ঘুমের ঘোরে কাঁথা চিবানো এবং গম সমাচার

রাজু আহমেদ
Published : 5 July 2015, 02:36 PM
Updated : 5 July 2015, 02:36 PM

ছোট বেলায় গ্রামে একজন ছদরুদ্দীর রুটি চিবানোর গল্প খুব প্রচলিত ছিলো । যিনি তার একমাত্র বউয়ের কাছে প্রতিদিন রুটি খাওয়ার বায়না করতো । বউ আধা ডজন বাচ্চা সামলে রুটি বানানোর ফুসরৎ পেত না । তবুও তিনি কখনোই স্বাদের রুটি ভক্ষণের আশা ছাড়েনি । এক বকরার ঈদে ছদরুদ্দী খুব আশা নিয়ে শ্বশুড়বাড়ীতে বেড়াতে গেলো । ছদরুদ্দী ভেবেছিলো, এবার পেট পুড়ে রুটি খাওয়ার আশা পূরণ হবেই । ঈদের পর একদিন যায়, দু'দিন যায় এমনকি পাতিলের গোস্তও শেষ হয়ে যায় যায় কিন্তু ছদরুদ্দীর রুটির দেখা নাই । ছদরুদ্দী আর সহ্য করতে পারছিলো না; জামাই বলে মুখ ফুটে বলতেও বাঁধছিলো । এক রাতে রুটি খাওয়ার তীব্র বাসনা নিয়ে ছদরুদ্দী ঘুমিয়ে পড়ে । ঘুমের ঘরে সে স্বপ্নে দেখে তার শালী তার সামনে ঝাঁপি ভর্তি রুটি আর ঘামলা ভর্তি মাংস রেখেছে । তাকে আর পায় কে ? মনের সূখে ডজন চারেক রুটি আর কেজি দুয়েক গোস্ত শেষ পরর‌্য্যায়ে নিয়ে গেলেও পুরো চেটেপুটে খেতে পারেনি । বাচ্চাদের ক্যাচ-ক্যাচানি আর বউয়ের পাহাড় নাড়ানোসম ধাক্কায় ছদরুদ্দীর ঘুম ভাঙ্গে । যদিও ছদরুদ্দী পুরোটা শেষ করতে পারেনি তবুও তার চোখে-মুখে তৃপ্তির ছাপ । বহুদিন ধরে লালিত রুটি ভক্ষণের স্বপ্ন কিছুটা হলেও তো পূরণ হয়েছে ! কাক ডাকা ভোরে বউয়ের চিৎকার আর শ্বাশুড়ী-শালীদের উপস্থিতি ছদরুদ্দীনকে ভড়কে দিয়েছে । ছদরুদ্দীন ভেবেই পাচ্ছে না তার অপরাধ কি ? খেয়েছে তো মাত্র কয়খানা রুটি ! বউ যখন শরীরের জড়ানোর ছিন্ন-বিছিন্ন পাতলা কাঁথাখানা উঁচিয়ে ধরলো তখন ছদরুদ্দীনের অসহায় মূখ দেখে শ্বাশুড়ী তার মেয়েকে ধমক দিয়ে বলেছে, স্বপ্নের মধ্যে কত কিছুই তো হতে পারে ? সবাইকে যারা যার কাজে যাওয়ার আদেশ দিয়ে শ্বাশুড়ীও কিছুটা মুখ চেপে রুমের বাহিরে বের হয়ে গোলো । তবে আশার কথা, সেদিন দুপুরে ছদরুদ্দীর ভাগ্যে বাস্তবের রুটি আর মাংসের ঝোল জুটেছিলো । তবে সমস্যাও কম বাঁধে নি । স্বপ্নে খাওয়া রুটি আর বাস্তবের রুটি ছদরুদ্দীর পেটে এমনভাবে গোলযোগ বাঁধিয়েছিলো যার অসহ্য যন্ত্রনায় বাধ্যে হয়ে তিনি বউকে কথা দিয়েছিলো আর কোনদিন রুটি খাওয়ার বায়না ধরবে না । আজকের লেখার সাথে উপরোক্ত গল্পের কোনই মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না তবুও দেশময় আলোচিত গম নিয়ে লিখতে বসেছি তাই ভাবলাম গমের আটা থেকেই যেহেতু রুটি তৈরি হয় কাজেই কেচ্ছাটা একটু বলে নিই ।

