পুলিশি নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মানবাধিকার—কিস্তি ২

প্রবীর বিধান
Published : 5 June 2012, 04:23 AM
Updated : 5 June 2012, 04:23 AM

অপরাধের শাস্তি না হলে, তার বিস্তার শুধু বাড়ে। পুলিশ, বিচার বিভাগ, রাজনীতিবিদেরা জবাবদিহিতার মধ্যে আসলে, অপরাধের বিচার নিশ্চিত হলে তবেই জনগনের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো হয়।

আগের অংশের শেষভাগে ডঃ মিজানুর বলছিলেন আইনশৃংখলা পরিস্থিতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এক নয়। পুলিশি নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মানবাধিকার—কিস্তি ১

বিরতির পর আবার ফিরে এলাম আজকের বাংলাদেশে!

খালেদঃ সুলতানা আপার কাছে জানতে চাই ডঃ মিজানুর বলছিলেন সার্বিক আইনশৃংখলা, মানবাধিকার পরিস্থিতি আর রাষ্ট্রের করনীয় সম্পর্কে যা বললেন সেটা নিয়ে।

সুলতানাঃ ডঃ মিজান যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষনটা দিয়েছেন সে বিষয়ে তো দ্বিমত করার অবকাশ নেই। সার্বিক আইনশৃংখলা পরিস্থিতি থেকেই আমাদেরকে মানবাধিকার পরিস্থিতিকে চিহ্নিত করতে হয়। তবে আমি যে কথাটা বলবো, একেকটা ঘটনা ঘটার পর রাষ্ট্র তার দায়িত্ব অনুযায়ি সেটাকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে সেটার উপরেই নির্ভর করবে জনগনের অধিকারকে, তাদের বিচার পাওয়ার অধিকারকে রাষ্ট্র কতটা সম্মান করছে। সেই সম্মান করা না করার মধ্য দিয়েই মানবাধিকারের বিষয়গুলো বের হয়ে আসে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে অভিযোগগুলো আমাদের কাছে আসে, আমরা যেহেতু একটি মানবাধিকার সংগঠন, মানুষ তো কিছুটা বুঝতে পারে কারা ধরে নিয়ে গেছে; আশেপাশের লোকজন তো দেখতে পায় যে গাড়ি করে আসলো, কি ভঙ্গিতে নামলো, তাদের শরীর-স্বাস্থ্য-ভঙ্গিমা, তাদের শরীরের build-up, সেটার ধরন, সবকিছু দেখেই সহজেই বুঝা যায় যারা ধরে নিচ্ছে তারা কি প্রশিক্ষিত মানুষ না সাধারন লোক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযোগ আছে আইংশৃংখলা বাহিনীর মানুষই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এবং তা যদি সত্য নাও হয় সেখানেও রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে সাধারন মানুষদের একটা নিশ্চিন্তবোধ দেয়া, একটা নিরাপত্তাবোধ দেয়া যে, দেখ, না আসলে রাষ্ট্র এগুলো করছে না। কিন্তু রাষ্ট্র না করলেও রাষ্ট্র যথেষ্ঠ ততপর।

আরেকটা জিনিস হলো, যা আমরা বিরতির সময় আলোচনা করছিলাম, এসব ঘটনা এত বেশি কেন হচ্ছে। যখন মানুষ দেখতে পাচ্ছে এধরনের কাজ করে তাকে জবাবদিহিতার মধ্যে আসতে হচ্ছেনা… এ কথাটা বলতে বলতে বলতে বলতে আমার এখন এক রকম জিকিরের মতই হয়ে গেছে যে জবাবদিহিতা নাই, জবাবদিহিতা নাই, জবাবদিহিতা নাই বলেই এই অবস্থা হচ্ছে। তখন কিন্তু সাধারন অপরাধগুলি সংখ্যায় বেড়ে যায়। তারা এই পরিস্থিতির সুযোগ নেয়, যে আমাকে তো জবাবদিহি করতে হবেনা। এত বড় বড় অপরাধের জবাবদিহিতাই কেউ চাইছেনা, রাষ্ট্র গুরুত্ব দিয়ে দেখছেনা, আমরা এই ফাঁকে কিন্তু অনেক কিছু করে ফেলতে পারি। তখন ব্যক্তিগত কারনে যেসব অপরাধ হয় সেগুলো অনেক বেড়ে যায়, ছোটখাট অপরাধগুলো বেড়ে যায়। সবাই মনে করে free for all মত একটা ব্যাপার হয়ে যায়, মানে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া। যেটা আমাদের মত মানবাধিকার কর্মীদের কাছে উদ্বেগের কারন হয়ে দাঁড়ায়।

সেটা থেকে আমরা একটা সূত্র দিয়ে দেখতে পারি পিটিয়ে মেরে ফেলা, ধাক্কা দিয়ে মেরা ফেলা, আবার এই যে সম্প্রতি গাজীপুরের ঘটনাটি…পুলিশ বলছে ছিনিয়ে নিয়েছে, লোকজন বলছে ছিনিয়ে নেবার কোন পরিস্থিতি ছিলনা, আমরা video-তে দেখেছি সেরকম পরিস্থিতি ছিলনা, পুলিশ হাতে ছেড়ে দিল। অতখানি কষ্ট করতেও রাজী না যে থানায় নিয়ে গিয়ে বিচার করি বা আইনের মাধ্যমে শাস্তি দেই। আগেই মেরে ফেলা, যাহ অন্যরাই মেরে ফেলুক।

