ভালো কলেজ ও মন্দ কলেজ নিয়ে দুটি কথা

মো. রহমত উল্লাহ্‌
Published : 16 Oct 2014, 07:14 PM
Updated : 16 Oct 2014, 07:14 PM

যায়যায়দিন > ১৩ অক্টোবর ২০১৪

ভালো কলেজ ও মন্দ কলেজ নিয়ে দুটি কথা
[ভালো কলেজগুলোয় কি সরকারি কলেজের শিক্ষকদের চেয়ে অধিক যোগ্য শিক্ষক ও প্রশাসক কাজ করছেন? সুযোগ-সুবিধা কি সরকারি কলেজের চেয়ে বেশি? নিশ্চয়ই না। তাহলে তাদের এত ভালো ফলাফলের আসল কারণ কী? অবশ্যই অনেক কারণ বিদ্যমান। তবে প্রধানত দুটি। প্রথম কারণ হলো_ তারা বাছাই করা ভালো শিক্ষার্থী নিয়ে কাজ করেন। দ্বিতীয় কারণ হলো_ তারা অধিকাংশই কমিটির প্রভাব থেকে কম-বেশি মুক্ত।]
মো. রহমত উল্লাহ্
বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশন ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস (বেনবেইস) থেকে পাওয়া ২০১২ সালের তথ্য আনুসারে আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের (একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির) কলেজ ১ হাজার ৯৩৬টি, প্রভাষক বা সহকারী অধ্যাপক ৩৩ হাজার ৮৪৩ জন এবং শিক্ষার্থী ৫ লাখ ৫০ হাজার ৫৭৯ জন। এই হিসাব অনুসারে দেখা যায়, গড়ে প্রতি একটি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে শিক্ষক (প্রভাষক বা সহকারী অধ্যাপক) রয়েছেন প্রায় ১৮ জন এবং শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ২৮৫ জন। গড়ে প্রতি ১৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন একজন শিক্ষক। লেখাপড়া ভালো হওয়ার জন্য এরূপ অনুপাত থাকা ভালো। কিন্তু বাস্তবে এই অনুপাতের আর্ধেকও কার্যকর নেই। কারণ, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব।
বাছাই করা ভালো শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বে ভালো কলেজ নামে খ্যাত শহরকেন্দ্রিক কিছু কলেজে রয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। এখানে শিক্ষকের তুলনায় শিক্ষার্থীর সখ্যা আদর্শ অনুপাতের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। তদুপরি তাদেরই অনুমতি দেয়া হচ্ছে একাধিক শিফট ও শাখা খুলে আরো বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করার। অপরদিকে, সারাদেশে বিদ্যমান হাজার হাজার কলেজে রয়েছে কাম্য শিক্ষার্থী তীব্র অভাব। ৫০ থেকে ১০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বছরের পর বছর চলে আসছে এমন দু-চারটি করে কলেজ পাওয়া যাবে প্রতিটি উপজেলায়ই। এমন কী রাজধানী ঢাকার প্রতিটি থানায়ই রয়েছে ৫-৭টি করে কলেজ, যেখানে কাম্য শিক্ষার্থী না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে করা হচ্ছে না কলেজের স্বীকৃতি নবায়ন। শিক্ষকের তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা আদর্শ অনুপাতের চেয়ে অনেক কম হলেও এসব কলেজের শিক্ষক, প্রশাসক, ভবন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় আনা হলে সবই যে মন্দ, তা কিন্তু নয়।
