বীরগাথা অস্তিত্বের প্রথম স্তবক “ মহান একুশ ”

মশিউর রহমান মশু
Published : 9 Feb 2016, 08:40 AM
Updated : 9 Feb 2016, 08:40 AM

শীতের আড়মোড়া ভেঙ্গে অন্যান্য দিনের মত সেদিনও নব সাজে সাজতে বসেছিল ফাল্গুন। বৃক্ষ-তৃণ-গুল্মরাজির নতুন কচি কচি পত্র-পল্লবে ও নানান ফুলে ফুলে লেগেছিল ভ্রমর আর প্রজাপতির নৃত্য-গান। মাঠ-ঘাট নদী-নালা থেকে ফাল্গুনি হাওয়ায় ভেসে আসছিল কর্মযজ্ঞ শ্রমিক মজুরের গান। এমন উদাস হাওয়ায় কোকিলও শিমুলের ডালে বসে মিষ্টি কণ্ঠে গেয়ে ছিল বিরহী গান। সেই সুর সেই গান বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল, প্রিয় মুখ। সেই প্রিয় মুখের ভাষা না কি কেড়ে নিতে চায়!! এ হতে পারে না!! ফাল্গুনের রূপের আগুন, সে দিন সারা বাংলায় নিমিষেই বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। থেমে গিয়েছিল সকল কলতান। রাজপথ উত্তপ্ত হয়েছিল। ফাল্গুনের উদাস হাওয়া তপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে সারা বাংলায়। ফাল্গুনের আগুন লাগা রৌদ্রের ঝলক দ্রোহের আগুনে রুপ নিয়েছিল। আমাদের ভাষা আমাদের কণ্ঠ রোধ করতে চায়! এমনটা হতে পারেনা। আমরা বাঙালী সেদিন তরুণ প্রাণের বিনিময়ে হেনে ছিলাম অগ্নিবাণ। রক্ষা করেছিলাম মায়ের ভাষার মান। আমরা সেদিন বাংলা মায়ের মান রেখে ছিলাম, তেমনি রেখেছিলাম বিশ্বের অন্যান্য ভাষাভাষীদের মান। তাই সারা বিশ্বে সেই দিনটি, সেই একুশ  আজ 'বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস' হিসাবে স্বীকৃত।

মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যম গুলি- কথন, লিখন এবং আচরণ। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান মাধ্যম কথন বা ভাষা। এরপর লিখন বা লেখা; যেমন আমি আমার অভিব্যক্তি এখন প্রকাশ করছি লেখার মধ্যমে। তারপরের উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হল আচরণ; আচরণের মাধ্যমেও মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। বাক প্রতিবন্ধীরা এই আচরণের মাধ্যমে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে। তবে আমরা মনের ভাব প্রকাশের জন্য বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে বেশি ব্যবহার করি ভাষা। অবশ্যই মাতৃভাষা। মাতৃভাষার চেয়ে অন্য কোন ভাষার মধ্য দিয়ে নিজের অভিব্যক্তির শতভাগ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাই মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রতিটি মানুষের কাছে, প্রতিটি গোত্রের কাছে বা প্রতিটি জাতির কাছে অসীম।

মহাপণ্ডিত ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, একজন ব্যক্তির তিনটি জিনিস প্রিয় হওয়া উচিত- মা, মায়ের ভাষা এবং দেশ। ১৯৪৭ সালের পর আমরা এই তিনটিই হারাতে বসে ছিলাম। কিন্তু আমরা বীরের জাতি। আমাদের জাতির ধমনীতে মাইকেল মধুসূদনের মত শ্রেষ্ঠ ছন্নছাড়ার রক্ত আছে। কবি নজরুল, ক্ষুদিরাম, নেতাজি সুভাস বসুদের মত শ্রেষ্ঠ বিদ্রোহীদের টগবগে রক্ত আছে। লালন ফকির ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত বিশ্বপ্রেমিকের রক্ত আছে; যা বিশ্বকে মানবপ্রেমে আবদ্ধ করে। সেই আমাদের মত বাঙালীকে কি ভাবে পাকি-কুচক্রী মহল প্রায় ২২০০ কিঃমিঃ দূর থেকে পদানত করে রাখবে! কি ভাবে বিশ্ব ইতিহাস থেকে আমাদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে!!! সেই কুচক্রীরা পারেনি আর নতুন কোন কুচক্রীরাও পারবে না কোন কালে। ১৯৪৭-১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আমরা আমাদের মা, মায়ের ভাষা এবং দেশ এই তিনটিকেই বিশ্ব ইতিহাসে সুদৃঢ় ভাবে স্বতন্ত্র অবস্থানে দ্বার করিয়েছি।
একটি জাতির জাতিসত্তা গড়ে ঐ অঞ্চলের ভৌগলিক এবং প্রাকৃতিক অবস্থানের উপরে। আর সেই জাতিসত্তার স্বতন্ত্র বহিঃপ্রকাশ এবং উন্নয়ন ঘটে মাতৃভাষার মাধ্যমে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমাদের এই প্রিয় বাংলা ভাষার ইতিহাস আছে। ঐতিহ্য আছে। গৌরব গাঁথা সাহিত্য ভাণ্ডার আছে। ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, বাংলাভাষার এমন একটা ঐতিহ্য মন্ডিত ভাষা যার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় পাঁচ হাজার বছর খ্রিষ্টপূর্বে। বাংলা ভাষার উৎপত্তি সপ্তম শতকে যা তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়। প্রথম স্তর. প্রাচীন কাল (৬৫০-১২০০)। দ্বিতীয় স্তর. মধ্যকাল (১২০০-১৮০০) এবং তৃতীয় স্তর. বর্তমান কাল (১৮০০-বর্তমান)। এমন সুদৃঢ় সুসংগঠিত ঐতিহ্য মণ্ডিত সংখ্যাগরিষ্ঠের বাংলা ভাষার উপরে উর্দু ভাষা চেপে দেওয়া শুধু চরম মুর্খামি নয় ধৃষ্ঠতাও বটে!

