নিজেকে শাস্তি না দিয়ে প্রতিরোধ নয় কেন

মীর আহসান হাবীব
Published : 6 March 2011, 06:23 PM
Updated : 26 August 2011, 02:51 PM

পত্রিকার পাতা খুললেই আজকাল চোখে পড়ে শারীরিক বা যৌন নির্যাতন অথবা অন্য কোন মানসিক যন্ত্রণায় আত্মহত্যার খবর। বলা বাহুল্য আক্রান্ত পক্ষটি হচ্ছেন নারীরা। স্বামী সাঈদ কর্তৃক রুমানাকে অন্ধ করে দেয়া, নিকট অতীতে বন্ধু জিমি'র প্ররোচনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্রী রুহীর আত্মহত্যা, যৌতুক-পাগল স্বামীর অত্যাচারে রমনাতে গৃহবধূ রুমার আত্মহত্যা। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্তৃক বিয়ে করতে অস্বীকৃতির পর জাবি ছাত্রী সুমির আত্মহত্যা আর সর্বশেষ সালিশের(?) অপমান সইতে না পেরে মাদারিপুরে শিরিনের আত্মহত্যা আমাদের পুরুষ-শাসিত আধিপত্যবাদী সমাজের এক দরিদ্র অবয়বকেই বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে। রুমানার ব্যাপারটি একটু ভিন্ন হলেও তিনি বছরের পর বছর স্বামী সাঈদের অত্যাচার সহ্য করে গেছেন। তিনি ভেবেছেন তথাকথিত সামাজিক মর্যাদার কথা যার মূল নিয়ন্ত্রক হচ্ছে পুরুষ। পুরুষ নিয়ন্ত্রিত এই সমাজে তারা বিচার চাইতে গেলে হয়ত তাদেরকেই দোষী সাব্যস্ত করা হত। অতএব যত দোষ ওই মেয়েটিরই। শিরিনের ব্যাপারটিতে ঠিক তাই ঘটেছে – ছাগলের গাছের পাতা খেয়ে ফেলার মত সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে নারীর উপর সহিংস হয়ে ওঠা এবং তৎপরে সেই নারী বিচার চাইতে গেলে সালিশে তাকেই দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেয়া প্রমাণ করে আমরা সেই মুক্ত সমাজ থেকে এখনো অনেক দূরে যেখানে নারীর ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। এই লেখাটি কারো বিচার দাবী করার জন্য করা নয়। সুমি-রুহী-রুমানা-রুমারা এভাবে আত্মসমর্পণ করে বারে বারে একটি ভুল বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের কাঠগড়ায় নিজেদের দোষী সাব্যস্ত করে নিজেদের দিচ্ছেন চরম শাস্তি।

সুমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। শুধু ছাত্রী ছিলেন না ছিলেন মেধাবী ও প্রাণবন্ত ছাত্রী। মাস্টার্সের পরীক্ষা কেবল শেষ করেছেন কয়েক দিন আগে, অনার্সে হয়েছেন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল তার – শুধু কি তাই, আরও অনেক বড় কিছুও হয়তবা হতে পারত সে। কিন্তু সব সম্ভাবনাকে শেষ করেছে নিজ হাতে – জীবনের অমিত সম্ভাবনা তার কাছে মনে হয়েছিল মূল্যহীন, আর তাই আত্মহত্যা করে নিজের স্বপ্নের সমাধি রচনা করেছে নিজেই। সুমির ভবিষ্যত জীবন সঙ্গী অন্য বিভাগের আরেকজন শিক্ষক তার জীবনের একটি সত্যকে মেনে নিতে পারে নি, মনে করেছে তার অমিত (?)সম্ভাবনাময় জীবনে এই সত্য বাধা সৃষ্টি করবে। সত্যটি আর কিছুই নয় – সুমি ইতিপূর্বে নাম মাত্র বিয়ে করেছিল তারই এক আত্মীয়কে। ধারণা করা যেতে পারে এই সত্যটি সুমি নিজেই তার ভবিষ্যত জীবন সঙ্গীকে জানিয়েছিল। এই সত্য ধারণ করার মত উদারতা ওই শিক্ষকের ছিল না এবং তিনি সুমিকে প্রত্যাখ্যান করেন। সুমি আজীবনের বন্ধু চিনতে ভুল করেছিলেন আর এজন্য সমস্ত দায় তিনি নিজ কাঁধে নিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। কিন্তু তিনি মারাত্মক এক ভুল বার্তা দিয়ে গেলেন আমাদের।

