ঈদ উপলক্ষে যাত্রাপথ নিরাপদ রাখুন

রাজু আহমেদ
Published : 10 July 2015, 04:06 PM
Updated : 10 July 2015, 04:06 PM

মাত্র কয়েকদিন পরেই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর । চাকুরীজীবি, শিক্ষার্থী এবং অন্যান্য সকল পেশাজীবিরাপবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়িত্বশাসিতসহ কর্মরত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে লম্বা ছুটি পায় । বিভিন্ন কর্ম ব্যস্ততায় যারা বছরের অন্যান্য সময়ে বাড়ীতে যেতে পারে না তারা ঈদের ছুটিকেই আপন নীড়ে ফেরার জন্য বেছে নেয় । নাড়ীর টানে সকলেই প্রিয় জন্মস্থানের মাটিতে পা রাখার, পরিচিত পরিবেশে শ্বাস গ্রহনের, বেড়ে ওঠার স্থানে ফেরার অদম্য স্পৃহা পোষণ করে । ঈদ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকা ও বৃহৎ বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৪ কোটির অধিক মানুষের অস্থায়ী স্থানান্তর ঘটে । পথে নানা বিপত্তি সত্ত্বেও স্ত্রী, পরিবার-পরিজন নিয়ে যেকোনভাবে ঘরে তাকে ফিরতেই হবে । বাবা-মা, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং নিকট আত্মীয় স্বজনের সাথে বছরে একবারের জন্য হলেও মিলিত হতে ইচ্ছা জাগে । মূলত ঈদ উপলক্ষে নগরায়ণের নিয়ত প্রতিযোগিতার যুগেও সৃষ্টি হয় পারিবারিক, সামাজিক অপূর্ব মেলবন্ধনের । গ্রামের দিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠে সকলে একত্রিত হয়ে ঈদের নামাজ আদায়, পরস্পরেকোলাকুলি এবং বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় এবং নাস্তা খাওয়ার আনন্দ জীবনের সকল দুঃখ বেদনাকে ভূলিয়ে দেয় । সকল মান-অভিমানের দেয়াল ভেঙ্গে ঈদের দিন সকলেই বন্ধুতে, আত্মারআত্মীয়সমআপনজনে পরিণত হয় । কারো প্রতি কোন হিংসা-দ্বেষ কিংবা অভিযোগ-অনুযোগের বালাই থাকে না । আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে বেড়ানো, বন্ধুদের সাথে অফুরন্ত আড্ডা, মুরুব্বীদের সাথে শহরের কিংবা কর্মস্থলের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগিতে কেটে যায় ঈদের আনন্দঘন মূহুর্তগুলো । কথায় বলে, সূখের সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায়। ঈদের সপ্তাহব্যাপী ছুটি যে কখন কেটে যায় তার হিসেব যেন মিলতে চায়না। অথচ শহরের কিংবা কর্মস্থলের একটি দিন যে কতটা দীর্ঘ মনে হয় তা ভাবাই যায় না । তবে আনন্দ উপভোগ করার পূর্বে এবং পরে দূর-দূরান্ত থেকে আপন নীড়ে ছুটে আসা কিংবা ফিরে যাওয়া মানুষগুলোকে রীতিমত সংগ্রাম করতে হয় । যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা, টিকেট না পাওয়া, যানবাহন সংকট, সড়ক দূর্ঘটনা, দীর্ঘ জ্যাম ছাড়াও পথে পথে নানা সমস্যার মোকাবেলা করে ফিরতে হয় মাতৃ-পিত্রালয়ে। এ সকল সমস্যার কারণে যাদের শিশু সন্তান আছে তাদেরকে বাড়ী ফেরার আবেগকে কোরবানী দিতে হয় । যাত্রাপথের লম্বা ফিরিস্তির সমস্যায় জীবন ওষ্ঠাগত হবে ভেবে অনেকেই ঈদে বাড়ী ফেরার কথা ভূলে থাকতে চেষ্টা করেন । মনের শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আপনজনকে নানা অজুহাত দেখিয়ে মনের কষ্ট মনে রেখেই শহরের গতানুগতিক বাসস্থানে নিরবে কাটিয়ে দেন বিরক্তিকর সময় । ক্ষনে ক্ষনে উপলব্ধি হয় আপনজন থেকে দূরে থাকার যন্ত্রনা । তবুও নিরুপায় । ইচ্ছা এবং সাধ্য থাকলেও এদেশে সব কাজ সময়মত, সুযোগমত কিংবা ইচ্ছামত করা যায় না । নানা প্রতিবন্ধকতা আটকে দেয় মনের ইচ্ছাকে । জীবনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার নামে খাচায় বদ্ধ করে দেয় । জীবনে নেমে আসে দুঃসহ বেদনা ।

