ক্রন্দনের ভাষাও হারিয়ে ফেলেছি

রাজু আহমেদ
Published : 8 Dec 2015, 02:33 PM
Updated : 8 Dec 2015, 02:33 PM

….আপনারাই বলেন, আপন বোনকে কি কেউ ধর্ষণ করতে পারে ? কিশোর তাশফিকের এ জিজ্ঞাসা শুনে আঁৎকে উঠেছি । পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের কবর কবিতার পংক্তিদ্বয় দ্বারা নিজেকে স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করেছি । কবির ভাষায়, 'তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে, সারা দুনিয়ায় যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুঃখে ।' তাশফিক ও তার পরিবারের অসহায়ত্বের বিবরণ শুনে চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছিল, হৃদয়ের ক্ষতগুলো আরও বেদনার্ত হচ্ছিল । বোন ধর্ষিতা হবার পর বিচার চাইতে গেলে যদি বিচারপ্রার্থীকেই ধর্ষক সাজিয়ে গ্রেফতার করা হয়, ইলেকট্রিক শক দিয়ে অজ্ঞান করা হয়, অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় তবুও কি স্বীকার করতে হবে ন্যায় বিচারের দরজা উম্মুক্ত ? দেশে ধর্ষণের ঘটনা বিরল নয়, নিত্যদিন বিভিন্ন কারণে গ্রেফতার হওয়াদের সংখ্যাও নিছক কম নয় কিন্তু চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় যা ঘটল তাকে সভ্যতা-অসভ্যতার কোন দৃষ্টান্তের সাথে তুলনা করা চলে ? ভেবে পাইনা, কোন সমাজে এসে পড়লাম । নিরাপত্তা-বিচার চাওয়ার অধিকারও কি মানুষ হারিয়ে ফেলেছে ? প্রকৃত অপরাধীকে পাকড়াও করার পরিবর্তে এখন শাস্তি পেতে হবে অভিযোগকারীকে ? অর্থ ভৈববের কাছে ন্যায় জিম্মি হয়ে যাচ্ছে ? যাদের টাকা আছে, প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে শুধু তাদের পক্ষেই কি আইন-বিচার সাফাই গাইবে ? যাদের দায়িত্ব সমাজ থেকে ধর্ষক নির্মূলের তারাই যদি ধর্ষকদের রক্ষা করার গুরু দায়িত্ব পালন করে এবং নিরীহ-পবিত্র রক্তসম্পর্কীয়দের ধর্ষক সাজিয়ে দেয় তবে নৈতিক মুক্তির আশা বাঁচিয়ে রাখব কিভাবে ?

আমি মোটেও অবাক হতাম না যদি ধর্ষিতার আপন ভাই ছাড়া অন্য কোন নিরাপরাধকে ধর্ষক সাজানো হত, একটুও বিস্মিত হতাম না যদি নিরাপত্তার অজুহাতে লক্ষ মানুষে গারদে ঢোকানো হত । কেননা এমন খেলা অতীত থেকে বেশ পাকাপোক্তভাবেই এই সমাজে চলমান । কিন্তু রাঙ্গুনিয়ার তাশফিক-বোন ও তার পরিবারের সাথে যে আচরণ করা হল তা সভ্যতার কোন স্তরের সাথে খাপ খায় ? ঘৃণায় থুতু নিক্ষেপের রুচিও হারিয়ে ফেলছি । অর্থ প্রাপ্তি কিংবা অন্য এমন কোন স্বার্থে লজ্জা-ঘৃণার জঘন্য ঘটনাটির জন্মাদিতে হল ? অর্থের প্রভূত্ব কি মানবতা, বিবেকবোধ, শিক্ষা, রুচি কিংবা সংস্কার চিবিয়ে গিলে ফেললো ? তবে কি রুচিশীল মানুষের বাস অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে ঘুণে ধরা এই সমাজ ?

যারা সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার দূর করবে তারাই যদি অবিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেয় তবে সাধারণ মানুষের উপায় কি ? তাশফিকের পরিবারের ভাগ্যে ন্যায় বিচারের প্রাপ্তি ঘটুক কিংবা না ঘটুক তাদেরকে বস্তুত এই সমাজে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে । তাদের যে সম্মানহানি করা হয়েছে সে সম্মান কিসের বিনিময়ে ফিরিয়ে দেয়া যাবে । কে দেবে তাশফিকের জিজ্ঞাসার জবাব ? কৈফিয়ত দেয়ার সৎ সাহস কি কারো অবশিষ্ট আছে ? অবক্ষয়ের ভাইরাস পুরোপুরি আক্রমন করার আগেই তা নির্মূল করার ব্যবস্থা গ্রহন না করলে আমাদের পরিণতি কোনভাবেই মঙ্গলময় হবে না । প্রয়োজনানুসারে যথার্থ ব্যবস্থা না নিলে হয়ত একদিন নাকের পানি চোখের পানি একসাথ করে কেঁদেও সমাধান পাওয়া যাবে না । দিন দিন বিভিন্ন ঘটনার চাদরে আবৃত দুর্ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে মনে হচ্ছে, এ জাতি কান্না করার শক্তিও হারাতে চলছে; যেহেতু ক্রন্দন অবিরাম কোন প্রক্রিয় নয় ।

রাষ্ট্রের কাছে আকুতি, রাঙ্গুনিয়ার ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত করুণ । খুঁজে বের করুণ আসল সত্য । তাশফিকের দাবী যদি সত্য হয়, তবে দোষীদের এমন কঠোর শাস্তি প্রদান করুন যাতে ভবিষ্যতে এমন অপরাধের সাথে কেউ যুক্ত হওয়া তো দূরের কথা এমন অপরাধ প্রবনতা মনে জাগ্রত হলেই ভয়ে আঁৎকে ওঠতে হয় । যদি কোনকারণে একান্তভাবে ন্যায় বিচারের প্রতিবন্ধকতা থাকে তবে দোষীদের যত টাকা দরকার তা দান করুণ (!) যাতে তারা অন্তত টাকার বিনিময়ে বোনের বানোয়াট ধর্ষক সাজিয়ে ভাইকে গ্রেফতার না করে । টাকার অভাব থাকলে তাও বলুন, আমরা রক্ত বিক্রি করে হলেও টাকা দিতে রাজি আছি । তবুও আমাদের ভূখন্ডকে মানুষের বাস উপযোগী দেখতে চাই ।