় ও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে।

এর মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে আসে। তাই তো মা যশোদা-রোহিনী প্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি করে রাখালদেরকে গৃহে আমন্ত্রণ জানান: 'অপরাহ্ন কালে শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র তার দাদা বলরাম সনে চাহিয়া বলে — দেখ দেখ দাদা হলধর গগনেতে অবসান হইল দিনমণি, সিদাম-সুধাম সব সখাগণ ধবলী-সেওয়ালী-কালি-সুরভি-ধেনু বৎসগণ ফিরাও নিজ নিজ গৃহে চলি যাই।'


কদমগাছের তলে গোষ্ঠলীলা শেষে রাখালদের গৃহে স্বাগত জানাচ্ছেন মাতা রোহিনী।

এই রাখালনৃত্য পর্বে যারা যন্ত্র ও কণ্ঠ সঙ্গত করেন তারা হলেন — মৃদঙ্গে চন্দ্রমোহন ও নীলধরজ, করতাল ও কণ্ঠে নাতেকসিংহ, সামদেন ও আমুসানা। আর যশোদা ও রোহিনী চরিত্রে রূপ দান করেন খামদি ও বদে।

রাখালনৃত্যের পর মৈতৈ মণিপুরীদের মহারাসের প্রধান আকর্ষণ রাসলীলার মূলপর্বের দিকে যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু তখনও রাসলীলার অনেক বাকি। কেননা, গোপ ভোজনের মতো মৈতৈ রাসের ক্ষেত্রে গোপী ভোজনের কৃত্যাচার প্রচলিত আছে। এছাড়া, থাকে নিপা পালার আয়োজন। সবশেষে থাকে রাসলীলা।

প্রতিটি কৃত্যাচার যথাযথভাবে পালন করার বিধান আছে। আর তা ঠিকমতো পালিত না হলে রাসলীলা পূর্ণাঙ্গ হয় না। এবারে রাসলীলার বিভিন্ন পর্বের বিবরণ যথাক্রমে নিম্নে প্রদান করা হলো।

গোপী ভোজন: সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মদন মোহন আখড়াতে রাসলীলা পরিবেশনের জন্য নির্বাচিত নারীদেরকে গোপী ভোজন করানো হয়। গোপী ভোজনের শুরুতে থাকে আরতি। এরপর নৃত্যমণ্ডপে কলার পাতা বিছিয়ে তার উপর যথাক্রমে ভাত, ডাল, আলু, চাটনী, পেঁপে, পান-সুপারি, পানির পাত্র ইত্যাদি খাবার সামগ্রী সাজিয়ে দেওয়া হয়। গোপীরা সাধারণ পোশাকে এসে সেই খাবারগুলো সামনে নিয়ে বসেন। এবার নিয়ম অনুযায়ী গোপী ভোজন প্রদানকারী খাবার সামনে নেওয়া গোপীদেরকে খাবার গ্রহণের অনুরোধ করলে গোপীগণ ভোজন শুরু করেন। উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে গোপীদের ভোজনের সাথে রাসের জন্যে প্রস্তুত বাদ্যকর-গায়কগণও একই সঙ্গে খাবার গ্রহণ করে নেন।

নিপা পালা: রাত দশটার দিকে শুরু হয় নিপা পালা। এর শুরুতে বাদ্যকর-গায়কগণ গাছমণ্ডল ঘিরে বৃত্তাকারে বসে যেতেই দুইজন পূজারী এসে ফুল, পানি, পান-সুপারি ও পয়সা দিয়ে তাদেরকে বরণ করে নেন। এই বিবরণ পর্বে তারা বাদ্যকর-গায়কদের কাঁধে একটা করে গামছাও তুলে দেন। এরপর তারা বাদ্যকর-গায়কদেরকে নিপা পালা পরিবেশনের জন্য আহŸান করেন।

তাদের সে আহ্বানের পর পরই শুরু হয় করতাল ও মৃদঙ্গের সম্মিলিত বাদ্য বাদন। কিছুক্ষণ কয়েকটি গানের সুরে ও বাণীতে বাদ্য বাদন শেষ হলে দুইজন নারী এসে নিপা পালা পরিবেশনকারী বাদ্যকর-গায়কদেরকে প্রণাম করেন। অবশ্য, পরে আরো দুইজন নারীকে মঞ্চে আসতে দেখা যায়। এ পর্যায়ে বাদ্য বাদন থেকে মৃদঙ্গ বাদক ছাড়া অন্যান্য বাদকেরা মঞ্চ ত্যাগ করেন।