ঈদে ঘরে ফেরার আশায় বুক বাঁধা মানুষগুলোকে সবচেয়ে বেশি দুর্ভাবনায় ফেলে সড়ক ব্যবস্থার বেহাল দশা । সমালোচকেরা বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ পাকা সড়কগুলি গরুর দয়ার উপর নির্ভরশীল । গরু যদি বেরসিক হয়ে একটু গোবর রাস্তাকে উপহার দেয়তবেই সড়কের উপরের অংশ ক্ষয়ে যায় । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সড়ক নির্মানে নিম্নমানের নির্মান সামগ্রী ব্যবহার করা হয় যার কারণে অধিকাংশ সড়ক এক বর্ষা থেকে পরবর্তী বর্ষা মওসুম পর্যন্ত স্থায়ী হয় না । যদিও সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় যথেষ্ট আন্তরিক । দেশের মানুষ যাতে নির্বিঘ্নেচলাচল করতে পারে তার জন্য তারা সড়ক নির্মান, সংস্কার, পূনঃসংস্কারের জন্য বরাদ্দ দিতেই থাকে । তবে সে বরাদ্দে স্থায়ী কোন উপকার হয় বলে মনে হয়না। কোন অদৃশ্য দৈত্য তার আপন শক্তিবলে সড়ক নির্মাণ কিংবা সংস্কারের কয়েক মাসের মাথায় আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেয় ! সড়ক ব্যবস্থার এ চক্রাকার নির্মান এবং সংস্কারের কারণে কিছু লোক ফায়দা অর্জন করলেও যাত্রী সাধারনকে পোহাতে হয় দূর্ভোগের সর্বোচ্চ সীমা । বাস যাত্রাকালে বিশেষ করে বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের রাস্তায় চলার সময় পাজরের হাড় কিংবা মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয় । সুস্থ মানুষ যদি এ রাস্তায় বাসে চলাচল করে তবে সে অসুস্থ হয়ে যায় ।অসুস্থ কেউ গাড়ীতে চড়লে তার তো মরনদশা । তবুও আশার কথা, অতীতের সকল সময়ের চেয়ে এ বছর সড়কের অবস্থা তুলনামূলক ভালো । তবে গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণ এবং সৃষ্ট জলাবদ্ধতা সড়কের অনেক যায়গায় ব্যাপক ক্ষতি ও ক্ষতের সৃষ্টি করেছে । স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেভাবে উন্নতি হয়েছে সেভাবে সড়ক দূর্ঘটনা হৃাসে উন্নতি ঘটেনি । সংবাদপত্রের তথ্যানুযায়ী,দেশের সাড়ে ২১ হাজার কিলোমিটার সড়ক ও মহাসড়কের৭১টি স্থানের কয়েকশ' কিলোমিটার একেবারেই যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে ।তদুপরি ৩ শতাধিক স্থানে গর্তসহ গভীর খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করেঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় ১৫০ ফিট রাস্তার পিচ ঢালাই উঠে গেছে ।অনুরূপভাবে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ৬ কিলোমিটারে বড় বড় গর্ত হয়ে গেছে । বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর জেলার চরখালী থেকে মঠাবাড়ীয়া পর্যন্তের সংযোগ সড়কটিকে বাংলাদেশে সবচেয়ে যুঁকিপূর্ণ সড়ক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এসবকারণে ঈদে সড়কপথে যাত্রীদের দুর্ভোগের পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধিরআশংকা করা হচ্ছে ।সড়ক দূর্ঘটনা বাংলাদেশের নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । বছরের এমন কোন দিন নাই যে দিন সড়ক দূর্ঘটনায় মানুষ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া না যায় । যতজন মারা যায় তার চেয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে কয়েকগুন বেশি । বিশেষ করে ঈদের মওসুমে সড়ক দূর্ঘটনার হার আচমকা বেড়ে যায় । গত ঈদের মওসুমে সারা দেশে শতাধিক মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলো ।বাস চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, বেপারোয়া গতি, চালকদের প্রয়োজনীয় বিশ্রামের অভাবের কারনে শত শত মানুষ অকাল মৃত্যু মুখে পতিত হয় । এ সব মৃত্যু পরিবারের আনন্দ উৎসবের বিপরীতে তখন শোকের বন্যা বইয়ে দেয় ।