স্বামী-স্ত্রী দুজনেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক – আমার স্বল্প অভিজ্ঞতায় এই বিষয়টাকে দারুণ পেশাগত কম্বিনেশন বলে মনে হয়। তবে এর সাথে কিছু পর্যবেক্ষণ যুক্ত না করে পারছি না। বেশ কয়েকজন বন্ধু স্থানীয় পুরুষ শিক্ষককে দেখেছি পরবর্তীতে একই বিভাগের বা অন্য বিভাগের ছাত্রীকে, পরবর্তীতে যার সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষক হবার সম্ভাবনা আছে তাকে বিয়ে করতে। তবে এদের সবাই যে পরবর্তীতে শিক্ষক হতে পেরেছেন ব্যাপারটি এমন নয়। শুধু যে মেধার জোরে আজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না এটা প্রায় সর্বজন স্বীকৃত। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেতে হলে কোন একটি পক্ষ নিয়ে নিজের আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হয়। শুধু কি বিশ্ববিদ্যালয়, আমাদের পুরো সমাজটাই আজ মনে হয় মানবিক মূল্যবোধকে তালাবদ্ধ রেখে আনুগত্য আর স্বার্থসিদ্ধির একটা বিশাল ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি এবং প্রত্যাখ্যানের ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অন্যায় হবে না যে ইতিহাস বিভাগের এই ছাত্রীকে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে আমাদের আলোচ্য শিক্ষকের ভবিষ্যত লাভের পাল্লা ছিল অনেক ভারি। কিন্তু সুমির জীবনের এই ছোট একটি সত্য তাকে আতংকিত করেছে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে একে তিনি বাধা মনে করেছেন। আর তাই করেছেন প্রত্যাখ্যান। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার কারিগররা আজ এইটুকু সত্যকে ধারণ করার মত উদার নয়। কিন্তু সুমি আত্মহত্যা করে কি বার্তা দিয়ে গেলেন আমাদের – আমার কাছে পুরো ব্যাপারটি যুদ্ধের আগের আত্মসমর্পণের মত মনে হয়েছে। যে শিক্ষক তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তার শূন্যতাকে বুঝতে চান নি তিনি কী করে তার ভবিষ্যত জীবনের একজন চিরস্থায়ী বন্ধু হবেন ? সুমি এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেন নি। সুমি জীবনটাকে অর্থহীন মনে করেছেন – ভাবেন নি তার পরিজনদের কথা অথবা ভাবলেও হতাশার কাছে সেগুলো গৌণ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বুঝতে পারেন নি নিজের সামর্থ্যের কথা – এই প্রত্যাখ্যানকে তিনি ভবিষ্যত জীবনের জন্য সতর্ক বার্তা হিসেবে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সুমি ভুল করেছেন – মারাত্মক ভুল করেছেন, ভুল বার্তা দিয়েছেন সমাজকে। প্রচলিত ধারণার মূলে আঘাত না করে তিনি আধিপত্যকে মেনে নিয়েছেন। সুমি প্রমাণ করতে পারতেন তার সামর্থ্যের কথা, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারতেন পুরুষ আধিপত্যের প্রতি।

বছর খানেক আগে জাবির আরেক ছাত্রী রুহীর মৃতদেহ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় সাভারে। এই ঘটনাকে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা বলে প্রতিষ্ঠিত করে হয়। জাবির বিভিন্ন সূত্রের সাথে কথা বলে যা জানা যায় পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র জিমি এবং অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী রুহী বিয়ে করে সাভারে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। তাদের এই সম্পর্কের কথা অনেকটাই গোপন ছিল। জিমি পরবর্তীতে আরও অনেকের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। স্বাভাবিকভাবেই রুহীর এটা মেনে নেয়ার কোন কারণ ছিল না। রুহী শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার (?)পথ বেছে নেন। মামলা হলেও জিমি'র সম্পদশালী পরিবার ছেলেকে রক্ষার জন্য অর্থ ব্যয়ে কোন কার্পণ্য করেন নি। রুহীর পরিবার কিছুটা আঁচ করতে পারলেও রুহী বলেছিলেন এই সমস্যা তিনি একাই সমাধান করতে পারবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেন নি রুহী। রুখে না দাঁড়িয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন অথবা শিকার হয়েছিলেন কোন হিংস্রতার। ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে মেনে নিলে বলতে হয় রুহী সব কিছু জেনেও শেষ পর্যন্ত নিশ্চুপ ছিলেন। কিন্তু এর চুপ থাকাটাই তার জন্য কাল হয়েছিল – আর এর মূল্য দিতে হয়েছিল নিজের জীবন দিয়ে।