শুরু হয় মৃদঙ্গ ধ্বনি এবং মৃদঙ্গ বাদকদের নৃত্যের সঙ্গে নারী চতুষ্টয়ের বৈচিত্র্যময় নৃত্য। তাদের নৃত্যে হাতের কারুকাজ এবং পায়ের লম্ফন লক্ষ করা যায়। আর মৃদঙ্গ বাদকদেরকে মাঝে মাঝে নৃত্যের ঘুর্ণন সহযোগে শূন্যে আবর্তিত হতে দেখা যায়।

নিপা পালা পরিবেশনায় মৈতৈ মণিপুরী নারীদের মধ্যে দেবযানী, সানাহাণ্ডি, গন্ধমণি ও মৈরাঙ ইয়াইমতি এবং বাদ্য বাদন ও সঙ্গীতে নৎ সম্প্রদায় সংকীর্তন দলের জয়চন্দ্র শর্মা, সামদেন সিংহ, নিকুঞ্জ সিংহ, ধীরেন, বীরেন, জীতিন্দ্র ও সঞ্জয় অংশগ্রহণ করে থাকেন।

রাসলীলা: রাসলীলার মূলপর্ব শুরু হয় মধ্যরাতে, অর্থাৎ রাত্রি বারোটার দিকে। শুরুতে বাদ্যকর ও গায়কগণ প্রথমে লীলা-মণ্ডপ প্রণাম করেন। একই সঙ্গে তারা চারদিকে বসা ভক্তদের দিকে ঘুরে ঘুরেও চোখে চোখ রেখে প্রণাম সেরে নেন। সে সময় কৃষ্ণ চরিত্রের জন্যে নির্বাচিত শিশুকে কৃষ্ণ রূপে সাজিয়ে এনে অভিভাবকদের একজন তাকে মণ্ডপে বসিয়ে দেন। এরমধ্যে বৃন্দাদূতি এবং রাধার বেশে আরেকটি নারী-শিশু হেঁটে এসে মণ্ডপ প্রাঙ্গণ প্রণাম করেন। আর বাদ্যকরগণ মৃদঙ্গ-করতালে বাদন শুরু করতেই রাধা-কৃষ্ণ রূপী শিশুদ্বয়, রাধাসখী বা কৃষ্ণের গোপীরা এবং আসরে বসা সকল ভক্তমণ্ডলী যে যার অন্তরে বিরাজিত ভগবান কৃষ্ণকে জোড় হাত করে প্রণাম করে নেন।

শুরু হয় রাসলীলার বন্দনাপর্ব। এ পর্বে প্রথমেই থাকে রাসধারী পুরুষ গায়কদের কণ্ঠে রাগালাপ। মৃদঙ্গ ধ্বনির সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেই রাগালাপ চলার পর রাসধারী তিনজন নারী-গায়ক আসরে দাঁড়িয়ে বন্দনা পরিবেশন করেন। মৈতৈ মণিপুরীদের রাসের বন্দনাতে সাধারণত শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরুসহ অপরাপর গুরু ও গুরুজনদেরকে প্রথমে বন্দনা করা হয়। তবে, মৈতৈ মণিপুরী রাসলীলার বন্দনা পরিবেশনের একটি রীতি বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। যেমন, বন্দনাগীত পরিবেশনে একজন নারী-গায়ক কয়েকটি বাক্যে বন্দনাগীতের প্রথম অংশ পরিবেশন করলে গীতের দ্বিতীয় অংশ পরিবেশন করেন দ্বিতীয় নারী-গায়ক এবং দ্বিতীয় গায়কের গীত পরিবেশন শেষ হতেই তৃতীয় গায়ক গীতের তৃতীয় অংশ গেয়ে থাকেন। এরপর আবার প্রথম গায়ক বন্দনাগীতের অপর অন্তরার পরিবেশন শুরু করেন এবং পূর্বের নিয়মে অন্যান্য গায়ক সেই অন্তরাটির অপর অংশের গীত সমাপ্ত করেন। বন্দনাপর্বের শেষে নারী-গায়ক ত্রয়ী রাধা-কৃষ্ণ লীলা বিষয়ক একটি সম্মিলিত সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

