সাংবিধানিক বিতর্ক

রাসেল পারভেজ
Published : 27 April 2011, 04:00 PM
Updated : 27 April 2011, 04:00 PM

কলহপরায়ন দুই নারী এবং তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত দেশের প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দলের স্যাঙাত ও সমর্থকদের ভেতরে এই দুই নারীর স্বামী ও পিতার ঐতিহাসিক ভুমিকার পরিমাণ ও গুরুত্ববিবেচনার বিবাদে আটক বাংলাদেশের ইতিহাস। এই বিবাদে অনর্থক জড়িয়ে পড়েছেন দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, তারা বিভিন্ন সময়ে এই দুইজন ঐতিহাসিক মহাপুরুষের বিভিন্ন কর্মকান্ড এবং তাদের ঐতিহাসিক ভুমিকার পরিমাণ নির্ধারণ করেন, সেইসব ভাষ্যের পরিমাণ ও প্রকৃতি রাষ্ট্রক্ষমতায় এই দুই নারীর তৎকালীন অবস্থানের প্রেক্ষিতে নির্ধারিত হয়, এই সময়ে যেমন সারা দেশে কাকের ডাকের মতো শেখ মুজিব শেখ মুজিব মাতম শোনা যাচ্ছে, তবে অবস্থা বদলালে একই গণমাধ্যম শহীদ জিয়া শহীদ জিয়া কলরবে মুখর হয়ে উঠবে। তবে এই পারিবারিক বিবাদ কিংবা দুই মহিলার ব্যক্তিগত স্মৃতিবিজরিত রাজনীতির ময়দানে নতুন বিতর্ক উস্কে দিতে সংবিধান সংশোধনী প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।

সংবিধান সংশোধনী কমিটি প্রস্তাব করেছে শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভুমিকা সম্পর্কে কোনো দ্বিমত না থাকলেও তাকে এভাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের অত্যুৎসাহ বরং তার ভূমিকাকে আরও সংকীর্ণ করে ফেলবে। জাতির পিতা হিসেবে শেখ মুজিবকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে এমন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো কেনো সংবিধান সংশোধনী কমিটি , অধিকাংশ সদস্য আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ এবং তারা ক্ষমতার প্রকৃত স্বাদ বঞ্চিত বিধায় এটাকে প্রধানমন্ত্রীকে ঊপঢৌকনস্বরূপ প্রদান করতে চাইছেন তারা। তাতে কি শেখ মুজিবের প্রকৃত অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে পরিপূর্ণ ভাবে।

সংবিধান লিখিত কিংবা অলিখিত অবস্থায় রাষ্ট্রপরিচালনার নিয়মাবলী লিপিবদ্ধ রাখে, বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কি ধরনের বিধানে পরিচালিত হবে রাষ্ট্র এটা নির্ধারণ করার সাথে সাথে সংবিধান রাষ্ট্র এবং নাগরিকের সম্পর্কও নির্ধারণ করে দেয়। রাষ্ট্র যদিও নির্মিত হয় মানুষের কল্পনায় এবং বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ায় সে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় কোনো নির্দিষ্ট ভৌগলিক ভূখণ্ডে, বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সম্পূর্ণ পর্যায়টিতেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র নির্মিত হয়েছিলো এই দেশের বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিকদের কল্পনায়, পরবর্তীতে উনিশ শ একাত্তর সালের মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খান অধিবেশন স্থগিত করবার ঘোষণা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই রাষ্ট্রের ভ্রূণ বিকশিত হতে শুরু করে, অসহযোগ আন্দোলনের তিন সপ্তাহে এই রাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এবং রাষ্ট্র পরিচালনা নীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করে বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ, সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে অধিকাংশ রাজনৈতিক সচেতন মানুষ আশা করেছিলেন শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন কিন্তু তিনি " এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম" ঘোষণা দিলেও স্পষ্ট করে স্বাধীনতা আন্দোলন সূচনার কোনো বক্তব্য দেন নি। পঁচিশে মার্চের গণহত্যার পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘটে, এবং স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম লাভ করে।

মুজিবনগর সরকার শোষণ ও বৈষম্য বিহীন সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশ সংবিধানের আনুষ্ঠানিক মূলনীতির কাঠামো প্রদান করেন, সেই কাঠামোর ভিত্তিতেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হওয়ার কথা , দুঃখজনক ভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সেভাবে বিকশিত হতে পারে নি, আওয়ামী লীগ দীর্ঘ দিন ধরেই সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাংবিধানিক পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার দাবীতে আন্দোলন করলেও পরবর্তীতে তারাই সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতি পরিচালিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার সূচনা করে, এর ফলেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী পরিষদের স্পষ্ট পরামর্শ ও নির্দেশনা ব্যতিরেকে অধ্যাদেশ বলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা অর্জন করেন রাষ্ট্রপতি, তিনি সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে সম্রাট বিবেচিত হতে পারেন, কারো পরামর্শের তোয়াক্কা না করে তিনি নিজের ইচ্ছেমতো অধ্যাদেশ প্রণয়ন করতে পারেন এবং সেসব অধ্যাদেশকে আইনী বিধানে পরিণত করতে পারেন, এর জন্য তার কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে না কিংবা সংবিধান তাকে জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিয়েছে।