দেশের উত্তারাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম যেমন রেলপথ তেমনি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম নৌপথ । ইতোমধ্যে রেল, লঞ্চ এবং স্টিমারের অগ্রিম টিকিট বিক্রি কার্যক্রম শুরু হয়েছে । মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট সংগ্রহ করছে । তবে টিকেট প্রার্থীরা টিকেট বন্টনের স্বচ্ছতা নানা অভিযোগ তুলেছে। ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের আকাঙ্খিত টিকেট যখন কালোবাজারিতে যায় তখন সেটা সত্যিই দুঃখজনক । দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষার শেষে টিকেট কাউন্টারে পৌঁছে যখন শুনতে হয় টিকেট শেষ তখন হতাশার সীমা থাকে না । তবে বৈধ টিকেট শেষ হলেও অবৈধ টিকেট যেন শেষ হবার নয় । টিকেটের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কয়েকগুন বেশি দাম পরিশোধ করলেই দালালদের মাধ্যমে টিকিট ঠিকই জোগাড় করে নেয়া যায় । শুধু যে রেল, লঞ্চ এবং স্টিমারের টিকেট কালোবাজারীতে যায় তা নয় বরং সরকার পরিচালিত বিআরটিসিসহ প্রাইভেট বাস সার্ভিসগুলোর টিকেটও কালোবাজারিতে যায় । অতীত অভিজ্ঞতা বলে, প্রাইভেট সার্ভিসগুলোর চেয়ে সরকারি সার্ভিস গুলোর টিকেট কালোবাজারীর কবলে পড়ে বেশি । তাছাড়াও ঈদ উপলক্ষে টিকেটের দাম কয়েকদফায় কয়েকগুন বৃদ্ধি করা হয় । ঈদে অধিক মুনাফা লাভের আশায় আনফিট লঞ্চ, বাস চালু করা হয় । ট্রেনেও ঝুঁকিপূর্ণ কিছু বগি সংযোগ করা হয় । এ সকল আনফিট বাহনে ধারন ক্ষমতার চেয়ে অধিক যাত্রী বহনের ফলে দূর্ঘটনা সম্ভাবনা অধিকহারে বেড়ে যায় এবং জীবন হুমকির মূখে পতিত হয় । ঈদ উপলক্ষে মলম পার্টি, হাইজাক পার্টি, পকেটমার, ডাকাতসহ পুরান এবং উঠতি সন্ত্রাসীদের বেপারোয়া চাঁদাবাজি বেড়ে যায় । এ কারণে মালের সাথে জীবনও হুমকির সম্মূখীন হয় ।

আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে সরকারী কর্তৃপক্ষকে নজড়দারি বাড়াতে হবে । বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের সদস্যদের, পুলিশ এবং অন্যান্য সরকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দিলে ঘরে ফেরা মানুষেরা নির্বিঘ্নেএবং শান্তিতে ঈদ কাটাতে এবং পূনরায় স্থায়ী-অস্থায়ী আবাসস্থলে ফিরে আসতে পারবে । যে সকল বাস, লঞ্চ মালিকরা যোগাযোগের অযোগ্য বাহন ব্যবহার করার চেষ্টা করবে তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে । যারা অবৈধভাবে কালোবাজারিতে অধিক মুনাফার আশায় টিকেট বিক্রি করে তাদেরকে চিহ্নিত করে জনসমক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে । ঈদ উপলক্ষে যে সকল মানুষ অনৈতিক কার্যকলাপে জড়ায় তাদের চিহ্নিত করে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে । সর্বোপরি মানুষ যেন শান্তিতে ঈদ উৎসব পালন করতে পারে তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা এবং খুশির আবহ যেন শোকে ভেসে না যায় তার নিশ্চয়তা বিধান করা জরুরী । ঈদ উপলক্ষে যে সকল যাত্রীরা বাড়ী ফিরবার আশা করেন তাদেরকে মনে রাখতে হবে, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশ । একটি দূর্ঘটনা সারা জীবনের কান্নার কারণ । কাজেই যাত্রা পথে সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক ।

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।

raju69alive@gmail.com