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ৪ কোটি মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। আর মাত্র ২ কোটিরও কম পশ্চিম পাকিস্তানের কুচক্রীদের উর্দু ভাষার কাছে বাংলা ভাষা মাথা নত করবে! এমন ভাবনা অবশ্যই অসুস্থ ভাবনা চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। তাইতো সেদিন আমরা বিদ্রোহ করে ছিলাম অসুস্থ পাকি-ভাবনা চিন্তার কুচক্রীদের বিরুদ্ধে। সকল বাধা অতিক্রম করে রাজ পথে মিছিল করে ছিলাম। চিৎকার দিয়ে গগণ ফাটিয়ে কুচক্রীদের কান ঝালাপালা করে বলে ছিলাম, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। পাকি-কুচক্রীদের নতুন করে চিনিয়ে দিয়েছিলাম নিজেদের বীরত্বের বীর গাঁথা অস্তিত্বের প্রথম স্তবক। যা লেখা হয়েছিল বুকের তাজা লাল রক্তে। সেই লাল রক্ত আমাদের বাঙালী চেতনার এক একটি অগ্নিফোঁটা। সেই রক্ত বাঙালি জাতিসত্তার রক্ত। সেই রক্ত আমাদের শহীদের রক্ত। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার আরও নাম না জানা শহীদের রক্ত। বিনম্র ভাবে সালাম জানায় তোমাদের। তোমরা লক্ষ কোটি বছর ধরে বেঁচে থাকো বাঙালির অন্তরে। বাঙালির অন্তর থেকে অন্যান্য জাতির অন্তরে।

আজও কিছুতেই বুঝতে পারিনা, অসুস্থ চিন্তা ধারার জঘন্য একটা রাষ্ট্র; এই পাকি জাতির সাথে কেন আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক আজও বহাল আছে! যারা আমাদের ভাষা কেড়ে নিয়েছিল। যারা আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হরণ করেছিল। এমন কোন হীন চক্রান্ত ও আচরণ নাই যা তারা আমাদের সাথে করেনি! এমন কি তারা তাদের সেই সকল কুকর্মের জন্য আজও অনুতপ্ত নয়! এমন একটা অমানবিক পক্ষাঘাত সম্পূর্ণ বিবেকহীন রাষ্ট্রের সাথে কেন আমাদের সম্পর্ক বহাল! আর কিবা এমন লাভ, এই জঙ্গি চেতনার প্রসূতি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রেখে। বরং তাদের বিবর্জিত চিন্তা ধারার দাসত্বে তারা এবং তাদের ছোঁয়াতে তাদের দোসরেরা বাংলাদেশে অদ্যবধি নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে।

একটা জঙ্গি চেতনার প্রসূতি রাষ্টের সাথে সম্পর্ক থাকবে কি থাকবেনা, সেই সিন্ধান্ত নেওয়ার সময় মনেহয় চলে এসেছে। যদি বাংলাদেশের বর্তমানে বা সুদূর ভবিষতে পকিস্থানের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভুত্ব লাভের সুযোগ থাকে, তাহলে একটু সম্পর্ক থাকতেই পারে। নতুবা বন্ধ করে দেওয়া হউক তাদের সাথে সকল সম্পর্ক। আসলে এ বিষয়ে সঠিক সিন্ধান্তে আমি পৌছাতে পারবো না । আমি কোন মন্ত্রি বা রাজনৈতিক নয়। তবে প্রত্যাশা করতে পারি। মত প্রকাশ করতে পারি। মত প্রকাশের অধিকার আমার আছে এবং থাকবে। একুশ এই অধিকারের কথায় বলে। অমর একুশে ফেব্রয়ারি / আমি কি তোমায় ভুলিতে পারি। বিনম্র সালাম ও শ্রদ্ধা বাংলা ভাষা এবং ভাষা শহীদদের প্রতি।