এবার এই দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক চরিত্রের দিকে একটু আলোকপাত করা যাক। রুহীর মৃত্যু হলে জাবি কর্তৃপক্ষ এই বলে দায়িত্ব শেষ করে যে যেহেতু ঘটনা ঘটেছে ক্যাম্পাসের বাইরে এবং জিমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব শেষ করেছে তাই এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কিছু করণীয় নেই। রুহীর বন্ধুরা এবং কিছু শিক্ষক একটি মানববন্ধন করে দায়িত্ব শেষ করে। লাশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার প্রয়োজনও মনে করেনি কেউ – পাছে কোন ঝামেলা হয় । সুমির ক্ষেত্রে অবশ্য কর্তৃপক্ষ এতটা দায়িত্বহীন হতে পারেন নি। একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, বলা হয়েছে এক মাসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করতে। একটি শোক রেলি হয়েছে। হয়ত শোক সভাও হবে এরপর। তবে শিক্ষকদের মধ্য থেকে কোন রকম কার্যকর প্রতিবাদ এখন পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। যা শুনেছি সেটি আরো ভয়াবহ। ইতিহাস বিভাগের এক গ্রুপ শিক্ষক এই ইস্যুকে অন্য আরেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করার চেষ্টা করছেন। বলা বাহুল্য এই দুই পক্ষই আমাদের জাতীয় রাজনীতির দুই মূল ধারার অনুগত। হায়রে আমাদের মানসিক দেউলিয়াত্ব! সুমির বন্ধুরা উপাচার্যের সাথে দেখা করে বিচার চেয়েছেন। শিক্ষক শিক্ষকের বিরুদ্ধে দাড়াবেন না– এটাই প্রত্যাশিত আচরণ।

বিশ্ববিদ্যালয় নিজ থেকে কখনও ছাত্রছাত্রীদের পাশে এসে দাড়িয়েছে বলে মনে পড়ে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এবং নিকট অতীতে অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে কয়েকটি সাফল্য আমরা দেখেছি তার সব কটির অর্জন এসেছিল প্রতিবাদের আর সংগ্রামের মাধ্যমে। কাউকে দায়ী করছি না, কোন বিচার চাইছি না, বলছি না যে সুমি, রুহীরা নিশ্চিতভাবেই শিকার হয়েছিলেন কোনরকম শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কি শুধু মানববন্ধন আর শোক রেলি করে দায়িত্ব শেষ করবেন যারা নিজেদের অভিভাবক হিশেবে দাবী করেন তাদের কি ন্যূনতম কোন দায়িত্ব নেই এই ছাত্রদের প্রতি? বিশ্ববিদ্যালয় কেন খোঁজ খবর রাখবে না তার সন্তানদের ভালো মন্দের? কেন সুমি বা রুহী তাদের কোন শিক্ষককে বলতে পারেন নি তাদের এই মানসিক অস্থিরতার কথা? মুক্ত বুদ্ধির চর্চা কেন্দ্র হিশেবে দাবীদার বিশ্ববিদ্যালয়ে কি আদৌ আর মুক্তবুদ্ধির চর্চা হয়?

এইভাবে চুপ থাকা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করা ব্যক্তিচরিত্রে যে আপাত কোন পরিবর্তন আনে না সেটি রুমানা, রুমা, রুহী, সুমি আর শিরিনরা বারবার প্রমাণ করে যাচ্ছেন। তবু কেন এই চুপ থাকা? আমাদের সামনে রয়েছে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত – ৯৮ এ জাবিতে গড়ে ওঠা ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, দিনাজপুরে ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যার পর গড়ে ওঠা আন্দোলন আর সর্বশেষ ভিকারুন্নেসাতে ছাত্রী ধর্ষণের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন আমাদেরকে কি এই শিক্ষাই দেয় না প্রতিরোধের কোন বিকল্প নেই? নারীর এই আন্দোলনে নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রতিরোধই একমাত্র সমাধান। সময় এসেছে প্রতিবাদ করার, পাল্টা আঘাত করার। আনুগত্য আর স্বার্থসিদ্ধি আর পুরুষ আধিপত্যের এই সমাজকে বদলাতে হবে, সমাজ যেন আমাদের বদলে না ফেলে।

মীর আহসান হাবীব
: উন্নয়ন কর্মী ও লেখক