এই যে একটা প্রতিদিনকার অবনতি ঘটছে মানুষের মূল্যবোধে, চিন্তাধারায়, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, অধিকার, মর্যাদা এসবের যে values বা মূল্যবোধগুলি থাকে এগুলি তো ক্রমশ নীচের দিকে চলে যাচ্ছে। তখন তো আইন্শৃংখলার অবনতির সাথে সাথে মানবাধিকারের প্রতি যে একটা শ্রদ্ধা একটা মান বা শ্রদ্ধা সেটা তো একেবারেই পড়ে যাচ্ছে।

সাদাতঃ তার মানে আপনি বলছেন wrong signal যাচ্ছে মানুষের কাছে।

সুলতানাঃ হ্যাঁ, একদম…

সাদাতঃ Administration তো চলে signal দিয়ে। যখনই signal ইয়ে হয়ে যায়, তখনই মনে করে যা ইচ্ছা তাই করা যায়।

খালেদঃ মানবাধিকার নিয়ে আরেকটা বিষয় সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে আদালতে জবাবদিহিতার ব্যাপারে। "আদালতে কোন অভিযোগ দেয়ার পর সেটা প্রমানের কোন প্রয়োজন পড়েনা পুলিশের।এ সুযোগে কোন ঘটনা ঘটলেই অজ্ঞাতনামা কয়েকশ জনের বিরুদ্ধে মামলা জুড়ে দেয়া হয়" এই বিষয়টাকে কিভাবে মোকাবেলা করা যায়?

সাদাতঃ কাল আমাদের একজন lawyer বলছিলেন একটা আলোচনায় যে CrPC'র ঐ ধারাগুলো উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন এই যে জিজ্ঞেস করার বা ইয়ে…করার…আমরা agree করিনা, কারন আমি মনে করি ৩টা জিনিস মিলে…মানবাধিকার…একটা পুলিশ, magistrate আর judiciary as a whole… পুলিশকে control করতে হলে একমাত্র judiciary properly control করতে পারে, magistracy যেটাকে আমরা বলি। তো ধরে আনলেই তাকে জেলে নিতে হবে, remand-এ নিতে হবে এটা কোন রকমেই কেউ বিশ্বাস করেনা। কারন আইন তো…আমরাও আইনের লোক, আমরাও magistracy করেছি, আমরা যখন sub-divisional ছিল… কত লোককে জিজ্ঞাসা করেছি, আপনি… prima facie case কিভাবে হলো? ধরেন একটা লোক দুনিয়াতে…সে আশেপাশেও নাই, তারে বললেন যে এই কাজটা হয়েছে। তাহলে তো পুলিশকে প্রমান করতা হবে যে, সে এই জাতীয় লোক, সে …জায়গা থেকে ঢিল ছুঁড়তে পারে…এখন কিছুই যদি প্রমান করতে না পারে…। সে হয়তো একটা গরীব লোক। অতীতেও দেখেছি, এবারও দেখছি, গনগ্রেপ্তার যখন হয়…বাস থেকে নামে, হয়তো মুড়ি-মুড়কি নিয়ে যাবে আত্মীয়ের কাছে তাকেও ধরে নিয়ে গেল এবং তাকে ৪দিন রেখে দিল। একজন মন্ত্রী বলেছিলেন একবার, তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, খুব important মন্ত্রী, উনি বললেন কিছু না, ৩দিন পর ছেড়ে দিবে। যেন এইটা কোন ব্যাপারই না, খেলার ব্যাপার যে, ৩দিন থাকবে আপনারা এত চিন্তা করছেন কেন? ৩দিন পরেই ছেড়ে দিবে। এইগুলা খুব lightly দেখা হয় এবং law-এর লোক যারা তারা ভালো করে জানে প্রথমে তারা it has come within the mischief of the law. যেমন ধরেন আমাদের আইনে আছে যে development activities-এর ক্ষেত্রে injunction দেয়া যাবেনা। আমি একবার এই ব্যাপারে চেষ্টা করেছিলাম। তখন আমার মনে আছে law secretary আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে প্রথমে তো আপনাকে স্পষ্ট করতে হবে যে এইটা development activity। এখন আমি একটা লোককে ধরে এনে একটা থাপ্পর দিয়ে বললাম যে ও development activities-এ hamper করছে, সুতরাং এইটার কোন case হবেনা, কোন writ হবেনা। মোদ্দা কথা এইটা প্রমান করতে হবে যে এই বিষয়টি development activities-এর মধ্যে পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে, তাহলে তো আইনের mischief-এ আসে। দেখা গেলো যে, mischief-এ আসেনা তবুও তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সেতা তো হতে পারেনা।

খালেদঃ আমরা এই পর্যায়ে একটা বিরতি নিব। বিরতির পরে আমরা স্যারের সাথে যা নিয়ে আলাপ করবো তা হলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যে আইনের বলে গঠিত হয়েছে তাতে আপনি এতাকে যেভাবে চালাতে পারছেন সেভাবে চালাতে পারছেন কিনা—দুই-তিনটা ধারা নিয়ে কথা বলবো। বিরতি নিচ্ছি।