বাংলা সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির পথিকৃৎ

মশিউর রহমান মশু
Published : 29 June 2015, 02:22 PM
Updated : 29 June 2015, 02:22 PM

বাংলা সাহিত্য, শিল্প  ও সংস্কৃতির পথিকৃৎ , ধারক এবং বাহক বলা হয় কাকে বলা হয়? বলতে পারেন ! হ্যাঁ, আপনার ধারণা একদম ঠিক, আর তা হল চর্যাপদ। চর্যা কথাটির অর্থ " গমনশীল বা গতিমান "। চর্যাপদের পদগুলি বা গীতিগুলির বৈশিষ্ট্য, তাদের গঠনরীতি হল গমনশীল বা গতিশীল। যা গেয় বিভিন্ন স্থানে আধ্যাত্মিক মার্গে। চর্যাপদ সৃষ্টির সময় কাল আনুমানিক ধর্মপালের সময় থেকে ১১০০ খ্রিষ্টাব্দ বা ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রকাশিত বৌদ্ধগান ও দোহা' বইয়ে মোট ৫০টি পদ পাওয়া যায় । আর সেই পদকর্তাদের সংখ্যা ২৩ জন। এদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য পদকর্তা বা গীতিকার হলেন- লুইপাদ, কুক্করীপাদ, বিরুবাপাদ, গুন্ডরীপাদ, কৃষ্ণবজ্রপাদ ভুসুকপাদ, ডোম্বীপাদ ইত্যাদি। পদকর্তারা সিদ্ধাচর্যারুপে খ্যাত ছিলন। এদের মধ্যে রাজকুল বা ব্রাহ্মণ থাকলেও বেশি ভাগই ছিলেন নিম্ন বর্ণের। কাহ্ণপাদ বা কৃষ্ণবজ্রপাদ যিনি ১৩টি পদ রচনা করেছিলেন। দেব পালের সময়ে তিনি সোমপুর (পাহাড়পুর-নওগাঁ) বিহারের ভিক্ষু ছিলেন। সোমপুর নগর গড়ে উঠেছিল ধর্ম এবং সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসাবে। লুইপা, অতীশ দীপঙ্কর এবং অন্যান্য পদকর্তারা বিভিন্ন সময়ে সোমপুর বিহারে অবস্থান করতেন।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন চর্যাগীতি পদাবলী। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে চর্যাপদের সং জ্ঞা অনুযায়ী এগুলির বক্তব্য আধ্যাত্মিক। এবং তা বৌদ্ধ ধর্ম সংক্রান্ত। সেই অষ্টম শতকের সময় থেকে জীবন সংগ্রামের সুখ দু:খের আবর্ত থেকে মুক্তিপাবার, মনের সহজ অবস্থায় পৌঁছানোর ও মহাসুখ লাভের পথ দেখানো হয়েছে। অনেক পদে বা গীতিতে সাধনা সম্পর্কে উপদেশ দেওয়া হয়েছে সংস্কৃত শব্দে। এখানে অনেক শব্দ ব্যবহার হয়েছে। যেগুলি দুই ধরণের অর্থ প্রকাশ করে, যা সাধারণের বোধগম্য এবং অন্য অর্থ সাধক সম্প্রদায়ের বোধগম্য। এই ধরণের দুই অর্থবোধক শব্দরাজি ও প্রকাশ রীতিকে মুনিদত্ত "সন্ধ্যাভাষা" "সন্ধাবচন" বা সন্ধ্যাসংকেত বলেছেন। সন্ধ্যা ভাষা মানে আলো ও আঁধারির ভাষা। কতক বুঝা যায় কতক বুঝা যায়না। অর্থাৎ এই সকল উঁচু অঙ্গের ধর্মকথার ভিতরে একটা অন্য ভাবের কথাও আসে। সেটা খুলে ব্যাখ্যা করার নয়। যারা সাধন ভজন করেন তারা এটা গুরু মারফত বুঝতে পারে।

বৌদ্ধ ধর্মে তন্দ্রযানের প্রাথমিক পর্বে তিনটি মতের সন্ধান পাওয়া যায়। কালচক্রযান, বজ্রযান এবং সহযান। বজ্রযানের মতে, বোধিচিত্ত বজ্রস্বভাবের সাধক সাধনার দ্বারা বোধিজ্ঞান লাভ করেন। এই বোধিচিত্ত বুদ্ধ সৃষ্টির বীজমাত্র, তা করুণা সম্পূর্ণ হলে সেই সৃষ্টির আরম্ভ হয়। সুতুরাংকেঠোর সাধনার দ্বারা বোধিচিত্তের অধিকারী সাধক বোধিজ্ঞান লাভ করেন। এই সাধনা পদ্ধতি অত্যন্ত গুহ্য। সেই কারণে কোনও গ্রন্থে স্পষ্ট কোন কিছু বলা হয়নি।

