স্বাধীনতা দিবস: প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং বাস্তবায়ন

রবিউল ইসলাম
Published : 26 March 2017, 08:56 AM
Updated : 26 March 2017, 08:56 AM

২৬শে মার্চ বাঙালির জাতীয় ও স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল। প্রতিবছর এই দিনটি এদেশের মানুষের মাঝে স্বাধীনতার চেতনা জগ্রত করার নতুন বার্তা নিয়ে আসে। ২৫শে মার্চের মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া ইতিহাসের বর্বর হত্যাযজ্ঞের ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের শপথ গ্রহণ করা হয় এই দিনে।

১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি রাষ্ট্র জন্ম হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় পাকিস্তানের এক অংশ কর্তৃক অন্য অংশের উপর শোষণ, নীপিড়ণ। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি স্তরে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে কোণঠাসা করে রাখে পশ্চিম পাকিস্তান। শোষণ-বঞ্চনার শিকার হতে থাকা পূর্ব পাকিস্তান চূড়ান্তভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের মুখোমুখি দাঁড়ায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরও পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামীলীগকে সরকার গঠনে বাধা দেওয়া হয়।

দীর্ঘ ২৩ বছরের শোষণের ইতিহাসকে আরো দীর্ঘায়িত করার লিপ্সা চরিতার্থ করার ঘৃণ্য মানসিকতা নিয়ে সামরিক অফিসারদের নিয়ে করা বৈঠকে দেওয়া ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা বাস্তবায়নের নিমিত্তে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে এদেশের নিরীহ মানুষের উপর চালানো হয় জঘন্যতম গণহত্যা।

অব্যাহত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গোলামী থেকে মুক্তির জন্যই পরিচালিত হয়েছিল এদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এককথায় বলতে গেলে মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করাই ছিল এ যুদ্ধের প্রধান ব্যাকগ্রাউন্ড। এ কথার প্রমাণ মিলবে বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনায়। যেখানে স্পষ্টতই উল্লেখ রয়েছে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা। এমন রাষ্ট্র যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস যদি আপনার কাছে পরিস্কার থাকে তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে আমদের মহান সংবিধান প্রণেতাগণ মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত উদ্দেশ্যই প্রস্তাবনায় তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। মধ্যম সারির দেশের কাতারে শামিল হওয়ার পথে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা পরিচালিত দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নও চোখে পড়ার মত। কিন্তু ৪৭তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে যদি আমরা মহান সংবিধানের প্রস্তাবনায় করা অঙ্গীকার অনুযায়ী প্রকৃতঅর্থে মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সফলতার হিসাব করি তাহলে ফলাফল আসবে খুবই হতাশাব্যঞ্জক। এমনকি এটা শূন্যের ঘরেও নেমে যেতে পারে।

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কোন ক্ষেত্রেই আমরা সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করতে পারিনি। রাজনৈতিক অঙ্গন (ছাত্র রাজনীতি, যুব রাজনীতি বা দলীয় রাজনীতি) দুর্বৃত্তায়নের কারখানায় পরিণত হয়েছে। এ অঙ্গনে সাম্য বা স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে এমনভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে যে দেশের সৎ, যোগ্য মানুষগুলো রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার কথা চিন্তাই করেনা। আবার যারা রাজনীতিতে যুক্ত আছেন তাদের মধ্যেও সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত হচ্ছে না। প্রকৃত কর্মীদের মূল্যায়ন এদেশে হয়না বললেই চলে। ফলে এদের বেশিরভাগ অংশ ছাত্র ও যুব রাজনীতির সময়ই ঝড়ে যায়। যার ফলাফল দলীয় রাজনীতিতে যোগ্য ও সৎ নেতৃত্বের অভাব।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থায়ও সাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। কিন্তু ধনী-গরীবের ব্যবধান কমছে না বরং চিত্র তার উল্টো। আমাদের দেশে এমন ব্যক্তি আছেন যার আয় বছরে শত কোটি টাকা আবার দুবেলা পেট পুরে খেতে পারেন না এমন দুর্ভাগা মানুষেরো অভাব নেই। ধনীরা সম্পদের পাহাড় গড়লেও সুযোগ সুবিধার অভাবে দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হচ্ছে। মূলত সম্পদের অসম বন্টন এবং অবৈধ আয়ের উৎস এর পেছনে দায়ী।

সামাজিক অঙ্গনে চলমান বৈষম্যও কোন অংশে কম নয়। সামাজিক স্তরে সাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার পেছনে অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেকাংশে দায়ি বলেই আমার কাছে মনে হয়। সবখানেই উঁচু-নিচুর ব্যবধানকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিরলস প্রচেষ্টায় ব্যস্ত সমাজের শাসক শ্রেণীরা। কোন এক অজপাড়াগাঁয়ের ক্ষুদ্র এক সালিশি দরবারে যান, সেখানেও আপনার চোখে পরবে সামাজিক শ্রেণী বৈষম্যের চিত্র। মানুষে মানুষে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ছে। সহনশীলতা নেই বললেই চলে। ভেদাভেদ বাড়ছে; হানাহানি, কলহ লেগেই আছে। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল তো এসকল বৈষম্য দূর করতেই। সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যও একই ছিল। আমরা কি এগুলো নিয়ে ভাবি? আমাদের নেতারাই কি এগুলো ভাবছেন? সত্যিকারের দেশপ্রেমিকদের এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মহান সংবিধানের প্রস্তাবনাকে বাস্তবায়নের কাজে নেমে পড়ার। এটা আমাদেরই কাজ, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে আসতে হবে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা দিবসের চেতনাকে বুকে ধারণ করে। এবারের স্বাধীনতা দিবসের এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।