অন্যদিকে, ভালো কলেজ তৈরির নামে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তৈরি করা হচ্ছে আরো নতুন নতুন কলেজ। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে মডেল কলেজ নামে ঢাকা শহরে তৈরি করা হয়েছিল ১২টি কলেজ। ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের পেটের ভেতরে তৈরি করা হয়েছে মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, যেখানে বরাবরই অধ্যক্ষ হিসেবে ডেপুটেশনে থাকছেন সামরিক কর্মকর্তা। মিরপুরের মণিপুর স্কুলের ২ নাম্বার শাখার পাশে স্থাপন করা হয়েছে রূপনগর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। শুরুতেই সেখানে অধ্যক্ষ ছিলেন সরকারি কলেজের অধ্যাপক। সরকারি কলেজের সমান বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি দিয়ে এসব মডেল কলেজে নিয়োগ করা হয়েছে ভালো ভালো শিক্ষক। সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয় করে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল বিশাল দালান। দেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় বিজ্ঞানসামগ্রী, খেলার সামগ্রী, কম্পিউটার ও আসবাবপত্র। এতকিছুর পরও কোনো একটি মডেল কলেজের নাম কেন নেই তথাকথিত ভালো কলেজের বর্তমান তালিকায়? কারণ, তাদের শুরুটা প্রচলিত ভালো কলেজের মতো ছিল না। শুরুতেই যদি তারা কেবল বাছাই করা ভালো শিক্ষার্থী ভর্তি করত (কম হোক), তাহলে ফলাফল অবশ্যই ভালো হতো। নাম যুক্ত হতো তথাকথিত ভালো কলেজের তালিকায়। ছড়িয়ে পড়ত নাম-সুনাম। ভালো কলেজ ভালো কলেজ বলে বলে ভর্তি হওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ত সারাদেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থী-অভিভাবক। এরপর আর কে থামায়? বাছাই কর, ভর্তি কর, কোচিং কর আর টাকা আদায় কর। কিন্তু তারা বাছাই করা ছাত্রছাত্রী নিয়ে এবং ভালো ফলাফল দিয়ে স্থাপন করতে পারেনি বিশেষ কোনো মডেল। তাই দূরের মানুষ তো দূরের কথা, সংশ্লিষ্ট এলাকার সাধারণ মানুষই ভালোভাবে জানেন না এই ১২টি মডেল কলেজের নাম-ঠিকানা। ভালো অধ্যক্ষ, ভালো শিক্ষক, বড় দালান, ভালো চেয়ার-টেবিল, দামি কম্পিউটার আর ভালো এলাকা থাকলেই যে বর্তমানে প্রচলিত হুজুগে বিবেচনায় ভালো কলেজ হয় না, তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ হেেলা এই মডেল কলেজ এবং খোদ সরকারি কলেজগুলো।
এসব বাস্তব বিষয় বিবেচনা না করেই বিপুল সরকারি অর্থ ব্যয়ে স্থাপন করা হচ্ছে আরো নতুন নতুন কলেজ। তীব্র থেকে আরো তব্রতর করা হচ্ছে বিদ্যমান কলেজগুলোয় শিক্ষার্থী সঙ্কট। বিশেষ করে গ্রামপর্যায়ে শিক্ষার্থী সঙ্কট তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। তথাপি রাজনৈতিক নেতাদের অতি আগ্রহে কোনোরূপ হিসাব-নিকাশ না করেই বিদ্যমান সরকারি-বেসরকারি কলেজের আশপাশে দেদার তৈরি বা এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে আরো সাধারণ কলেজ, কারিগরি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা, নার্সিং কলেজ, মেডিকেল টেকনোলজি কলেজ, ফ্যাশন ডিজাইন কলেজ, ইউরোপিয়ান কলেজ, আমেরিকান কলেজ, ব্রিটিশ কলেজ, অ্যারাবিয়ান কলেজ ইত্যাদি। নাম রাখা হচ্ছে নিজের বা নেতার নামে। নিয়োগ দেয়া হচ্ছে দলীয় লোকজন। পরিচালিত করা হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকা-। কাম্য শিক্ষার্থী না থাকলেও পরিশোধ করতে হচ্ছে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা।