এরপর বৃন্দাদূতি সখীগণ সঙ্গে 'এসো রাধা' বলে রাধার নামে একটি আগমনী গান পরিবেশন করেন। এক্ষেত্রে আগমনী গীতের সঙ্গে বৃন্দাদূতি প্রদীপ জ্বেলে কৃষ্ণ ও রাধার আগমন কামনা করে থাকেন। শুধু তাই নয়, প্রদীপের প্লেট হাতে বৃন্দাদূতিকে আরতি-নৃত্য পরিবেশন করতে দেখা যায়।

আরতি নৃত্য-গীতির পর বৃন্দাদূতি গ্লাসে রঙিন পানি নিয়ে পাতাবাহারের পাতা সমেত ডাল দিয়ে আসরে কৃষ্ণের আগমন কামনা করে রঙ ছেটাতে থাকেন। এই রঙ ছেটানোর ক্রিয়া একই সঙ্গে সুগন্ধি ছেটানোর অর্থ তৈরি করে। বৃন্দাদূতির নৃত্যাভিনয়ে তাকে ফুলের ডালা হাতে নিয়ে ফুল তোলা ও মালা গাথার আঙ্গিক অভিনয় করতে দেখা যায়। মালা গাথা শেষ হলে বৃন্দাদূতিকে মালা নিয়ে নৃত্য করতে দেখা যায় বেশ কিছুক্ষণ। ততক্ষণে রাসধারীদের কণ্ঠে মালা গাথার গীতি ধ্বনিত হতে থাকে। সবশেষে বৃন্দাদূতি কৃষ্ণের জন্যে আসরে আসন বিছিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে তিনি নৃত্য সহযোগে বর্ণিল আসনটি নিয়ে আসর প্রদক্ষিণ করে এক সময় আসরের এক পাশে আসন বিছিয়ে দেন। আসন বিছিয়ে দেবার পর তিনি এবার রঙিন পানি ও ফুলপাত্র হাতে নিয়ে আসনের চারদিকে ফুলচন্দন ও সুগন্ধি ছিটিয়ে দেন। আর এভাবেই ফুলচন্দন ছেটানো ও আসন বিছানোর মধ্যে দিয়ে বৃন্দাদূতির আগমনী গীত সমাপ্ত হয়।

রাসধারী গায়কগণ এবার কৃষ্ণের আগমনী গীত পরিবেশন শুরু করতেই এক শিশুকৃষ্ণকে আরেকটি আসন হাতে আসরে প্রবেশপথে আসতে দেখা যায়। শিশুকৃষ্ণ আসরের প্রবেশপথে তার হাতের আসনটি বিছিয়ে মণ্ডপ প্রণাম করেন এবং আসনে শুয়ে পড়ে নিশি-নিদ্রার মতো একটুখানি অভিনয় করেন। এ সময় গায়কদের গান চলছিল। গানের কথার এ পর্যায়ে কৃষ্ণের জাগরণ প্রসঙ্গ আসতেই শিশুকৃষ্ণ ঘুমভাঙার অভিনয় করে আসনের উপর উঠে বসে এবং গোষ্ঠে যাবার জন্য নূপুর পরার অভিনয় করেন। এরপর বাঁশের বাঁশি হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বাদ্য তালের মধ্যে নৃত্য করতে থাকে। বিভিন্ন ধরনের কয়েকটি নৃত্য পরিবেশনের পর বংশিধারী শিশুকৃষ্ণ বৃন্দাদূতির বিছিয়ে যাওয়া আসনে গিয়ে দাঁড়ান। সঙ্গে আসরে উপস্থিত নারী ভক্তগণ উলুধ্বনি দিয়ে ওঠেন। তাদের সে উলুধ্বনির মধ্যে কৃষ্ণ চরিত্র কিছুক্ষণ বাঁশি হাতে আসনে দাঁড়িয়ে থাকেন। এভাবেই বৃন্দার পাতা আসনে কৃষ্ণের অধিষ্ঠান হলে রাধা ও রাধাসখীদের আগমন গীত শুরু হয়।