সংবিধান বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জনের ইচ্ছায় সংশোধিত এবং বিতর্কিত হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা, সকল মানুষের সমান অধিকার, রাষ্ট্র এবং নাগরিক অধিকার এবং জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন অধ্যাদেশ পরিবর্তিত হওয়ায় স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও বৈষম্য ক্রমবর্ধমান এবং এই বৈষম্য নিয়ন্ত্রন কিংবা সহনীয় পর্যায়ে রাখবার কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ চোখে পড়োছে না। রাষ্ট্রের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী কাঠামোর আন্তঃসম্পর্ক এবং তারা কিভাবে পরিচালিত হবে এসব বিধিবিধানও পরিবর্তিত হয়েছে এবং পরস্পর বিরোধিতার কারণে মূলত এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়েছে।

শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় আইনী কাঠামো তৈরি হতে পারে নি সরকারী হস্তক্ষেপে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংকুচিত করে এ সম্ভবনা হত্যা করা হয়েছিলো, এক দশক আছে আদালত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে রায় প্রদান এবং সে রায় বাস্তবায়নে সরকারকে চাপ প্রদান করবার পরও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সীমিত রাখবার বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছেন রাজনীতিবিদগণ।

জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা এবং রাষ্ট্রীয় বিধানের ভেতরের সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সেটা নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনার জন্য সংবিধান বিশেষজ্ঞদের গণমাধ্যমে বিতর্ক এবং বিভিন্ন পরিবর্তনের সুপারিশ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবার সুযোগ প্রদান করতে অনাগ্রহী সরকার। দেশের দায়িত্বশীল সংবাদ মাধ্যমগুলো এ বিষয়ে নিজস্ব উদ্যোগে বিতর্ক উত্থাপন ও বিতর্ক অব্যহত রাখবার কোনো উদ্যোগ গ্রহন করে নি, এটা কি সরকারের দূরদর্শিতার অভাব না আন্তরিকতার অভাব এটা নিয়ে পরবর্তীতে হয়তো নতুন বিতর্ক উত্থাপিত হবে, তবে বাস্তব কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন সংবিধান সংশোধকেরা দুই মহিলার কাছেই চিঠি পাঠিয়েছেন, তারা সংবিধানে কি কি পরিবর্তন চান সেটা তারা স্পষ্ট উল্লেখ করলে হয়তো দেশকে দীর্ঘ কলহ মুক্ত রাখতে সংবিধান সংশোধন কমিটি সেসব পরিবর্তন করতে সুপারিশ করবে।

শেখ মুজিবকে জাতির পিতা ঘোষনা দেওয়ার প্রেক্ষিতে হয়তো পরবর্তী সময়ে বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে উদ্বুদ্ধ হবে, যদিও এই দুই মহিলার কলহ সমর্থক ও অনুগত আইনজীবীরা টেনে নিয়ে গিয়েছেন আদালত চত্ত্বরে এবং সেখানে হাইকোর্টে আবেদন করে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমান এর গুরুত্ব বিষয়ে বিএনপি যে দাবী করে এই সংক্রান্ত দাবিকে ভ্রান্ত এবং বেআইনী প্রমাণ করা হয়েছে, পরবর্তীতে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে হয়তো রায়ও পরিবর্তিত হতে পারে তখন জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষক হওয়ার আইনী বাধাও অপসারিত হবে।

এইসব অহেতুক সংশোধন না করে যদি সংবিধানকে মানবকল্যাণের পথে পরিচালিত করা যায় সেটাই নাগরিক হিসেবে সবার জন্য কল্যাণকর হবে, কিভাবে জনকল্যাণমুখী একটি সংবিধান প্রণয়ন করা যায় এবং কিভাবে এই বিধিগুলোকে পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত করলে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম এবং আত্মমর্যাদাশীল একটি রাষ্ট্র হিসেবে নিজের অবস্থান নির্মাণ করতে পারবে এই বিষয়ে গণমাধ্যমে বিতর্ক শুরু হবে এবং সেসব নির্দেশনা ও পরামর্শের ভিত্তিতে সংবিধান পরিশোধিত হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করলেও বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমি নিশ্চিত এইসব আকাশকুসুম কল্পনার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। আশাবাদী হয়ে উঠবার মতো কোনো পরিস্থিতি এই মূহুর্তে নেই এখানে।