সম্প্রতি ব্রাজিল থেকে ৪'শ কোটি টাকার গম আমদানি করে আলোচিত খাদ্যমন্ত্রী মহোদয় বেশ সমালোচিত হচ্ছেন । খাদ্য মন্ত্রনালয় সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তাদের খোদ প্রধানমন্ত্রী তিরস্কার করেছে বলেও শোন যাচ্ছে । তবুও কামরুল ইসলাম গমের সুনাম বর্ণনা করেই যাচ্ছেন । সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের নিজস্ব পরীক্ষাগার থেকে গমের শারীরীক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানানো হয়েছে গমে কোন সমস্যা নাই । কিন্তু সমস্যা বাঁধিয়েছে সাংবাদিক এবং পুলিশ । স্টেট রিলিফ, কাজের বিনিময় খাদ্যসহ কয়েকটি সরকারী প্রকল্পে আমদানীকৃত গম বন্টনের সিদ্ধান্ত ছিলো । গমের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ময়দার মিলেও দেয়া হয়েছে । তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা ও শোনা গেছে, আমদানীকৃত এসব গম অপুষ্ট, খাবার অযোগ্য ও নিম্ন মানের, আকারে অত্যন্ত ছোট, পঁচা ও দূর্গন্ধযুক্ত । পুলিশ ও সেনাবাহিনীর রেশনের নামে চালিয়ে দেওয়ার দাবী ওঠার পর সমস্যা আরও গুরুতর হয়েছে । পুলিশ প্রশাসন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে চিঁঠি দিয়ে জানানো হয়েছে এ গমের আটা থেকে বানানো রুটি খেয়ে পুলিশ অসুস্থ হয়ে পড়ছে । স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় আবার খাদ্যমন্ত্রনালয়কে এ বিষয়টি জানিয়েছে । চক্রাকারে কয়েক'শ কোটি টাকার গম নিয়ে বেশ বিপত্তিতে পড়েছে খাদ্যমন্ত্রী ও তার মন্ত্রনালয় । সমস্যা হয়ত এতটা প্রকট হতো না কিন্তু খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রনালয়ের কর্মকান্ডের গত দেড় বছরের অপকর্মের রিপোর্ট সাবেক একজন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে পাঠিয়েছে । আমাদের দেশে সাধারণত ফ্রান্স এবং ব্রাজিল থেকে গম আমদানী করা হয় । অতীতের প্রত্যেকবারে শত শত কোটি টাকার গম আমদানি করা হলেও এবারের মত প্রকট সমস্যা কোন বার দেখা দেয়নি যদিও প্রত্যেকবার গমের মান নিয়ে কম বেশি প্রশ্ন উঠেছে । গম নিয়ে ব্যাপক তোলপার সৃষ্ট হওয়ার পর সবশেষ এবারের গমের মান নির্ণয়ের জন্য হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে । কোন নিরপেক্ষ পরীক্ষাগার থেকে পরীক্ষা করিয়ে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সে রিপোর্ট হাইকোর্টে দাখিল করার জন্য বলা হয়েছে । অচিরেই জাতি গমের ভবিষ্যত জানতে পারবে তবে গমের মান ভালো হলে খাদ্যমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ যেভাবে রক্ষা পাবে সেভাবে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকাও অপচয়ের কবল থেকে রক্ষা পাবে । কিন্তু যদি গম খাবার অযোগ্য ঘোষণা হয়েই বসে তবে আলোচিত মন্ত্রী কিভাবে পরিস্থিতি সামলাবেন সেটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার কিন্তু রাষ্ট্রের শত কোটি টাকা যে ক্ষতির মুখে পড়বে তা নিশ্চিত করেই বলা যায় । আমদানির শুরু থেকেই যদি গম খারাপ হয় তবে এখানে যেমন কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে তেমনি খাবার অনুপোযোগী হাজার হাজার টন গমের পরিণতি কি হবে তাও যথেষ্ট গুরুত্বের সহকারে আলোচিত হচ্ছে । ছদরুদ্দী বেঁচে থাকলে হয়ত তাকে কয়েকখানা প্রমাণ সাইজের রুটি করে খাওয়ানো যেতো কিন্তু সে উপায়ও তো নাই ! মূলকথা, সবকিছুর পরেও আর্থিক গচ্ছা রাষ্ট্রেরই হচ্ছে । আর রাষ্ট্রের টাকা মানেই তো সাধারণ মানুষের ঘাম জড়িয়ে অর্জিত টাকা ।