এক বালিকা রাধারূপে সঙ্গে বেশ কিছু গোপী নিয়ে আসরে প্রবেশ করেন। এটাকে শ্রীরাধার অভিসার যাত্রা বলা যেতে পারে। বৃত্তাকারে ঘুরে প্রায় বিশজন গোপী যুগলে যুগলে রাধার এই অভিসার যাত্রার ভাব প্রকাশক নৃত্য পরিবেশন করে থাকেন। গোপীগণ বেশ কিছুক্ষণ ধরে নৃত্য পরিবেশন করার পর এক সময় রাধারাণীকে কেন্দ্রে নিয়ে নৃত্য করেন। এ সময় যুগল নৃত্য ভেঙে গিয়ে প্রতি চারজন আলাদা আলাদা দল করে নাচে। এ ধরনের দলীয় নৃত্যের বৈচিত্র্যকে ধারণ করে এই অভিসার নৃত্য শেষ পর্যন্ত রাধারানীকেই সবার সামনে পাওয়া যায়। অবশ্য এক সময় যুগলে যুগলে গোপীরা এসে রাধার সামনে গিয়ে নৃত্য করেন। এ সময় 'জয় জয় রাধা-গোবিন্দ' নামে একটি গান পরিবেশিত হতে দেখা যায়। সকল গোপীর যুগলনৃত্য সমাপ্ত হলে আবার রাধাকে সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিত নৃত্য চলতে থাকে 'কৃষ্ণ বিনা চলে না' গানের সাথে। সম্মিলিত সে নৃত্যের পর গোপীদের মধ্যে চারজন গোপী সাদা রঙের চামর দুলিয়ে রাধাকে ঘিরে নৃত্য পরিবেশন করেন।

এক সময় এই অভিসার-নৃত্যের মধ্যে কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার মিলন হয়। তারা যুগলে মুরলি হাতে মণ্ডপে দাঁড়াতেই উলুধ্বনি ওঠে আসরে। গোপীরা এবার যুগলে যুগলে রাধা-কৃষ্ণের সামনে এসে তাদের যুগলমুরতি বন্দনা করেন।

রাধা-কৃষ্ণের মিলন উপলক্ষে গোপী যুগলদের বন্দনাগীত শেষ হলে রাধা-কৃষ্ণকে ঘিরে সখীদের সম্মিলিত নৃত্য শুরু হয়। রাসধারী গায়কগণ গান পরিবেশন করেন: 'ঝলমল ঝলমল ঝলমল করে। বাঁশের বাঁশি বাজে সুরে…।'

রাধা-কৃষ্ণের মিলনের মধ্যে গানের বাণী ছাড়াও কিছুক্ষণ বাদ্য বাদন চলে। এ সময় সবাই হাতে হাত ধরে বৃত্তাকারে মণ্ডপে দাঁড়ান। এক্ষেত্রে রাধা-কৃষ্ণ থাকেন বৃত্তের মাঝখানে। আনন্দধ্বনিমুখর বাদ্য বাদন শেষে গায়কগণ আবার গানের সুর ধরেন: 'থামা রাকো থাহো হো। জয় জয় রাধে। এ নয় অভিসার।' শুরু হয় ধীর লয়ে গোপিনীদের নবনৃত্য।

…….
লুকিয়ে রাখা বাঁশি কৃষ্ণকে ফিরিয়ে দিলেন রাধা।
…….
এবার অভিসারের মধ্যে রাধা শ্রীকৃষ্ণের বাঁশরি চুরি করেন। কৃষ্ণের তো আবার বাঁশি ছাড়া চলে না। তাই তিনি বিনয় করে রাধার কাছে বাঁশি ফেরত চান। রাধা একপর্যায়ে কৃষ্ণকে বাঁশরি ফেরত দেন: 'বাঁশরি লেহ লেহ নাগর হে।' এই গানের মধ্যেই রাধা তার প্রাণের পুরুষ কৃষ্ণের বাঁশি ফেরত দিলে কৃষ্ণ আনন্দিত হয়ে নৃত্য করেন।