বজ্রযানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত সহজযান। সহজযানে বাহ্য অনুষ্ঠানের কোন স্থান নাই। বিভিন্ন সিদ্ধাচার্যদের রচনাকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছিল সহজযান। এই "সহজ" এমন একটা অবস্থা যা পেলে মায়াময় জগত সংসার সম্পর্কে জ্ঞান থকেনা। আত্নাপর ভেদ জ্ঞান থাকেনা। সংসার বিনষ্ট হয়, ভাবমোহ বিলুপ্ত হয়। তখন জগত আত্মা সমস্তই একাকার হয়। সে অবস্থা যে সুখে পর্যবসিত হয় তা হচ্ছে সহজ সুখ। সাধক তখনই সুখের তন্ময় হয়ে উন্মত্তের মত আচরণ করেন, বহির্জগতের কোন কিছুই তার সেই সুখ নষ্ট করতে পারেনা। সিদ্ধাচার্যদের রচিত বিভিন্ন চর্যাপদাবলীতে এবং দোহাকোষগুলিতে খানিকটা সহযানের পরিচয় পাওয়া যায়।

চর্যাপদের পদকর্তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য লুইপাদ। তার রচিত দুইটি পদের মধ্যে একটি পদ…………
"" লুইপদনামা ""
কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল ।
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল ।। ধ্রু।।
দিঢ় অরিঅ মহাসুহ পরিমাণ।
লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ।। ধ্রু।।
সঅল সমাহিঅ কাহি অরিঅই।
দুখ দুখেতে নিচিত মরি অই।। ধ্রু।।
এড়ি এঊ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস।
সুনুপাখ ভিতি লেহুরে পাস।। ধ্রু।।
ভণই লুই আমহে ঝাণে দিঠা।
ধমণ চমণ বেশি পিন্ডি বইঠা।। ধ্রু।।
= কিছু বুঝলেন ! এই হলো আমাদের প্রায় হাজার বছর আগের বাংলা ভাষা। এবার লুই পদনামার তর্জমা হউক।
শরীর বৃক্ষ পঞ্চ ইন্দ্রিয়, তার পাঁচখানা ডাল।
চঞ্চল মনে কাল প্রবিষ্ট হল
দৃঢ় করে মহাসুখ পরিমাণ কর। (কালের কবল হতে মুক্তির জন্য )
লুই বলছেন- গুরুকে জিজ্ঞাসা করে ইহা অবগত হও।
সমাধি-সকল দ্বারা কি করবে ?
তাহাতে সুখ-দুঃখ ভোগ দ্বারা মৃত্যু সুনিশ্চিত।
এই ছন্দোবদ্ধ ইন্দ্রিয় সুখের আশা ছেড়ে
তার ( গুরুর) সান্নিধ্য গ্রহণ কর।
লুই বলছেন, আমি ধ্যানে দেখেছি ( যুগনগ্ধ রূপ)
ধমণ চমণের বেণী পিড়ি করে তাহাতে উপবেশন করেছি।

চর্যাপদাবলী গুলি আবিষ্কার করেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের মূল পুঁথিটি না পেলেও মূলপাঠ সহ এর একটি টীকা বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে নেপালের রাজ দরবারে গ্রন্থাগার থেকে উদ্ধার করেন । তাঁর সযত্ন সম্পাদনায় চর্যাগীতির পুঁথি ও নেপালে পাওয়া আরও তিনটি পুঁথি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে বাংলা ১৩২৩ সালে হাজার বছরের পুরাণ বাঙলা ভাষায় ' বৌদ্ধগান ও দোহা' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ প্রকাশের পর থেকেই চর্যাগীতির ভাষা, ছন্দ, সাহিত্যমূল্য, ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয় নিয়ে পণ্ডিত মহলে গবেষণা ও অনুসন্ধান শুরু হয়। আচার্য সুনীতিকুমার চট্রোপাদ্ধ্যায় প্রমাণ করেন যে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাগীতিগুলিতে বিদ্ধৃত আছে। প্রবোধ বাগচী চর্যাগীতির তিব্বতী আনুবাদ আবিষ্কার ও গবেষণা করেন। এছাড়াও যারা চর্যাপদ বা চর্যাগীতি নিয়ে গবেষণা করেন তার মধ্যে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, শশীভূষণ দাশ গুপ্ত, সুকুমার সেন, রাহুল সাংস্কৃতায়ন, নীলরতন সেন, তারাপদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের নাম অগ্রগণ্য।

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯১৬ সালে প্রকাশিত তার "হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা '' নামক তার বিখ্যাত গ্রন্থে লিখেছেন যে " ১৯০৯ সালে আবার নেপালে গিয়া আমি কয়েকখানি পুথি দেখিতে পাইলাম। একখানির নাম "চর্যাচর্যবিনিশ্চয়", উহাতে কতকগুলি কীর্তনের মত গান এবং তাহার সংস্কৃত টীকা আছে
গানগুলি বৈষ্ণব কীর্তনের মতগানের নাম "চর্যাপদ"। আরও একটি গ্রন্থ পাইলাম –তাহাও দোঁহাকোষ, গ্রন্থকারের নাম সররুহ বজ্র, টীকাটি সংস্কৃতে, টীকাকারের নাম অদ্বয়বজ্র। আরও একটি গ্রন্থ পাইলাম তাহাও দোহাকোষ, গ্রন্থাকারের নাম কৃষ্ণাচার্য্য ।