জাতি হিসেবে আমাদের দূর্ভাগ্য, আমরা মন্ত্রীদের কথায় বিশ্বাস রাখতে পারিনা । আমরা যাদেরকে আমাদের দায়িত্বশীল বানিয়েছি কিংবা যারা আমাদের দায়িত্ব নিয়েছে তাদের কতিপয়ের কর্মকান্ড শুধু তাদেরকেই বিতর্কিত করেনা বরং আমাদেরকেও লজ্জা ফেলে । যখন সাধারণ মানুষ কর্তৃক রাষ্ট্রের একজন অভিভাবকের ঘোষণার বিরোধীতা হয় এবং বিরোধীতা করে বিরোধীপক্ষ জয়ী হয় তখন সত্যিকারার্থেই কষ্ট লাগে । খাদ্যমন্ত্রী যখন বলেছেন, ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত গম মানসম্মত তখন আমরা যদি তার কথাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে পারতাম তবে তা জাতির জন্য কতই-না মঙ্গলের হত । কিন্তু পারছি কই ? টিভি কিংবা পত্রিকায় গমের যে বিবরণ পড়েছি কিংবা দেখেছি তাতে পরীক্ষাগারে এ গমের ভবিষ্যত যেভাবেই নির্ধারণ করা হোক না কেন এ গম থেকে বানানো রুটি কিংবা অন্যকোন খাদ্য মুখে তোলার রুচি কি আদৌ জন্মাতে পারব ? ক্ষুধার তাড়নায় কাতর শ্রেণীকে রিলিফ কিংবা শ্রমের বিনিময়ে গছিয়ে দেয়া যাবে ঠিক কিন্তু নৈতিকতা তো মরেই গেলো । ব্রাজিল থেকে আমরা গম রিলিফ কিংবা অনুরোধ করে আন্তর্জাতিক বাজার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দাম দিয়ে কিনে আনিনি । ন্যায্য দাম দিয়ে যে পণ্য কিনবো সে পণ্য নিয়ে সমালোচনার সুযোগ থাকবে কেন ? গমের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্র কর্তৃক বরাদ্ধকৃত টাকা এবং গমের মূল্য পরিশোধের পরিমানের মধ্যে কোথাও কিছুটা হেরফের হয়েছে । যদি তেমনটাই হয় তবে বারবার ঘোষণা দিয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা কি ? আমাদের দেশের মত আর্থিক সংগতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাবে, সে সকল দেশের সরকারী কর্মকর্তা-কর্মাচারীদের চেয়ে আমাদের দেশের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেশি সম্মানী পায় । অথচ দুর্ণীতির ক্ষেত্রেও আমরাই এগিয়ে ।

গম-একটি ইস্যু মাত্র । এ নিয়ে যত আলোচনা-সমালোচনাই হোক ব্যাপারটি মাত্র চার'শ কোটি টাকার । ব্যক্তিগতভাবে চার'শ কোটি টাকাকে আমি টাকার অঙ্কেই বিবেচনা করি না কেননা আমার দেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের একজন চুরি যাওয়া ৪ হাজার কোটি টাকাকেও সামান্য টাকার অঙ্ক মনে করেন ! আমরা তো সে মন্ত্রীকেই মনোনীত করেছি আমাদের অভিভাক হিসেবে । মন্ত্রীর বৃহৎ মনের সামনে আমাদের মন যদি কৃপণতা দেখায় তবে সেটা দেখতে বেমানান ! ১৬ কোটির অধিক মানুষের এ দেশে কয়েক হাজার টন গমে কয়দিন চলবে ? সম্প্রতি চারদিনের বর্ষণে শহরের রাস্তা-ঘাট পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিলো । পানি নেমে যাওয়ার পর রাস্তার বেহাল দশা দেখলে উন্নয়নের বুলির ফসকা গেঁড়ো স্পষ্ট হয়ে যায় । রাস্তার সংস্কার পরবর্তী ৬ মাসও পেড়োয়নি অথচ এক যায়গার পাথর অন্যযায়গায় দলছুট হয়ে পড়ে আছে । রাস্তার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত । এসব গর্তে যখন গাড়ির চাকা পড়ে তখন ঝাঁকুনিতে যাত্রীর কোমড় ভাঙ্গার অবস্থা, প্রচন্ড দোদুল্যমান অবস্থায় ভয়ে আঁৎকে উঠতে হয় । উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র বরাদ্ধ করেনা এ কথা বললে নিছক নিন্দা করা হবে কিন্তু বরাদ্ধকৃত অর্থ সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে কিনা সেটা দেখাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব । এ দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র কতটুকু সততার পরিচয় দিচ্ছে তা প্রশ্নবিদ্ধ । কাগজ-কলমে উন্নয়নের জোঁয়ার বসালে তাতে মানুষের মনে শ্রদ্ধার চেয়ে ঘৃণা ও ক্ষোভের জন্ম বেশি হয় । শুধু গম নয় বরং রাষ্ট্রের প্রত্যেকটা ব্যাপারে পরিচ্ছন্নতা ও জবাবদিহীতা থাকা আবশ্যক । এদেশের জনগণ মন্ত্রীদের কথাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে চায় সুতরাং মন্ত্রীরাও যেন জনগণের যে আশাকে মূল্যায়ন করে ।

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।

facebook.com/raju69mathbaria/