আবার সম্মিলিত নৃত্য শুরু হয়। এক্ষেত্রে সকল গোপী সঙ্গে রাধা ও কৃষ্ণ বৃত্তাকারে নৃত্য করেন। আর নৃত্য শেষে সকলে বসে হাত দিয়ে মাটি স্পর্শ করতেই যন্ত্রীদল থেকে গান শুরু হয়। সাথে সাথে আরেকটি নাচের পর্ব শুরু হয়। নতুন গানের সুরে যন্ত্রীরা নতুন নাচের জন্যে শিল্পীদেরকে সহযোগিতা করেন। কাঁধে এক হাত রেখে অন্য হাত মুক্ত রেখে যে নৃত্য পরিবেশিত হয়, তাতে মুক্ত হাতের নৃত্য ঘুরে ঘুরে চলতে থাকে। ক্রমাগত এ নাচের গতি ও লয় পরিবর্তন করা হয়। তারপর তিনবার বসে নাচের গতি ও লয় পরিবর্তন করা হয়। দাঁড়িয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে হাতের কাজের নৃত্য চলে। বসে হাত দিয়ে নৃত্যের বিচিত্র মুদ্রা করতে করতে শিল্পীরা এক সময় মাটি স্পর্শ করলে গান ও লয় পরিবর্তন করা হয় — নতুন গতি প্রয়োগ হয় নাচে। উল্লেখ্য, মৈতৈ মণিপুরীদের রাসলীলানৃত্যের ধারাবাহিকতার এ পর্যায়ে চারজন নারীকে থালা হাতে থালানৃত্য পরিবেশন করতে দেখা যায়। থালানৃত্যের পর্বটি শেষ হতেই আবার কৃষ্ণলীলার রাসনৃত্য শুরু হয়। এক্ষেত্রে সম্মিলিত নৃত্য পরিবেশন করতে এক সময় রাধা-কৃষ্ণ দল থেকে বের হয়ে যান। এবার শুধু গোপীগণ নৃত্য-গীত করতে থাকেন। এক সময় তারাও মঞ্চ ত্যাগ করেন। এবার রাধার কাছ থেকে কৃষ্ণ চলে যান। এবার রাধার আকুতি শুরু হয়। রাধার সে আকুতি নিয়ে বৃন্দাদূতি একটি গীতিনৃত্য পরিবেশন করেন এবং আরতি দিয়ে রাসলীলা সমাপ্ত করেন।

রাসলীলার আসরে রাধার ভূমিকায় একজন শিশুকে অংশ নিতে দেখা গেলেও অন্যান্য গোপীদের ভূমিকায় কিশোরীদের অংশ নিতে দেখা যায়। আর রাসনৃত্যের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ সময় বাদ্যের সঙ্গে গীত পরিবেশিত হতে দেখা যায়।

রাসলীলার ব্যাখ্যা ও উৎপত্তি সম্পর্কে কিছু তথ্য
রস থেকেই রাস কথাটির উৎপত্তি। আর রসাস্বাদনের জন্য যে ক্রীড়া বা লীলা তা-ই রাসলীলা। এই রাসলীলা সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। সেটি দ্বাপর যুগের ঘটনা এবং তার সংঘটন স্থান ছিল শ্রীব্রজধাম। কিন্তু বর্তমান যুগের ভারত ও বঙ্গে যে রাসলীলা কেন্দ্রিক রাস উৎসব হয়ে আসছে — তার প্রচারক হচ্ছেন প্রখ্যাত মণিপুরী রাজা ভাগ্যচন্দ্র। মণিপুরীদের মাঝে লোককথা আছে যে কয়েক শতাব্দী পূর্বে এই মণিপুরী রাজা ভাগ্যচন্দ্রই স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে ভারতের মণিপুরীদের মাঝে নতুনভাবে রাসলীলার প্রচলন শুরু করেন। তৎপরবর্তীতে মনিপুর যুদ্ধের কারণে স্বভূমি থেকে মণিপুরীরা উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন ঠিকই কিন্তু স্বভূমির ধর্ম-সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক পরিচয় থেকে তারা কখনোই নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন রাখেননি। উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে মণিপুরীরা বংশপরম্পরায় বিভিন্ন ধর্ম-সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রতিবছর রাসপূর্ণিমার তিথিতে তাদের রাস উৎসব অব্যহত রেখেছেন। উল্লেখ্য, মণিপুরী প্রবীণেরা এই উৎসবকে রাসলীলা বলতেই অধিক পছন্দ করেন।


ভারতের মণিপুর প্রদেশ থেকে আগত রাসধারী আদমপুর মৈতৈদের রাসমণ্ডপে।

অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে বাংলাদেশের সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায় বসতি স্থাপনকারী মণিপুরীরা আজ থেকে প্রায় দেড় শতাধিক বছর পূর্বে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এই দেশে তাদের ধর্ম-সংস্কৃতির প্রধান উৎসব রাসলীলার সূচনা করেন। সেই থেকে দু'একটি ব্যতিক্রম ভিন্ন মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের আদমপুর-মাধবপুরের মণিপুরীরা প্রায় প্রতিবছর নিয়মিতভাবে রাস উৎসব করে আসছেন।