ভালো কলেজগুলোয় কি সরকারি কলেজের শিক্ষকদের চেয়ে অধিক যোগ্য শিক্ষক ও প্রশাসক কাজ করছেন? সুযোগ-সুবিধা কি সরকারি কলেজের চেয়ে বেশি? নিশ্চয়ই না। তাহলে তাদের এত ভালো ফলাফলের আসল কারণ কী? অবশ্যই অনেক কারণ বিদ্যমান। তবে প্রধানত দুটি। প্রথম কারণ হলো_ তারা বাছাই করা ভালো শিক্ষার্থী নিয়ে কাজ করেন। দ্বিতীয় কারণ হলো_ তারা অধিকাংশই কমিটির প্রভাব থেকে কম-বেশি মুক্ত।
আলোচিত ভালো কলেজগুলোর আশপাশে অবস্থিত কোচিং সেন্টার ও শিক্ষকদের প্রাইভেট বাণিজ্যকেন্দ্রগুলোর দিকে সামান্য নজর দিলে সহজেই বোঝা যায় সেসব কলেজে কেমন লেখাপড়া হয়। যাদের ছেলেমেয়ে সেসব কলেজে পড়ে, তারা কলেজের বেতন-ফি ও কোচিং-প্রাইভেট পড়ার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পান ভালো কলেজ কাকে বলে। আমাদের অনেকেরই ধারণা, সামরিক বাহিনীর অফিসার অধ্যক্ষ হলেই কলেজ ভালো হয়ে যায়। এই ধারণাটি যে সর্বাংশে সত্য নয়, তার প্রমাণ হচ্ছে নরসিংদী কাদির মোল্লা সিটি কলেজ। বাংলা বিষয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও লেখক ডক্টর মশিউর রহমান সেখানকার অধ্যক্ষ। অত্যন্ত বিনয়ী ও কর্মঠ আমার সে বন্ধুটি। মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি কলেজের অধ্যক্ষ বন্ধুবর বেলায়েত হোসেনও সামরিক লোক নন। আসলে পরিচালনা কমিটির অশুভ প্রভাবমুক্ত না হলে সামরিক বা বেসামরিক কারোরই কিছু করার থাকে না।
শুধুমাত্র বাছাই করা ভালো শিক্ষার্থী ভর্তি করার সুযোগ দিয়ে এবং সেই সব ভালোদের ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে সেরা কলেজ ঘোষণা দিয়ে সরকার নিজেই করে দিচ্ছে তাদের এই শিক্ষা বাণিজ্য করার অবাধ সুযোগ। অথচ এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে এ, বি, সি, ডি_ সব গ্রেডের শিক্ষার্থী ভর্তি করা বাধ্যতামূলক করে দিলেই দেখা যেত ভালো সুতা দিয়ে ভালো কাপড় বোনা সেই সব কারিগরদের দক্ষতা কতটুকু। সেক্ষেত্রে মন্দ কলেজ নামে চিহ্নিত কলেজেও ভর্তি হতো কিছু ভালো শিক্ষার্থী। সেসব কলেজ থেকেও পাওয়া যেত কিছু ভালো ফলাফল। কিছুটা হলেও কমে আসত ভালো-মন্দের ব্যবধান। শহরমুখী হতো না সবাই। হ্রাস পেত ভালো কলেজ নামে পরিচিত কলেজে ভর্তির অসুস্থ প্রতিযোগিতা। হ্রাস পেত এই শিক্ষা বাণিজ্যের অবাধ সুযোগ। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মনে এতটা আঘাত হানত না তথাকথিত ভালো কলেজে ভর্তি হতে না পারার অযৌক্তিক কষ্ট।

মো. রহমত উল্লাহ্: অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, ঢাকা
ৎধযধসড়ঃ২১@মসধরষ.পড়স – See more at: http://www.jjdin.com/?view=details&archiev=yes&arch_date=13-10-2014&type=single&pub_no=979&cat_id=1&menu_id=19&news_type_id=1&index=1#sthash.yK93EzGX.dpuf