মণিপুরীদের রাসলীলার উৎসবের পোশাক-পরিচ্ছদে, নৃত্যে-গীতে এবং মঞ্চ-অলঙ্করণে যে রাজকীয় গাম্ভীর্য দৃষ্ট হয় তা আমাদের দেশের অন্য কোনো সাংস্কৃতিক পরিবেশনার কোথাও দেখা যায় না। এ দেশের শিকড় পর্যায়ের অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে অনিবার্যভাবেই যেক্ষেত্রে কেবলমাত্র সাধারণের সংস্কৃতি বলে মনে হয়, রাসলীলার উৎসব মণিপুরী জন-সাধারণের একান্ত ধর্মীয় সংস্কৃতি হলেও তাকে রাজদরবারের পরিবেশনা বলেই ভ্রম হয়। আসলে, রাসলীলার প্রচারণ ইতিহাস বা লোককথাতেই এমন ভ্রমের উত্তর পাওয়া যাবে। কেননা, লোককথায় বলা হয়েছে — আধুনিককালে রাস প্রচলন করেন মণিপুরী রাজা ভাগ্যচন্দ্র আর রাজা ভাগ্যচন্দ্র নিজেও নাকি রাসের পোশাক পরে নেচেছিলেন। অতএব, রাসের জন্ম হয়েছে রাজদরবারে। কিন্তু তাকে গ্রহণ করে নিয়েছেন সাধারণ মণিপুরী জনগণ। ধর্ম-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব কমই ঘটেছে যে, রাজদরবারের বস্তু সাধারণে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে গ্রহণ করে নিয়েছে। কিন্তু মণিপুরীদের রাসলীলার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে। রাসলীলা এখন আর কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের সংস্কৃতি হয়ে নেই, তা হয়ে আছে সাধারণের সংস্কৃতি।

রাসলীলার প্রকারভেদ
মণিপুরী ঐতিহ্যে সাধারণত পাঁচ প্রকার রাসলীলা ও রাসনৃত্য প্রচলিত আছে, যথা: মহারাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস, দিবারাস ও নিত্যরাস। কার্তিক পূর্ণিমাতে মহারাস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই রাসে ভাগবত পুরাণের রাস-পঞ্চ-অধ্যায় অবলম্বনে কৃষ্ণ অভিসার, রাধা-গোপী অভিসার, মণ্ডল সাজন, গোপীদের রাগালাপ, কৃষ্ণ-রাধা নর্তন, গোপিনীদের নর্তন, রাধা কর্তৃক কৃষ্ণের বাঁশি চুরি, কৃষ্ণের অন্তর্ধান, রাধা বিরহ ইত্যাদি কয়েকটি পর্বে মহারাস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। চৈত্রপূর্ণিমাতে বসন্তরাস অনুষ্ঠিত হয়। এই রাসে হোলিখেলা, কৃষ্ণ ও চন্দ্রাবলীর নৃত্য, রাধার ঈর্ষা, ক্রোধ ও প্রস্থান, কৃষ্ণ কর্তৃক রাধার অনুসন্ধান, ললিতা ও বিশাখাসহ কৃষ্ণের রাধাকুঞ্জে গমন, মানভঞ্জন ইত্যাদি ঘটনা নৃত্যাভিনয়ের মাধ্যমে পরিবেশন করা হয়। আশ্বিনের অষ্টম দিবসে কুঞ্জরাস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই রাসে রাধা, কৃষ্ণ ও গোপিনীদের অভিসার ও কুঞ্জে আগমন অংশ অভিনীত হয়। সাধারণত মধ্যাহ্নকালে দিবারাস অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আর সারা বছরের যে কোনো সময়েই নিত্যরাস অনুষ্ঠিত হতে পারে। নিত্যরাস অংশে সাধারণত রাধা-কৃষ্ণের অভিসার ও রাসলীলার মূখ্য বিষয় রাধা-কৃষ্ণের মিলন প্রসঙ্গ নৃত্য-গীতাকারে অভিনীত হয়ে থাকে। এছাড়া, বাংলাদেশের বৈষ্ণবপন্থী মণিপুরী জনগোষ্ঠী বিবাহ অনুষ্ঠানেও এক ধরনের রাসলীলা করে থাকেন।